কর্ষক প্রধান বাঙলার  ইতিকর্তব্যতা

লেখক
একর্ষি

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না৷ তাই কৃষিজ পণ্যের দাম অর্থনৈতিক সূত্র মেনে চলে না৷ কর্ষককে অবস্থার চাপে ফেলে অতি কম মূল্যে উৎপাদিত পণ্যকে বিক্রয় করতে বাধ্য করা হয়৷ কৃষিকে যদি শিল্পের মত সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় তাহলে শিল্পের ক্ষেত্রে যে নীতি অনুসৃত হয় কৃষির ক্ষেত্রে তাই প্রযুক্ত হওয়া উচিত৷ উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ কালে বীজের দাম, শ্রমিকের মজুরী, কাঁচামালের দাম, কর্মচারীর পেনশন ব্যয়, অত্যুৎপাদনের সময় গুদাম ব্যয়, উৎপাদনের ক্ষয়ক্ষতি ব্যয়, সিংকিং ফাণ্ড---এসব কিছুই বিবেচিত হবে৷ ফলে চাষী ফসলের ন্যায্য দাম পাবে৷ দাম নির্ধারণে ফড়ে মহাজনদের মাতববরি তথা নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হবে৷ চাষীর আর্থিক স্বাচ্ছল্য আসবে৷

প্রাউটের এই কৃষিনীতি বাস্তবায়িত হবে সমবায়ের মাধ্যমে৷ কৃষি সমবায়ে থাকবে উৎপাদন সমবায় ও উপভোক্তা সমবায়৷ এছাড়াও প্রাউট আরও বিভিন্ন প্রকারের সমবায় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পক্ষপাতী৷ যেমন কৃষিভিত্তিক শিল্প- সমবায়, কৃষির সহায়ক শিল্প-সমবায়, অকৃষিজাত উৎপাদন সমবায়---ইত্যাদি৷ সমবায়গুলো গড়ে ওঠার শর্ত হ’ল (ক) সমবায়ের সদস্যদের শ্রম ও বুদ্ধি, (খ) একই অর্থনৈতিক কাঠামোয় একই প্রয়োজনের তাগিদে (গ) উৎপাদন দ্রব্যের বাজার পাচ্ছে কি না৷ প্রাউটের সমবায় পদ্ধতির একশ’ ভাগ প্রয়োগ কয়েকটি পর্যায়ে হবে৷ মালিকানা, উৎপাদনের অংশ ভাগ, লভ্যাংশ্য ভাগ, নানা বিষয়গুলো সঠিক মাত্রা পাবে স্তরে স্তরে৷ তবে স্মরণ রাখতে হবে সমবায়ের সাফল্য নির্ভর করে তিনটি শর্তেরওপর৷ (ক) নীতিবাদী পরিচালক মণ্ডলীর পরিচালনা, (২) সমবায়কে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা, (৩) কড়া শাসন৷

