গ্রেট ডিপ্রেসনের পথে

লেখক
সুকুমার সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর ....

উত্তরে এটাই বলবো, স্বাভাবিক গতিতে পৃথিবীর  মাধ্যাকর্ষণ থেকে বেরোনো না গেলেও, যান্ত্রিক প্রযুক্তির  সাহায্যে রকেটে চড়ে যেমন মাধ্যাকর্ষণ ভেদ  করে ভিন্ন গ্রহে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে, তেমনি নোতুন অর্থনৈতিক দর্শন দিশা নিয়ে অর্থনীতির এই স্বাভাবিক পতনকেও ঠেকানো সম্ভব৷ প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, অর্থনৈতিক  মন্দার হাত থেকে বাঁচতে অর্থনৈতিক দর্শন দিশা খোঁজার প্রাথমিক যে শর্তের কথা একটু আগে বললাম, শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘প্রগতিশীল  উপযোগ তত্ত্ব সংক্ষেপে ‘প্রাউট’ তেমন একটি সঠিক  অর্থনৈতিক  দর্শন দিশা৷ তিনি স্বাভাবিক  অর্থনীতির পতনটাকে সংকোচ-বিকাশি ধারায় এমনভাবে গতিশীল করছেন যে, সংকোচ  ধারাটা কোনো কিছুর  ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব না ফেলে গতিশীলতাকে আরও  বাড়িয়ে দেবে৷ অর্থনীতির এই পর্যায়কে তিনি  ‘অর্থনীতির প্রমা ত্রিকোণ’ বা ‘ব্যালেন্স ইকোনমি’ বলেছেন৷ সমাজের সর্বক্ষেত্রেই তিনি এই ‘প্রমা ত্রিকোণ’ সৃষ্টির কথা বলেছেন৷ ফলে সময়-চক্রে মন্দা বা মহামন্দা এলেও তা যেন ব্যষ্টি মানুষ, সমিষ্টি মানুষ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা সকল ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক প্রোটেকসান দিতে পারে৷

দ্বিতীয় শর্ত, যোগা নেতৃত্বের হাতে সমাজ-রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতা দেওয়া৷ প্রাকৃতিক সম্পদ যদিও অসীম নয়তবুও এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে, তা এই মূহূর্তে পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যার জন্য যথেষ্ট৷ মন্দার কারণ হিসেবে যে অর্থাভাবের কথা বলা হচ্ছে  সেই অর্থাভাব আসলে সম্পদের সঠিক উপযোগ গ্রহণের  এবং  যুক্তিসঙ্গত বন্টনের৷ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় যুক্তিসঙ্গত বন্টনের ব্যবস্থা নেই৷ আছে সম্পদকে কুক্ষিগত করার ব্যবস্থা বা মানসিকতা৷ মন্দা আসলে  সম্পদের কুক্ষিকরণ৷ যারফলে  পুঁজিবাদী অর্থনীতির  দেশগুলিতে যে কোন সময় মন্দা  দেখা দিতে পারে৷  অতীতে এরকম বহু মন্দা আমরা দেখেছি৷ একইভাবে  সাম্যবাদী চিন্তার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতেও যুক্তিসঙ্গত বন্টনের ব্যবস্থা নেই৷ আছে ইকুয়াল ডিস্ট্রিবিউশনের কথা৷  সাম্যবাদী চিন্তার অর্থনীতিও গণঅর্থনীতি নয়! সাম্যবাদী চিন্তার অর্থনীতিকে রাষ্ট্রিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি বলা যেতে পারে৷ যেমন বর্তমানের চীন৷

চীনে মাওবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় উৎপাদন আকাশ ছুঁলেও সাধারণ মানুষের  জীবন যাত্রার মান কিন্তু খুব বেশি  বাড়েনি !

