ধ্রুপদী ভাষার নামে নূতন করে শোষণ বন্ধ করুণ!

লেখক
জহরলাল সাহা

যা এখন শোনা যায় তাতে মনে হয় আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বাঙালী ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক স্তরে অর্থাৎ পঞ্চমশ্রেণী পাশের পর আর বাঙলায় পড়াশোনা করতে পারবে না৷ নূতন শিক্ষানীতি তো তা-ই বলে৷

এ শিক্ষানীতি কি শিক্ষাবিদরা বানিয়েছেন? নাকি মনোবিজ্ঞানীরা বানিয়েছেন? আর নাকি রাজনীতিবিদরাই তাদের কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রণয়ণ করেছেন? প্রশ্ণগুলো স্বাভাবিক৷ তবে বর্ত্তমান প্রতিবেদক আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে যখন প্রি-ইউনিভারসিটি ক্লাশে পড়তেন (যা বর্তমান একাদশ ক্লাশের সমতুল্য) তখন বিষয় বাংলা বাদে বাকী সব বিষয় ইংরেজী ভাষায়ই পড়ানো হতো৷ তখনকার শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করল---‘‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্দ, সুতরাং শিক্ষার মাধ্যম প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষাই হওয়া উচিত৷ তাই বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে শিক্ষার মাধ্যম বাংলাই হতে হবে৷ এতকাল সেজন্য বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে বাংলা ভাষাতেই পাঠদান চলছিল৷ শিক্ষাশ্রয়ী মনোবিজ্ঞান তাই এর বিরোধিতা করতে পারে না৷

রাজনৈতিক কারণেই বাংলাকে ধ্রুপদি ভাষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷ যদিও বাংলাভাষা ধ্রুপদি ভাষা হবার যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে৷ তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অভিমত--- পশ্চিম বাংলায় বর্ত্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তৃণমূলকে হঠিয়ে আসর জমাতে পারছে না৷ তাই ---‘হাতে মারিতে না পারি, তো ভাতে মারি’--- কৌশল নয়তো? কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের শাস্তি বা শিক্ষা (?) দিতে গিয়ে--- ত্রিপুরার ৭০ শতাংশ বাঙালীদের, কাছাড়ের করিমগঞ্জ, হাইল্যাকান্দি, শিলচর জেলার ৯৫ শতাংশ বাঙালীদের, অসমের প্রায় ৫০ শতাংশ বাঙালীদের আর বিহার-ঝাড়খণ্ড-উড়িষ্যার অন্তত প্রায় ৩৫ শতাংশ বাঙালীদের শাস্তি দেওয়া হবে কেন? তাদেরকে ও কেন মাতৃভাষায় পঠন-পাঠন বাংলা মাধ্যমে পড়তে দেওয়া হবে না? আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল পার্টি যদি দোষ করে থাকে (কেন্দ্রের বিজেপি-সরকারের মতে) তাহলে গোটা বাংলার ১৪ (চৌদ্দ) কোটি দোষ আর কিছু না--- ওরা বাঙালী হয়েছে বাঙালী কি দোষ করল? লোকে বলে দোষ আর কিছু না--- ওরা বাঙালী হয়েছে বলে! এটা কি কোন যুক্তির বিষয় হলো? বাঙালী সেন্টিমেন্টাল জাত, সাত এও রা’---করে না৷ কখন চোখ রাঙিয়ে চড়-বলে উঠবে--- আর সইবো না ! তখন অসাধ্য সাধন করবে৷ ১৯০১ সালে ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের নিম্নবর্ণের বাঙালীরা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে একদিনে দলে দলে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন৷ তা সবাই জানে৷

এবার আশা যাক, মাতৃভাষা অবদমিত হলে কি কি ও কত সুদূর প্রসারী ক্ষতি হয়!

এ বিষয়ে যুগান্তকারী শিক্ষাবিদন ও ভাষাতত্ত্ববিদ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর ‘ভাষা-সমস্যা’ প্রবন্ধে বলেছেন---‘বর্ত্তমান বিশ্বে প্রায় ৩০০টির মত ভাষার উদ্ভব হয়েছে৷ সমগ্র মানুষ জাতির সংস্কৃতি এক, যদিও দেশ-কাল-পাত্র ভেদে তার অভিপ্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন৷ এই অভিব্যক্তির তারতম্যকে কখনই সাংস্কৃতিক ভিন্নতা বলে না৷ যেহেতু এই বিশ্বের সমস্ত ভাষা মূলগত ভাবে এক ও অভিন্ন৷ ফলে সমস্ত ভাষা সমান গুরুত্বপূর্ণ ও সমভাবে শ্রদ্ধারপাত্র৷

ভাষা যেহেতু অন্তর্নিহিত ভাব ও চিন্তা প্রকাশে মাধ্যম সেহেতু তা মানুষের প্রাণধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত৷ নিজস্ব মাতৃভাষায় একজন যেমন স্বচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে নিজের ভাবপ্রকাশ করতে পারে তেমনটি অন্য কোন ভাষায় পারে না৷ মাতৃভাসা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে সে অসুবিধা বোধ করে৷ প্রতিনিয়তই যদি অন্য ভাষায় কথা বলিয়ে এরূপ অসচ্ছন্দ বোধ করতে তাকে বাধ্য করানো হয় তবে তার প্রাণশক্তি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে ---ক্রমশঃ প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে৷