প্রাউট কৃষিতে ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন চায়৷ তখন এর সংশ্লিষ্ট বহু সমস্যাই চিরতরে দূর হয়ে যাবে---যেমন সবসময়ই আধুনিকীকরণের পথ প্রশস্ত থাকবে৷ ফলে অত্যাধুনিক সার, বীজ, সেচ, কর্ষণ-বপন-রোপন-কর্ত্তন-সংরক্ষণ-বণ্টন ব্যবস্থা সহজেই গৃহীত হবে ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে৷ সুসন্তুলিত অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী কৃষিক্ষেত্র থেকে যারা উদ্বৃত্ত হবে কৃষি সহায়ক শিল্প, কৃষিভিত্তিক শিল্প ও অন্যান্য সমবায়ে নিযুক্ত হতে পারবে৷  ফলে অর্থনীতিতে একটা ভারসাম্য আসবে৷ বেকার সমস্যারও সমাধান হবে৷ সমবায় প্রথার চাষে মধ্যসত্বাভোগীদেরকো স্থান নেই৷ উৎপাদক ও উপভোক্তা সরাসরি সংযোগ রক্ষা করতে পারবে৷ এতে চাষী ও উপভোক্তা সকলেই লাভবান হবে৷ শোষণের ফাঁকফোকরগুলো সিল হয়ে যাবে৷ এছাড়া সমবায় পদ্ধতির অন্যান্য সুফলগুলি হ’ল (১) ছোট ছোট কৃষিজমি একত্র করে বড় জমি হলে ইকনমিক হোল্ডিংয়ের রূপ নেবে৷ এতে জমির আয়তন বাড়বে, জমি নষ্ট হবে ন, উৎপাদন বাড়বে, (২) অনেকের মূলধন ও সম্পত্তি একত্রিত করে উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ ঘটবে৷ ট্রাকটার, উন্নত সার, বীজ, সেচ, ওষুধ প্রভৃতির ব্যবহারের সুযোগ ঘটবে৷ যা একজনের পক্ষে অনেক সময় সম্ভব হয় না৷ বলা বাহুল্য আধুনিক প্রথায় চাষ বা আজকালকার চাষ বেশ ব্যয়বহুল৷ সমবায়ের পক্ষে এই ব্যয়ভার বহন করা সহজ৷ (৩) চাষীদের দুরবস্থার অন্যতম কারণ অভাবী বিক্রয়৷ সমবায়ে কর্ষক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ভোগ করতে পারবেন৷ অভাবী বিক্রয় করতে হবে না৷ ফড়ে মহাজনদের ঋণের ফাঁদেও ফাঁসতে হবে না৷ (৪) ব্যষ্টিগত মালিকানায় মধ্যএস্বত্বাভোগীরা লাভের যে বড় অংশ ঘরে তুলত, সমবায়ে আর সে সুযোগ পাবে না৷ (৫) কর্ষক তার উদ্বৃত্ত ফসল সমবায়েই বেচতে পারবে৷ ঠকার ভয় থাকবে না, উপরন্তু ফসলের দাম বাড়লে সমবায়ে তা বিক্রি করলে সমবায়ে সদস্য হিসেবে ওই কর্ষক তার লভ্যাংশ পাবে৷ (৬) যার জমি নেই অথচ অর্থ আছে সেও সমবায়ের সদস্য হয়ে আয় করতে পারবে৷ আবার যাদের কায়িক শ্রম বা বৌদ্ধিক শ্রম দেবার ক্ষমতা আছে তারাও যোগ্যতা অনুযায়ী সমবায়ে অংশগ্রহণ করে আয় করতে পারবে৷ কেউ বেকার বসে থাকবে না৷ একমাত্র সমবায় পদ্ধতি গ্রহণের ফলেই ব্লকে ব্লকে একশ’ ভাগ কর্মসংস্থানের পথ প্রসস্ত হবে৷ শিল্পের মর্যাদা দিতে সমবায় পদ্ধতি সঠিক পথ৷ এক-একটি সমবায় এক-একটি প্রসিদ্ধ শিল্পের গুরুত্ব নিয়ে বেড়ে উঠবে৷ কৃষির সাথে যুক্ত প্রত্যেকটি মানুষ আর্থিক স্বচ্ছলতায় সামাজিক মর্যাদায় ভূষিত হবে৷ তখন আর কেউ চাষের কাজকে ছোট কাজ বলে অবহেলা করতে পারবে না৷ চাষী বলে অবজ্ঞা করতে পারবে না৷ তখন তার পরিচয় হবে কৃষি সমবায়ের সদস্য৷ পূর্ণাঙ্গ কৃষি সমবায়গুলি হবে স্থায়ী চাকুরীর স্থল৷ অর্থাৎ কর্মক্ষেত্র৷ শিল্পের মত দৈহিক শ্রমের সঙ্গে বৌদ্ধিক শ্রম হবে এর চালিকা শক্তি৷ বর্তমান বিশ্বের উৎপাদন ক্ষেত্রগুলির বড় সমস্যা হ’ল শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিক-মালিক বিরোধ, শ্রমিক-মালিক সমস্যা৷ মালিক শ্রমিকের সাহায্যে উৎপাদন করে এ সহযোগিতার নাম দাস সুলভ সহযোগিতা৷ কেননা শ্রমিক-মালিকের সমানাধিকার সমান মানবিক মর্যাদা নেই৷ কিন্তু প্রাউটের আদর্শে গঠিত সমবায়ে কার্যত কর্মী বা সদস্যদের সকলেরই থাকবে সমানাধিকার, সমান মানবিক মর্যাদা ও সমান আইনানুগ অধিকার৷ আলাদা ভাবে মালিক বলে কোনও মহাম্মন্যতার জায়গা থাকবে না৷ সবাই মালিক৷ ‘‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্ব৷’’ এখানকার যে সহযোগিতা তা হ’ল বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা৷ co-ordinated co-operation)৷ ফলে শ্রমিক-মালিক বিরোধ বা শ্রমিক শোষণ, অত্যাচার, বঞ্চনা চিরতরে শেষ হয়ে তা একটা আভিধানিক শব্দে পরিণত হবে৷

পরিশেষে এই সিদ্ধান্তে আসাই সঙ্গত যে প্রাউটের কৃষিনীতি কৃষিতন্ত্রের দশ দিগন্ত৷ (৩৬০০) আধারিত৷ ‘‘সমবায় পদ্ধতির সাহায্যে মানব সমাজ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলবে....জড়বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ঘটবে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন৷’’ (কণিকায় প্রাউট---২-৯২)৷