ফলে সাম্যবাদী চিন্তার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিও  অর্থনৈতিক মন্দার হাত থেকে বাঁচতে পারনি৷ কাউকে বাঁচাতেও পারেনি৷ কাউকে  বাঁচাতেও  পারেনি৷

এ ধরনের মন্দা বা মহামন্দার  হাত থেকে  বাঁচতে গেলে দরকার অর্থনীতি ‘গণঅর্থনীতি’ বা ‘পিপলস ইকোনমি’র৷ এতদিন পর্যন্ত সমাজ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গণঅর্থনীতির গুরুত্ব উপলব্ধ হলেও অর্থনীতির সংজ্ঞা-বিশ্লেষনে ‘গণঅর্থনীতি আলাদা বিষয় হিসেবে পাঠ সূচিতে ছিল না৷  ডক্টর অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কারের মূলে ছিল ‘গণঅর্থনীতির’র চাহিদার কথা তুলে ধরা৷  অভিজিৎ বিনায়ক আরও  একধাপ  এগিয়ে গণঅর্থনীতি ভিত্তি ভূমিতে যাঁরা  আছেন  কিংবা যাঁদের জন্য গণঅর্থনীতির  প্রয়োজন সেই দরিদ্র শ্রেনীর  মানুষদের  নিয়ে কাজ করে নোবেল পুরস্কার পেলেন৷ তাঁর বিষয় ছিল, দারিদ্র্যের শ্রেণী বিভাগ, অর্থনীতিতে দরিদ্রশ্রেণীর  মানুষের অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা৷ সরকারি বেসরকারী সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তিতে তাঁদের  জীবনের মান কতটা বাড়ছে  কিংবা বাড়েনি ------ এসবের  সমীক্ষা এবং সমাধানের জন্য নোতুন অর্থনৈতিক দর্শন দিশার অন্বেষন করা৷

অমর্ত্য সেনও ভারত-চীনের তূলনামূলক আলোচনায় নোতুন করে ‘গণঅর্থনীতির স্পষ্ট দর্শন দিশা উল্লেখের দাবী করেছিলেন৷ অভিজিৎ বিনায়কও গণঅর্থনীতির দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের জন্য সমীক্ষার পাশাপাশি তাঁদের  জন্য অর্থনৈতিক দর্শন দিশার অন্বেষনের কথা বলেছেন৷ কিন্তু একটি বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না, ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’-এর  প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার গণঅর্থনীতি নিয়ে নোতুন যে দর্শন দিশা দিয়েছেন এবং আশির দশকে গণঅর্থনীতি নিয়ে বিস্তৃত যে আলোচনা তিনি করেছেন, সে বিষয়ে  কেউই কোনো উল্লেখ করেননি-কী অমর্ত্য সেন, কী অভিজিৎ বিনায়ক! তাঁরা কি শ্রী সরকারের নোতুন এই অর্থনীতির খোঁজ জানেন না, নাকি জেনেও এড়িয়ে যাচ্ছেন?

শ্রী সরকার অর্থনীতির প্রচলিত প্রধান দুটি ধারা  ‘সাধারণ অর্থনীতি’ ও ‘বাণিজ্যিক অর্থনীতি’ বিষয়ের   সঙ্গে নোতুন আরও  দুটি  ধারা যোগ করেছেন, তার একটি হলো ‘গণ অর্থনীতি, অন্যটি মানস অর্থনীতি৷

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সাধারণ অর্থনীতি, বাণিজ্যিক অর্থনীতি, গণঅর্থনীতি এবং অর্থনীতি সবই নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজিপতিদের দ্বারা৷ সেখানে সবচেয়ে ধবংস হয় গণ অর্থনীতি৷ গণ অর্থনীতির পরিভূর মধ্যে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা  কমে গেলে সাধারণ অর্থনীতি এবং বাণিজ্যিক অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে৷ আর তখনই দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা৷ আর এইসব  কিছুর নেপথ্যে থাকে মানস অর্থনীতির বিষয়টি৷

