জাতির নামে বজ্জাতি

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

জাত গেল জাত গেল একি আজব কারখানা,

সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না৷

পৃথিবীতে ধর্মের নামে যত রক্তপাত হয়েছে তা দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধে হয়নি৷ কিন্তু কি এই ধর্ম? এই ধর্মের দেখা পেতে হলে আমাদের হাজার হাজার বছরের পিছনে হাটতে হবে৷ তখন ঝড়-ঝঞ্ছা-বন্যা- খরা-ভূমিকম্প-বজ্রপাত-বিদ্যুল্লেখা ও সীমাহীন নীলাকাশ দুস্তর, পারাবর-নিবিড় অরণ্যানী গুহাবাসী বৃক্ষবাসী আদিম মানুষের মনে ভয় ও  বিস্ময় জাগায়৷ কারণ জানার মত বুদ্ধিবৃত্তির উন্মেষ তখন হয়নি, প্রতিহত করা বা এদের ওপর প্রভুত্ব করার চিন্তা বা সাধ্য কোনটাই ছিল না৷ এদিকে ওসবের প্রত্যক্ষ আঘাতের-সংযোগে অস্তিত্বের সংকট৷ সন্ত্রস্ত বিভ্রান্ত মানুষ ক্রমে প্রাকৃতিক শক্তি ও সত্তাগুলোর আড়ালে  এক একটা দৈবী শক্তির অস্তিত্বের কথা ভাবতে শুরু করার ক্ষমতা যেমন আছে, তেমনি আছে কল্যাণ করার ক্ষমতা৷ তাই  ভয়ে ভক্তিতে আত্মমঙ্গলের  স্বার্থে মানুষ শক্তিগুলির কাছে  আত্মসমর্পণ করে বসে৷ ফলে আদি পর্বে প্রায় পৃথিবীর  সব দেশের মানুষই বিশেষ বৃক্ষ, পাথর, পাহাড়, ফুল, ফল, জল, নদী, সাগর, পশু, পক্ষী, আকাশ, বাতাস, বজ্র, বিদ্যুৎ, আগুন, বিশেষ বিশেষ স্থান ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তি ও সত্তার ওপর দেবত্ব  আরোপ করে পূজা করতে থাকে৷ আবার সেই সময় পশুর থেকে সামান্য ইতর বিশেষ মানুষের জীবন যুদ্ধে  প্রতিকূল পরিবেশে জীবন ছিল অত্যন্ত অনিশ্চিত, যে কোন মুহূর্তেই জীবন চলে যায়৷ সঙ্গী সংখ্যা ঠিক রাখা ছিল দুরূহ ব্যাপার৷ তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও পূরণের তাগিদ, আর প্রতীকের কল্পনা থেকে  শুরু হয়ে যায় লিঙ্গপূজা৷ কল্পনা রূপ নেয় বিশ্বাসে৷ আরো পরে মানুষ ভাবতে থাকে এসব খণ্ড খণ্ড শক্তির পিছনে নিশ্চয়ই একটা অখণ্ড অনন্ত শক্তি আছে, খণ্ড শক্তিগুলো তারই প্রতিফলন মাত্র৷ তাই ক্রমবিকশিত মনের মানুষ খণ্ড ভজনায় আর খুশি থাকল না৷ তাছাড়া খণ্ডের ভজনায় ও ভোগে-উপভোগে  অখণ্ড  সুখ আসছে না, অখণ্ড অনন্ত সুখ অর্থাৎ আনন্দ যে পাই--- ‘সুখম অনন্তম্‌ আনন্দম্‌’৷ তাই সবের পিছনের সেই অজানা অখণ্ড অনন্ত শক্তিকে জানার জন্য আকুল হয়ে উঠল৷ কিন্তু পূজার ষোড়শ উপাচারে নানা উপকরনে, বাহ্যিক আড়ম্বর অনুষ্ঠানে পেট ভরলেও মন ভরছে না, সেই বাঞ্ছা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ জানার আকুলতা তো কমেনি, বেড়ে যায় আরো৷ এরই ফলশ্রুতিতে মানুষ আবিষ্কার করে আড়ালের সেই অচেনা অজানা সত্তাকে জানার মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা কাল্ট৷ এখানে  দুটো বিষয় লক্ষ্যনীয়---১) সবকিছুর মধ্যে এক শক্তির  অস্তিত্বের ভাবনা, ২) সেই একশক্তি থেকেই সব কিছু এসেছে, অর্র্থৎ তাই হল সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু (সুুপ্রীম নিউক্লিয়াস পয়েন্ট)---সূর্য যেমন সৌর জগতের কেন্দ্র নিউক্লিয়াস্‌ পয়েণ্ট৷ এই বিষয়টাকে সংস্কৃতে এককথায় বলা হয় ‘ঈশ্বর’ (ঈ+ অর ---ঈশ্বর)৷ ঈশ মানে যিনি সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, অর্থাৎ সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ কর্তা৷ তাই এই ভাবনা চিন্তা কে বলে ঈশ্বর  চিন্তা  বা ভাবনা৷ আরেকটা কথা--- সেই আদিম কাল থেকেই দেখা যাচ্ছে মানুষ অল্পে সন্তুষ্ট হচ্ছে না, অনেক অনেক চায়, তবু সুখী হচ্ছে না৷ এই অনন্ত ক্ষুধা মেটাবার জন্যে ভোগের নানা উপকরণে  ঠাসা বাইরের জগত থেকে নিয়ে  অন্তর্র্লেকের দিকে ছুটছে৷ বাইরের জগতটাকে ফেলতেও পারছে না, তাহলে অস্তিত্বই থাকছে না৷ নিবিড়ভাবে পরখ করলে বোঝা যায়--- এটাই  মানুষের স্বভাব, মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য--- যা অন্যান্য জীবজন্তুর মধ্যে নেইও৷ বিজ্ঞানে দর্শনে একেই বলা হয় ‘ধর্ম’৷  যে কোন সত্তার  সত্তাগত গুণ বৈশিষ্ট্য৷ বিজ্ঞানের  ভাষায়---প্রপার্টি বা ‘ক্যার্যা ক্‌টারিসটিক্‌স’৷ এই কারণে ঈশ্বর চিন্তার আর এক নাম ধর্মচিন্তা, মানুষের ধর্মভাবনা ও ঈশ্বর ভাবনা সমার্থক৷ আবার এটাতো  মানুষের অন্তর্মুখী চেতনা ও চলা, আত্মিক বিস্তারের নিত্যপ্রয়াস, তাই এক কথায়  এ হল আধ্যাত্মিক, আর প্রয়াস টাকে বলে আধ্যাত্মিকতা৷ তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল ঈশ্বরসাধনা ও ধর্মসাধনারই আর একনাম আধ্যাত্মিকতা---যার ইংরেজী প্রতিশব্দ হচ্ছে স্পিরিচ্যুয়ালিজম, স্পিরিচ্যুয়ালিটি নয়৷ স্পিরিচ্যুয়্যালিটি বলতে ভূত, প্রেত, অশরীরী সত্তাদিকে বোঝায়৷ মানুষের ধর্ম ভাবনার এটাই যদি  প্রকৃত ধারা হয়, তাহলে এখানে মানুষের মধ্যে জাতপাত ধর্মীয় ভেদাভেদের গল্প কোথায়? গল্প তো অন্য জায়গায়! (ক্রমশঃ)