কেন নিরামিষ ভোজন করা বাঞ্ছনীয়

লেখক
পূর্ণানন্দ রায়

ইংরাজীতে একটা প্রবাদ বাক্য আছে,‘‘If wealth is lost, nothing is lost, is health is lost something is lost, if character is lost, everything is lost’’ অর্থাৎ ধনসম্পত্তি হারালে কিছু ক্ষতি নাই, স্বাস্থ্য হারালে কিছু হারাল, কিন্তু চরিত্র হারালে সবই গেল৷ স্বামী বিবেকানন্দের মূল মন্ত্র ছিল---‘তোরা চরিত্রবান হ৷’

আজকের এই বিকৃত সমাজে যে নিদারুণ অবক্ষয় সারা বিশ্বে ঘটে চলেছে তার একমাত্র কারণ মানুষের অদৃঢ়বদ্ধ চরিত্র৷ বর্তমান মানুষের চরিত্রের মধ্যে দেখা দিয়েছে আসুরিক জঘন্যতা৷ মানবতার সমস্ত গুণগুলি হারিয়ে ফেলেছে৷ ব্যভিচার, দুর্নীতি, স্বার্থপরতা তাকে পশুত্বে পরিণত করেছে৷ এই চরিত্রকে ঠিকমত গড়ে তুলতে হলে যেমন যথার্থ শিক্ষার প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন এমন ধরণের খাদ্য যা চরিত্র নির্মাণে সাহায্য করতে পারে৷ সেই নিরামিষ খাদ্যের কথাই এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়৷

নিরামিষ খাদ্যের কথা বলার আগে খাদ্য সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন৷ মানুষের দেহ তিনটি জিনিস দিয়ে তৈরী---বাতাস, জল আর খাদ্য৷ এই তিনটি মানুষের দেহের প্রধান উপাদান৷ এই উপাদানগুলি যদি ঠিকমত ব্যবহার করা হয় তাহলে সুস্থ শরীর নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকা সম্ভবপর হবে৷ স্বাস্থ্য আর রোগ জীবনের দুটি বিপরীত মেরু৷ যারা প্রকৃতির নিয়ম মানে না তারা রোগ ব্যাধির শিকার হয়৷ স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় অপহারক---বেঠিক খাদ্য৷ অতি ভোজন স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর৷ কিন্তু আজকের মানুষ একথা বড় একটা বোঝে না৷ প্রয়োজনাতীত খাদ্যের আড়ম্বর, নির্বিচার গুরুভোজন, লোভ, অজ্ঞতা প্রভৃতি মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার পরিপন্থী হয়ে পড়েছে৷ মানুষের ভুল আহার-বিহার থেকেই  নানা ধরণের ব্যাধির উৎপত্তি দেখা দিচ্ছে৷ চরিত্রের মধ্যে প্রকটিত হচ্ছে অশুভ লক্ষণ, ফলে হচ্ছে অকাল মৃত্যু আর সামাজিক বিশৃঙ্খলা৷ জরামুক্ত দীর্ঘজীবন আর সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য যে মানসিকতার প্রয়োজন তার জন্যে আমাদের জানতে হবে আহার ও আহার্য সম্বন্ধে৷

মনে রাখতে হবে আদি উদ্ভিদভোজীর দাঁত, পাকস্থলী, অন্ত্র প্রভৃতি আজও মানুষ নিজ দেহে বহে চলেছে৷ অতএব প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে মানুষের খাদ্য আমিষ বর্জিত হওয়া উচিত৷ ফলমূলাহারী প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন ক্রিয়া প্রায় একপ্রকার৷ বনের ফলমূলাহারী৷ বানরের দাঁত ও পাকস্থলী মানুষের দাঁত ও পাকস্থলীর অনুরূপ৷ অন্যদিকে বাঘ, সিংহ প্রভৃতি মাংসাহারী পশুগণের দাঁত ও পাকস্থলী সম্পূর্ণ অন্য প্রকারের৷  এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৈজ্ঞানিকগণ স্থির করেছেন যে মাংসাহার মানুষের জন্য নির্দিষ্ট হয় নাই৷ নিরামিষ জাতীয় দ্রব্যই মানুষের খাদ্য৷

আমেরিকার মাউণ্ট সাইনাই স্কুল অফ্ মেডিসিনের প্রাক্তন গবেষক পুষ্টিবিজ্ঞানের ডক্টরেট অধ্যাপক সুব্রত চট্টোপাধ্যায় বলেছেন---‘নিরামিষ ভোজনই সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর ও বিজ্ঞানসম্মত৷’ তাঁর মতে, জীবনের সব অবস্থায় সুষম নিরামিষ খাদ্য উপযোগী৷ সুপরিকল্পিতভাবে খাদ্য গ্রহণ করলে সকল প্রকার প্রাণীজ খাদ্যদ্রব্য যেমন মাছ, মাংস, ডিম এমনকি গবাদী পশু-প্রাণীর দুধ ও যাবতীয় দুগ্দজাত খাদ্যদ্রব্য না খেয়েও স্বাস্থ্য রক্ষা করা যায়৷ গবেষণায় জানা গেছে আমিশাষীদের তুলনায় নিরামিশাষীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যবস্থা বেশী শক্তিশালী৷ নিরামিষ আহার আয়ূ বৃদ্ধি করে৷ নিরামিষ ভোজনের সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম, যোগ ও ধূমপান থেকে বিরত থাকলে সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে দশ বছর পর্যন্ত আয়ূ বৃদ্ধি হতে পারে৷

