মনুষ্যত্ব লাভের দুঃসাধ্য সাধনাই নববর্ষকে সার্থক করতে পারে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

কালের গতিপ্রবাহে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল একটা বছর৷ আর একটা নতুন বছরের সামনে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি৷ এই যে কালের যাওয়া-আসা, মহাবিশ্ব প্রকৃতির এতে কোন হেলদোল নেই৷ সূর্যটাও আর পাঁচটা দিনের মতই পূব আকাশে উদয় হয়েছে৷ সেখানেও নতুনত্ব কিছু নেই৷ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত প্রতিদিনেরই ঘটনা৷ কাল যেখানে শেষ হয়েছে আজ তো সেখান থেকেই শুরু হয়েছে৷ যদিও আমাদের কাছে ধরিত্রী আজ নববর্ষের নব প্রভাতের আলোকে স্নাত৷ বিধাতার অমোঘ নিয়মেই পুরাতনকে সরিয়ে নতুনের আগমন৷ এর জন্যে কোন আইনের সংশোধন করতে হয়না৷ রক্তস্নাত হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না৷ শুধু আমাদের জীবন থেকে চলে গেল কিছুটা মূল্যবান সময়৷ যে সময়ের অনেকটাই আমরা বাজে কাজে অতিবাহিত করেছি৷ মানুষ পৃথিবীতে আসে খুবই অল্প সময়ের জন্যে৷ তার কাছে প্রতি ক্ষণ প্রতিটি মুহূর্ত্ত অতি মূল্যবান৷ সময়ের যথার্থ উপযোগ যেন আমরা গ্রহণ করি৷ বর্ষবরণের গুরুত্ব এতটুকুই৷

বিদায়ী বছরের শেষ কটা দিন বড় অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে দুঃসহ যাতনা দিয়ে গেল৷ সে যাতনার রেশ নববর্ষের নবপ্রভাতেও রয়ে গেল৷ দাম্ভিক শাসকের অনড় মনোভাব, মাটিহারা মানুষের জেদী প্রতিবাদ বছরের শেষ কটা দিন ধরণীকে রক্তস্নাত করে দিয়ে গেল৷ বিভাজনের আইন বিষবৃক্ষের বীজ রোপন করে দিয়ে গেল৷ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিল৷

মানুষের পক্ষে পুরাতনের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা এত সহজ নয়৷ তাই নববর্ষের নবপ্রভাতেও রয়ে গেল অজানা অন্ধকারের আতঙ্ক৷ স্পর্দ্ধিত মিথ্যা, শক্তির দম্ভ, স্বার্থলোভ  মোহান্ধ মানুষকে সভ্যতা বিমুখ করে দিচ্ছে৷ ক্ষুদ্র সংকীর্ণ ভেদ-বুদ্ধি নিয়ে মানুষ ঘুরে মরছে পাপের পঙ্কিল আবর্তে৷ সময়ের আবর্তনে বার্ষিক গতির মানসিক পরিমাপে নববর্ষ ফিরে আসবে হয়তো আবার কয়েকটা রক্তস্নাত দিন পেরিয়ে৷

তাই মানুষের জীবনে রাতের অন্ধকার সরিয়ে  নবপ্রভাতের আগমন এত সহজ হবে না৷ বিজ্ঞানের আকাশছোঁয়া অগ্রগতির সঙ্গে বেড়ে চলেছে মানুষের সীমাহীন লোভ ক্ষুধানল৷ সীমিত সম্পদের ওপর হামলে পড়েছে মানুষ অনন্ত বাসনা পূর্ত্তির এষণা নিয়ে৷ তারই বিষময় ফল স্বার্থের সংঘাত, হিংসার উৎসব৷ উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে মনুষ্যত্বহীন মানুষের ভদ্রবেশী বর্বরতার স্বরূপ৷ একবিংশ শতাব্দীর ঊণিশটা বছর পার করেও মানুষ তার নিজহস্তে রচিত মোহজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে পারেনি৷ গড়ে তুলতে পারেনি উদায় ঐক্যের মধ্যে রচিত সুসংহত মানব সমাজ৷

নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বিভাজন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, অসংসৃকতির তাণ্ডবে মনুষ্যমর্র্যাদা আজ পদে পদে ধুলুণ্ঠিত হচ্ছে৷ মূল্যবোধহীন এই সমাজে নববর্ষকে অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করে স্বার্থক করে তোলা সত্যিই বড় কঠিন৷

আশার কথা একটাই নববর্ষকে সার্থক করে গড়ে তোলার কাজ  কঠিন হলেও জটিল নয়৷ যিনি আমাদের মানুষ করে  এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তিনি আমাদের শক্তি দিয়েই পাঠিয়েছেন৷ শুধু একটার পর একটা দুয়ার ভেঙে, সকল বাধা-বিপত্তি বিদীর্ণ করে মুক্ত হতে হবে৷ মানুষ হয়ে যার জন্ম মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনাই তার কর্ম, তার ধর্ম৷ কবির কথায়---

‘‘....সাধনা করে তবে মানুষকে মানুষ হতে হয়---তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্রাণপন চেষ্টায় তবে মানুষ৷’’

আজকের পৃথিবীতে মানুষ হওয়ার সাধনায় রত হওয়া সত্যিই বড় দুষ্কর৷  মহাবিশ্বের সবকিছুর মধ্যে যিনি বিরাজ করছেন তাঁকে জানার তাঁকে উপলব্ধি করার তার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দেওয়াই জীবনের পরম লক্ষ্য৷ এই যে বছরটা কাল বিদায় নিয়েছে তার কতটুকু সময় আমরা সেই পরম লক্ষ্যের পানে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে ব্যয় করতে পেরেছি৷ স্থূল অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম আর অসংযত প্রবৃত্তির তাড়নায় জীবনের অনেকটা সময় অপচয় হয়ে যায়৷ মনুষত্বই হারিয়ে যায় স্থূল বাসনা পূর্ত্তি করতে গিয়ে৷ স্বার্থের সংঘাত, লোভের সংগ্রাম  শুধু পরম লক্ষ্যের কথা ভুলিয়েই দেয় না, পরম লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়৷ নববর্ষ মানব জীবনে তখনই সার্থক হয়ে উঠবে যখন প্রতিদিনের কর্মের মধ্যে দিয়ে সাধনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে পরম লক্ষ্যের দিকে৷

২০২০ নববর্ষের প্রথম প্রভাতে  আমাদের জীবনের ব্রত হোক মনুষ্যত্ব লাভের কঠোর সাধনায় রত হওয়া৷ শুধুমাত্র নিজের প্রয়োজনটুকুর স্বার্থে নয়, বিশ্ব মানবের কল্যাণের জন্যেই আমাদের মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হবে৷ তারজন্যে চাই সাধনা---জ্ঞানের সাধনা, কর্মের সাধনা, ভক্তির সাধনা৷ ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সেই সাধনার বিজ্ঞানসম্মত পথ দেখিয়েছেন, আদর্শ সমাজ ঘটনের সমস্ত রকম উপকরণও তিনি দিয়েছেন৷ আজ শুধু প্রয়োজন সেই পথে চলা, সেই কর্মে আত্মনিয়োগ করা৷ কত নববর্ষ এসেছে, আরও কত নববর্ষ আসবে৷ আসুন আজকের এই নববর্ষকে আমরা সার্থক করে তুলি মনুষ্যত্ব অর্জনের সাধনায় রত হওয়ার, আদর্শ সমাজ গঠনের কর্মে রত হওয়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করে তবেই নববর্ষের নব-প্রভাত আমাদের জীবনে সার্থক হয়ে উঠবে৷