ঘুমন্ত বাঘ জেগে ওঠার অপেক্ষায়

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে তৈরী হওয়া ন্যাশনাল টেষ্ট এজেন্সী (এন.টি.এ)-র নতুন নির্দেশিকায় বলা হয়েছে এখন থেকে জয়েণ্ট এণ্টার্ন্স পরীক্ষায় প্রশ্ণোত্তরের মাধ্যম হবে হিন্দী, ইংরাজী ও গুজরাতি৷ এতদিন কেবল হিন্দী ও ইংরাজীতে জয়েণ্ট এন্টার্ন্স পরীক্ষা দিতে হ’ত৷ তাতে স্বাভাবিকভাবে বাংলাভাষী সহ অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাভাষীদের প্রবল আপত্তি ছিল৷ হিন্দী ভাষীরা তাদের মাতৃভাষায় (যদিও ভারতবর্ষের কোনও জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিন্দী নয়, তবে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে কিছু জনগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে হিন্দীকেই মাতৃভাষা করে নিয়েছে) পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেত৷ কিন্তু অন্যান্য ভাষাভাষীরা সে সুযোগ পেত না৷ ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রতিযোগিতায় হিন্দী ভাষীরা এগিয়ে থাকত৷ এই বৈষম্য সংবিধান বিরুদ্ধ৷ তবু হিন্দী প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রভাষা না হওয়া সত্ত্বেও তাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার অন্যান্য ভাষাভাষীদের বঞ্চনা করে৷ এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিশেষ করে বাঙলায় দীর্ঘদিন ধরে ‘আমরা বাঙালী’ সহ অনেকেই আন্দোলন করে আসছে৷ পশ্চিমবাঙলার মুখ্যমন্ত্রীও সমস্ত আঞ্চলিক ভাষায় জয়েণ্ট এন্টার্ন্স পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দানের দাবী করেছেন৷

এখন হঠাৎ কেন হিন্দী-ইংরাজীর পাশাপাশি গুজরাতিতে এই পরীক্ষার প্রশ্ণপত্র ও উত্তর দেওয়ার সুযোগ দানের কথা ঘোষণা করা হ’ল! কেন অন্যান্য ভাষাভাষীকে সে সুযোগ দেওয়া হ’ল না৷ বাংলাও কেন বঞ্চিত হ’ল?

এর আগে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ইংরাজী ছাড়া অসমীয়া, ওড়িয়া, হিন্দী ও আরও কয়েকটি ভাষায় প্রকাশ করার কথা ঘোষণা করা হয়৷ অথচ বাংলাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল৷ এটা যে ইচ্ছাকৃত এতে কোনও সন্দেহ ছিল না৷ অসমীয়া, ওড়িয়া প্রভৃতি ভাষাকে যে সুযোগ দেওয়া হ’ল বাংলাকে সে সুযোগ দেওয়া হ’ল না কেন? এর কোনও সদুত্তর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই৷ অনেক প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলনের পর সুপ্রিম কোর্টের রায় বাঙলায় প্রকাশের কথা ঘোষণা করা হ’ল৷

কিন্তু কেন বাঙলার প্রতি বারবার এই বঞ্চনা? এশিয়া মহাদেশে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাঙলা তথা ভারতকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ সম্মানে বসিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ৷ আজ পর্যন্ত ভারতের অন্য কোনও ভাষা এ যোগ্যতা দেখাতে পারেনি৷ রবীন্দ্রনাথের বাংলা ভাষায় রচিত সঙ্গীত দু’টি দেশের ---ভারত ও বাঙলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত৷ পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসেবে বাংলা রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতি লাভ করেছে৷ বাঙলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবীতে ছাত্র আন্দোলনে পাঁচ জন তরুণ প্রাণবলি দিয়েছিলেন৷ এই ভাষা আন্দোলনকে সম্মানিত করে রাষ্ট্রসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে চিহ্ণিত করেছে৷ এই মুহূর্ত্তে সারা পৃথিবীতে ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে৷ এ হেন এক সমৃদ্ধশালী ভাষাকে কেন্দ্রীয় সরকারের বারবার অমর্যাদা করা বিস্ময়ের ব্যাপার৷ গুজরাতি ভাষা বাংলা ভাষার থেকে উন্নত কোন দিক থেকে?  কোনও দিক থেকেই উন্নত নয়৷ বাংলাকে বাদ দিয়ে গুজরাতিতে জয়েণ্ট এণ্ট্রান্স (মেইন) পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগের কথা ঘোষণার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে? এর কী কোনও সদুত্তর আছে? নিশ্চয়ই নেই৷

এর একমাত্র সদুত্তর হচ্ছে দেশের শাসক দলের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুজরাতি৷ ক্ষমতায় আসীন হলেই কী ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংবিধানের বিধি লঙ্ঘন করা যায়? ভারতীয় সংবিধান কী এই ভাষাগত বৈষম্য সমর্থন করে? তা নিশ্চয়ই করে না৷ তাই কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক এইভাবে বাংলার প্রতি বঞ্চনায় বাঙলা জুড়ে কেন্দ্র বিরোধী তথা বিজেপি বিরোধী বিক্ষোভ প্রবল থেকে প্রবলতর হবে৷ তার পরিণতি যে ভাল হবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ বিজেপি নিজের পায়ে কুড়ুল মারছে৷

তাই সমস্ত বাংলাভাষীর দাবী অবিলম্বে জয়েণ্ট এন্টোর্ন্সে বাংলা সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক৷ ইতোমধ্যেই বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের ভয়ঙ্কর অভিযোগ রয়েছে৷ তাবপর ভাষা বৈষম্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মোটেই মেনে নেবে না৷

তার ওপর অসমে এন আর সি করে  ১৯ লক্ষ বাঙালীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে৷ আবার বাংলা ভাষী ত্রিপুরা ও পশ্চিমবাঙলায় এন আর সি করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে৷ অবিলম্বে বাঙলা ও বাঙালীর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র বন্ধ না করলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সম্মিলিত বিক্ষোভ বিস্ফোরণ হয়ে দেখা দেবে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বিদ্রোহী বাঙলার ইতিহাস কি কেন্দ্রীয় সরকার ভুলে গেছে? মনে রাখতে হবে শুধু কোন অহিংসার পূজারীর হাতের লাঠি দেখে ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে যায়নি৷ ব্রিটিশ ভারত ছেড়েছে বাঙলার বিপ্লবীদের কাছে মাথা নত করে৷ আজ বিপ্লবের সেই  বাঘ শেষ হয়ে যায়নি৷ শুধু জেগে ওঠার অপেক্ষায়৷