নিরামিষ ভোজন হৃদযন্ত্রকে ভাল রাখে৷ এমনকি হৃদরোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে৷ গবেষণায় দেখা গেছে আমিশাষীদের তুনায় নিরামিষাশীদের মধ্যে হৃদযন্ত্রের বিবিধ ব্যাধির প্রকোপ লক্ষ্যণীয় রূপে কম৷  মাংস খাওয়া যত বেশী হবে হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব তত বেশী৷ উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের ক্ষেত্রে, নিরামিষ আহার শুরু করার দু’সপ্তাহের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের মাত্রা তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পায়৷ নিরামিশাষীদের মধ্যে হৃদরোগের ব্যাপকতা শুধু কমই নয়, হৃদরোগ জনিত মৃত্যুহারও উল্লেখযোগ্যভাবে কম৷ নিরামিশাষীদের মধ্যে হৃদরোগের ব্যাপকতা কম হওয়ার অন্যতম কারণ---তাদের রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা কম৷ কেননা খাদ্যতন্তু বা আঁশ (ফাইবার) থাকলে তা কোলেস্টেরল, কমাতে সাহায্য করে৷

নিরামিশ আহার ক্যানসার না হতে সাহায্য করে ও রোগের সম্ভাব্য বিপদও কমিয়ে দেয়৷ গবেষকদের মতে যাবতীয় ক্যানসার রোগের ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ খাদ্যের সঙ্গে জড়িত৷ কিছু ক্যানসার যেমন বৃহদন্ত্র, প্রস্ট্রেট ও স্তনের ক্যানসার স্পষ্টতঃই খাদ্য সম্পর্কিত৷ মাছ, মাংস তথা প্রাণীজ খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে প্রস্টেট ক্যানসার রোগের ঘনিষ্ট সম্পর্কও নিরূপিত হয়েছে গবেষণায়৷ ভারতীয় পুরুষদের ক্যানসার বেশী হয় মুখগহ্বরে, ফুসফুসে, খাদ্যনালীর উপরিভাগে, বৃহদন্ত্রে ও প্রস্টেটে৷ ভারতীয় নারীদের ক্ষেত্রে সর্বাধিক বেশী হয় প্রথমতঃ জরায়ূর নীচে সার্ভিক্স নামক অংশে, দ্বিতীয়তঃ স্তনে, তৃতীয় মুখগহ্বরে৷ মাংসাশীদের শ্বেত রক্তকোষের ক্যানসার কোষ ধবংস করার ক্ষমতা যতখানি, নিরামিশাষীদের তার দ্বিগুণেরও বেশী৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিরামিষ আহারের ক্যানসার প্রতিষেধক---উপযোগিতা প্রযোজ্য৷

গবেষণায় প্রতিপন্ন হয়েছে আমিষ আহারের সঙ্গে ডায়াবিটিস (বহুমূত্র রোগ) হওয়ার সম্ভাব্য বিপদ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত৷ আমিশাষীদের তুলনায় নিরামিশাষীদের মধ্যে ডায়াবিটিশের ব্যাপকতা কম৷ নিরামিষ আহার শুধু ডায়াবিটিস হওয়ার সম্ভাব্য বিপদ কমায় না, এমনকি ডায়াবিটিস হয়ে থাকলে তার চিকিৎসাতেও সাহায্য করে৷ এছাড়া নিরামিষ ভোজনের অন্যতম উপকারিতা হ’ল রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকা যা ডায়াবিটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী৷ ইনসুলিন নির্ভরতাহীন ডায়াবিটিসের ক্ষেত্রে ফলমূল, শাকসব্জি, উদ্ভিদ প্রদান নিরামিষ আহারের মাধ্যমে এই রোগ ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷  কিছু ক্ষেত্রে সুষম নিরামিষ খাদ্য ও নিয়মিত ব্যায়ামের সাহায্যে এই রোগ নিরাময় করা যেতে পারে৷ নিরামিষ আহার শরীরের হাড় আরও শক্ত রাখে৷ পরিণত বয়সে হাড় ভাঙ্গে কম৷ প্রৌঢ় ও বৃদ্ধাদের মধ্যে গবেষণায় দেখা গেছে নিরামিশাষীদের তুলনায় আমিশাষীদের মহিলাদের হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ৷ বিশেষজ্ঞদের মতে হাড় ক্ষয়ে কমজোরী হয়ে ভাঙ্গার ক্ষেত্রে মূল অপরাধী হ’ল খাদ্যে বেশী পরিমাণে প্রোটিন, বিশেষতঃ প্রাণীজ প্রোটিন৷ হাড়কে মজবুত রাখতে হলে খাদ্য তালিকায় ঘন সবুজ শাকসব্জির পরিমাণ বাড়ানো৷

নিরামিষ আহার কিডনিকে ভাল রাখে৷ কিডনির অসুখ হওয়ার সম্ভাব্য বিপদ কম থাকে৷ এক্ষেত্রে খাদ্যে প্রোটিন বেশী খেলে প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম ও অক্সালেটের পরিমাণ বাড়ে৷ গবেষণায় দেখা গেছে আমিশাষীদের তুলনায় নিরামিশাষীদের মধ্যে কিডনি স্টোনের প্রকোপ অনেক কম৷ কিডনি বিকল হওয়ার অন্যতম প্রধান দু’টি কারণ হ’ল উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবিটিস৷ দুইয়ের সম্ভাব্য বিপদ নিরামিশাষীদের মধ্যে কম৷ আমিষ আহারে কিডনির অসুখ বিস্তার লাভ করে৷ আর যদি কিডনির অসুখ থাকে তা আরও খারাপের দিকে যায়৷    (ক্রমশঃ)