অর্থনীতিতে মানস অর্থনীতির বিষয় ভাবনাটি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের এক যুগান্তকারী শুধু নয়, অভিনব আবিষ্কার৷ উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির যুগে শাসন শোষণের কলাকৌশল বদলে গেছে৷ এখন  দেশ দখল করে যেমন শাসন করা হয় না, তেমনি সরাসরি উচ্চ কর আদায়ের মাধ্যমেও শোষণ হয় না৷ বরং সাধারণ মানুষের ওপর থেকে বিশেষ করে  কৃষকদের ওপর থেকে প্রত্যক্ষ কর উঠিয়ে দিয়ে পরোক্ষ করের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানো হয়৷ পরোক্ষ কর, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে পুঁজিপতিদের  সহায়তায় আদায় করা হয়৷ এবং সেই কৌশল  এতটাই মানসিক স্তরে  ঘটানো হয় যে সাধারণ বুদ্ধি সেই কৌশল ধরতে  পারে না৷  মানসিক স্তরের এই কৌশলায়িত  শোষণকেই মানস অর্থনৈতিক শোষণ বলে৷ মানস অর্থনৈতিক শোষণের কবল থেকে  বাঁচতে বা বাঁচাতে এতদিন পর্যন্ত কোনো মানস অর্থনৈতিক দর্শন দিশা ছিল না৷ শ্রী সরকারই প্রথম মানস অর্থনৈতিক দর্শন বিষয়ক আলোচনা করেছেন৷

আজকের পৃথিবীতে যে আর্থ সামাজিক, আর্থ-সাংস্কৃতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে  তার মূলে আছে গণ অর্থনীতি ও মানস-অর্থনীতি -র প্রভাব৷

এমনিতে মনে হবে সাধারণ অর্থনীতি বা বাণিজ্যিক অর্থনীতিই মন্দার মূলে আছে৷ কিন্তু আজকের পুঁজিবাদ সর্বস্ব রাজনীতি যেহেতু নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজিবাদীদের দ্বারা তাই, অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করেন পুঁজিবাদীদের কর্র্পেরেট বুদ্ধিজীবীরা৷ তাঁরা শাসন শোষণের পর্যায়টাকে সূক্ষ্ম মানসস্তরে  নিয়ে গেছেন৷  সেই স্তর থেকে উন্নত ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে তাঁরা মানুষের মানসভূমিকে পর্যুদস্ত  করে শাসন শোষণ করছেন৷ পুঁজিবাদীদের এই মানস অর্থনৈতিক শাসন-শোষণ ঠেকাবার মত দর্শন না থাকায় পুঁজিবাদীরা  জেকে বসে নিজেদের মতো করে অর্থব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন৷  রাষ্ট্রের কোনো ক্ষমতাই থাকছে না সেই নিয়ন্ত্রণকে  লাগাম পরানোর৷ মানস-অর্থনৈতিক শোষণের কৌশল এতটাই নিয়ন্ত্রণহীন এবং এতটাই সূক্ষ্ম, তা বুঝে ওঠার আগেই রাষ্ট্রহীনতার  ভুল পদক্ষেপ  নিয়ে ফেলছেন৷ এই ভূল  পদক্ষেপ  নেবার জন্যেই পুঁজিপতিরা বিশেষ বিশেষ সময়ে, বিশেষ বিশেষ পুরস্কার দিয়ে অর্থনীতিবিদদের  মুখপাত্র করে তোলেন৷ ভারতে গ্যাট চুক্তি , মিডডে  মিল, একশো  দিনের  কাজ সব নানান শোষণ সহায়ক, দান খয়রাতমুখী এবং অনুৎপাদনমুখী অর্থনীতি প্রণয়নের মুখ ছিলেন তৎকালীন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ডক্টর অমর্ত্য সেন৷ আজকে আরেক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মিডডে মি, সরকারি ওষুধ বন্টন  সহ সেই সময়ের নানান প্রকল্পের নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছেন৷ আসলে দরিদ্র শ্রেণীর অর্থনীতির কথা বলে অভিজিৎ বিনায়ক নোবেল পুরস্কার দেওয়া, হতে পারে পুঁজিবাদীদের নতুন কিছু পরিকল্পনাকে রূপায়িত করার কৌশল৷ এ সবই ওই মানস -অর্থনৈতিক  শোষণের বিষয়৷ তাই উত্তরণের পথ এখনো পর্যন্ত  এবং অনেকদিন পর্যন্ত অধরাই থেকে  যাবে! একমাত্র উপায় আছে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ব্যালেন্স ইকোনমির নোতুন ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’’-এর  অর্থনৈতিক দর্শন দিশার শরণাপন্ন  হওয়া৷ যত তাড়াতাড়ি সমাজ, রাষ্ট্র এবং  অর্থনীতিবিদগণ  এ ব্যাপারে  এগিয়ে  আসবেন তত তাড়াতাড়ি বিশ্বের সার্বিক কল্যাণ হবে৷