মহাপুরুষ স্মরণে

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

গত ১২ই জানুয়ারী বিভিন্ন ক্লাব, প্রতিষ্ঠান ও পার্টির পক্ষ থেকে সোৎসাহে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মোৎসব পালন করা হয়৷ বিভিন্ন নেতা–নেত্রী, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, অভিনেত্রী, শিল্পী, শিক্ষাবিদ্ এই সমস্ত অনুষ্ঠানে বত্তৃণতার ফুলঝুরি ছড়ান৷

কিন্তু মনে প্রশ্ণ জাগে শুধু এ করেই কি বিবেকানন্দর আর্দশকে আজকে যুব সমাজের মনে জাগরূক করা যাবে বর্তমানে রেওয়াজটাই তা–ই৷ মহাপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে খুব জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করা হয়৷ তাতেই আমরা মনে করি, মহাপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের দায়িত্ব আমরা যথাযথভাবেই পালন করছি৷

কিন্তু প্রকৃতই কি এভাবে যথার্থ দায়িত্ব পালন করা যায়? এভাবেই কি মহাপুরুষের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা যায়? অথচ আমরা এভাবেই স্বামীজীর–নেতাজীর জন্মোৎসব পালন করে পরম আত্মতৃপ্তি লাভ করি৷

স্বামীজী, নেতাজী –এঁরা চেয়েছিলেন আদর্শবান্ মানুষ গড়তে৷ তা তাঁরা তাদের বিভিন্ন বত্তৃণতায় ও রচনায় সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন৷ তাই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানটা বড় কথা নয়, বড় কথা তাঁদের আদর্শকে–তাঁদের স্বপ্ণকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত করার  জন্যে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রয়াস করা৷

নেতাজী তাঁর ‘তরুণের স্বপ্ণ’ বইতে বলেছেন, ‘‘আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে যে আদর্শ প্রেম ও আদর্শ নিষ্ঠার অভাব আছে–সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই এই ভাবদৈন্যের কারণ কী? কারণ এই যে, যাঁহারা আমাদের শিক্ষা দেন, তাঁহারা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হূদয়ে আদর্শের বীজ বপন করেন না৷...মানুষের প্রাণ যদি উদ্বুদ্ধ করিতে হয়....তাহার রক্তবিন্দুর মধ্যে যদি মৃত সঞ্জীবনী সুধা ঢ়ালিতে হয়, যদি তাহার অন্তর্নিহিত সমস্ত শক্তির স্ফূরণ ঘটাইতে হয় তাহা হইলে একটা মহত্তর আদর্শের আস্বাদ তাহাকে দেওয়া চাই৷......

সে আদর্শ কী–যাহার প্রেরণায় মানুষ অমৃতের সন্ধান পায়, বিপুল আনন্দের আস্বাদ পায়৷ সে আদর্শ কী যাহার পুণ্য পরশে দেশে দেশে যুগে যুগে মহাপুরুষ সৃষ্টি হইয়া থাকে?.... তোমরা যদি সেইরূপ চেষ্টা ও সাধনা কর তাহা হইলে তোমরাও একদিন মহাপুরুষের আসনে বসিতে পারিবে৷ তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে ভস্মাচ্ছাদিত বহ্ণির ন্যায় অসীম শক্তি আছে৷ সাধনায় সে ভস্মরাশি অপনীত হইবে ও অন্তরের দেবত্ব কোটি সূর্যের  উজ্জ্বলতার সহিত প্রকাশিত হইয়া মনুষ্য সমাজকে মুগ্ধ করিবে৷...’’

এই আদর্শের জ্বলন্ত অগ্নিশিখা যদি আমাদের মধ্যে জ্বালাতে পারি, তবে মহাপুরুষদের স্মৃতি–উৎসব পালন করা সার্থক, নইলে তা কেবল লোক দেখানো ব্যাপার হইবে৷ তা হবে একটা মস্ত বড় প্রবঞ্চনা–তা অন্যকেও যেমন প্রবঞ্চনা করা, নিজেকেও তেমনি প্রবঞ্চনা করা৷ এই আত্মপ্রবঞ্চনার পথ সার্বিক ধবংসের পথ৷

এখানে বলা বাহুল্য, স্বামী বিবেকানন্দ তো বটেই, বীর বিপ্লবী নেতাজী সুভাষচন্দ্র যে মহত্বের শীর্ষে দেশে উঠতে পেরেছিলেন, তার পেছনে ছিল সাধনা, সেবা ও ত্যাগের সুদীর্ঘ ইতিহাস৷ আর এটাও চরম সত্য যে সেই সাধনা, সেবা ও ত্যাগ একের সঙ্গে অন্যটা অচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত৷ এই সাধনা, সেবা ও ত্যাগকে উপেক্ষা করে কেউ মহত্ত্বের শীর্ষে আরোহণে সক্ষম হয় না৷

আজ যদি স্বামীজী বা নেতাজীর প্রতি যথার্থই শ্রদ্ধা জানাতে হয়, যদি তাঁদের আদর্শকে অনুসরণ করতে হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে এই সাধনা, সেবা ও ত্যাগের পথকেই অনুসরণ করতে হবে৷

আর স্বামীজী ও নেতাজীর জীবনীর দিকে আরও গভীরভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমরা এটাও সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাব যে, তাঁদের মহান কর্মধারার প্রেরণার উৎস ছিল কিন্তু তাঁদের গভীর আধ্যাত্মিক চেতনা৷ গভীর আধ্যাত্মিক চেতনা সঞ্জাত আধ্যাত্মিক অনুশীলনই তাঁদের হূদয়ে অফুরন্ত শক্তি, সেবা ও ত্যাগের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেছিল৷

সাম্প্রতিক কালে এই দুই মহাপুরুষদের স্মরণসভাগুলিতে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা ও বক্তারা সচেতনভাবে আধ্যাত্মিকতা তথা ঈশ্বর সাধনার কথা এড়িয়ে যান৷ এ যেন গাছের গোড়ায় জল দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করে বাগানের সৌন্দর্যায়নের নেশায় মত্ত হওয়া৷ কিন্তু জলের অভাবে ফুলগাছগুলো যখন ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে, তখন সমস্ত সৌন্দর্যায়নের প্রয়াস পণ্ড শ্রমে পরিণত হবে, এই সহজ সত্য কথাটা যেন কেউ না ভুলে যান৷