এইরকম পরিস্থিতিতে সেই ব্যষ্টি বা ব্যষ্টি সমূহের মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেবে৷ প্রথমেই তার মধ্যে দেখা এক ধরণের হীনমন্যতা বোধ--- যা মানুষের মানসিক দুর্বলতার কারণ৷

যাদের ভাষা অবদমিত হবে তাদের নৈতিক সাহস উদ্যম ও প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে যাবে৷ শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটা পরাজিতের মনোভাব জাগবে---যা কোন জনগোষ্ঠীর প্রাণস্পন্দনকে অচীরেই স্তব্ধ করে দেবে৷

সুতরাং ভাষার অবদমন মানুষের মনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে৷ এই ধরণের ক্রমাগত অবদমনের ফলে জনগণ কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না ও তাদের অকালে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে৷ এই বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে যে, ভাষার ক্ষেত্রে অবদমিত এই জনগোষ্ঠী মানস অর্থনৈতিক শোষণের চাপে পড়ে সব সময় আর্থিক দিক থেকে পেছিয়ে থাকবে৷

তাই প্রাউট সুস্পষ্টভাবে বলে যে প্রত্যেক প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় সমস্ত ভাষাকেই সমান স্বীকৃতি, সুযোগ ও অধিকার দিতে হবে৷...প্রত্যেক ভাষাকেই আবশ্যিকভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে ও প্রত্যেক ভাষাকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে৷

এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে ভারতবর্ষ সমেত সমস্ত পৃথিবীতে এই ট্রেজেডিটাই ঘটে চলেছে৷’’

এতো গেল ভাষা বিষয়ে ভাষা বিজ্ঞানী তথা ভাষা বিশেষজ্ঞের মতামত৷ তা-ই যদি হয় তবে, ভারতের সংবিধানের অষ্টম তপশীলে স্বীকৃত বাংলা সহ পনেরোটি ভাষাকেই সমান মর্যাদা দেওয়া উচিত৷ নয়া শিক্ষানীতিতে মাত্র ছয়টি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছেও বাকী বাংলা সহ নয়টি ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ এতে উপরে তোলা হয়েছে ৬ ভাষাকে আর অবদমিত করা হয়েছে ৯টি ভাষাকে৷ ভারতের প্রায় (কম/বেশী) ৬৫ শতাংশ মানুষকে অবদমিত করা চেষ্টা হয়েছে৷ ভারতের বর্ত্তমান লোকসংখ্যা যদিও ১৪০ কোটি হয় তবে তার তিনভাগের দুই ভাগ মানুষ বা বাঙালীসহ প্রায় ৯০ কোটি মানুষের মাতৃভাষাকে অবদমিত করার চেষ্টা চলছে৷ যদি ত্রিপুরা, অসম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ঊড়িষ্যা ইত্যাদির স্থানের বাংলা ভাষাভাষি লোকসংখ্যা ৩০কোটি হয় কবে ভারতে অন্যান্য ভাষাভাষী আরও ৬০ কোটি মানুষের ভাষা ও অবদমিত হচ্ছে৷ --- ফলে ধ্রুপদী ভাষা থেকে বঞ্চিত (সোজা কথায়) এই ৯০ কোটি ভারতবাসীর মাতৃভাষা অবদমনের ফলে তাদের মনে--- ১৷ হীনমন্যতা Infiriority complex) ২৷ স্বচ্ছন্দে বা সাবলীলভাবে তারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবে না৷ পড়তে পারবে না৷ ৩৷ ফলে, মানসিক দুর্বলতা দেখা দিবে৷ ৪৷ তাদের নৈতিক সাহস, উদ্যম ও প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে যাবে৷ ৫৷ ক্রমে তাদের মনে পরাহিতের মনোভাব জাগবে৷ ৬৷ ভাষার ক্ষেত্রে অবদমিত এই জনগোষ্ঠীগুলি ক্রমে মানসার্থিক শোষনের Psycho-economical) শিকার হবে৷ ৭৷ আর অন্যদিকে ধ্রুপদী তকমাধারী জনগোষ্ঠীগুলি মহামন্যতায় Superiority complex) অন্যদেব শোষণ করতে চাইবে৷

আলোচনার এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রতিফলিত জনমত হলো---

১৷ নয়া শিক্ষানীতিতে ‘‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’’--- হচ্ছে কোথায়? প্রকারান্তরে তিন ভাগের দুইভাগ ভারতবাসী, বাঙালীসহ ৯টি সংবিধান স্বীকৃত ভাষাভাষী মানুষ এক কথায় বঞ্চিত, শোষিত হচ্ছে৷ ২৷ তাই, অবিলম্বে নয়া শিক্ষানীতি তথা ধ্রুপদী ভাষার তকমা নিয়ে পুনঃ বিবেচনা করা হোক৷ ৩৷ হয় সংবিধানের অষ্টম তপশীলে বর্ণিত বাংলাসহ ১৫টি ভাষাকেই ধ্রুপদী ভাষার অন্তর্ভুক্ত করা হোক, নতুবা ধ্রুপদী ভাষার তকমা এঁটে কাউকে বড় বা কাউকে ছোট বানানো বন্ধ করা হোক৷ ৪৷ এমনিতেই ভারতবাসী পুঁজিপতি শোষনে জেরবার, তার উপর আর মানসার্থিক psycho Economic) শোষণের যাঁতাকলের আবির্ভাব না করাই শ্রেয়৷