নাম হোক বাঙালীস্তান

লেখক
উদয়ভানু গুপ্ত

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

‘‘বঙ্গ’’ শব্দের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা ঃ

‘বঙ্গ’ নামটির অর্থবহতা তার ভৌগোলিক বিস্তার ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও সীমিত৷ এ ব্যাপারে এ-পার বাঙলার চিন্তাবিদদের মতামত বামফ্রন্ট নেতাদের ভাব-ভাবনার ঠিক বিপরীত৷ ‘বঙ্গ’ শব্দটি প্রাচীন পঞ্চ-গৌড়ের (অর্থাৎ রাঢ়, বরেন্দ্রভূমি, সমতট বঙ্গ’ ও মিথিলা) একটি মাত্র ক্ষুদ্র ভূমিখণ্ডকে বোঝাত৷ অর্থাৎ আজ যা পূর্ববঙ্গের ঢাকা/ডাকা/ডবাক, মানিকগঞ্জ, গোয়াললন্দ, বিক্রমপুর, ভারতের কাছাড়, করিমগঞ্জ, ত্রিপুরা নামক নদীবহুল অঞ্চলগুলি রয়েছে সেই সীমিত অঞ্চল গুলিকেই অতীতে ‘বঙ্গ’ নামে অভিহিত করা হতো৷ কিন্তু ‘বঙ্গে’র বাইরেও পড়ে  আছে কয়েকগুন বড় বঙ্গ-ভাষাভাষী জনগণের বিস্তৃত বাসভূমি যাদের প্রাচীন নাম রাঢ়, বরেন্দ্র, সমতট ইত্যাদি৷ ‘বঙ্গ শব্দের এই ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে  এপার বাংলার ভাষাতত্ত্ববিদ্‌, ঐতিহাসিক ও প্রজ্ঞা পুরুষরা কে কী বলছেন সেটাও দেখা যাক৷

শ্রীসুনীতি কুমার চ্যাটার্জী ঃ ‘বঙ্গ’ দেশ বলিলে প্রাচীন কালে সাধারণভাবে মাত্র পূর্ব বঙ্গেরই কতকগুলি অঞ্চল বুঝাইত, সারা বাঙ্গালাদেশ নহে’’ (বাঙালীর সংস্কৃতি) ঃ)

ঐতিহাসিক শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার ঃ ‘‘প্রাচীন যুগে সমগ্র বাংলাদেশের  কোন একটি বিশিষ্ট নাম ছিল না৷ ইহার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল৷ উত্তরবঙ্গে ‘পুণ্ড’ ও ‘বরেন্দ্র’ (অথবা বরেন্দ্রী), পশ্চিমবঙ্গে ‘রাঢ়’ ও তাম্রলিপ্ত’ এবং দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে  ‘বঙ্গ’ ‘সমতট’.....প্রভৃতি দেশ ছিল৷

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্ত্তৃক বিদ্যানিধি যোগেশচন্দ্র রায় সংকলিত বাঙ্গালা শব্দকোষে ‘‘বঙ্গ’’ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করা হয়েছে নিম্নরূপঃ---‘‘বঙ্গ....ষ্য (স রঙ্গ)৷ রঙ্গ বা রাং ধাতু বঙ্গদেশ৷ (পূর্বকালে আধুনিক পূর্ববঙ্গ দেশ বুঝাইত’’৷)

সাহিত্য অকাদেমী প্রকাশিত বঙ্গীয় শব্দকোষের অভিমত ঃ ‘‘বঙ্গদেশ এই বঙ্গ দেশ পূর্ববঙ্গ’’

সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত বাঙ্গলা ভাষার অভিধান ‘‘বাঙ্গালাদেশ এখন যাহা পূর্ববঙ্গ বলিয়া উক্ত হয় পূর্বে তাহাই ‘বঙ্গ’ নামে অভিহিত ছিল৷’’

তাই ‘বঙ্গ’ নাম বাংলা ভাষাভাষী বিশাল বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চলের এক ক্ষুদ্র ভগ্ণাংশেরই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত পরিচিতি বহন করে মাত্র, সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী জনগণের বিশাল বিস্তৃত বসতি অঞ্চলগুলিকে নয়৷ অতএব ‘‘বঙ্গ’’ নামটি কোনভাবেই  পশ্চিমবঙ্গরে বিকল্প নাম রূপে গৃহীত হতে পারে না৷

‘‘বঙ্গ’’ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় ভাষাতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিক শ্রী পি.আর সরকার---

‘‘বরেন্দ্র ও সমতটের পূর্ব দিকে গৌড়দেশের অতিমাত্রায় যে নদীমাতৃক অংশ তার নাম ছিল বঙ্গ (ডবাক)৷... বঙ্গ শব্দের  অর্থমিহি বা পাতলা ধাতু৷ বঙ্গের উন্নতমানের কারিগরেরা ও স্বর্ণকারেরা খুব মিহি অলঙ্করণ প্রস্তুত করতে পারতেন বলে তাদের প্রশংসায় দেশটির নাম ‘বঙ্গ’ ( ঃ বঙ্গের এক সূচাগ্র ভূমিও আজকের  পশ্চিমবাংলায় নেই৷ তবে ত্রিপুরা, কাছাড়, করিমগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল সেই সুপ্রাচীন সুমহান বঙ্গের অংশ৷ আজকের কোন অতিপণ্ডিত যদি বর্ধমান-পুরুলিয়াকে অথবা নদীয়া ২৪ পরগণাকে অথবা জলপাইগুড়ি-বালুরঘাটকে ‘‘বঙ্গ’’ বলেন তাহলে সেটা বর্ধমান-পুরুলিয়াকে গুজরাট বলা, নদীয়া ২৪ পরগণাকে রাজস্থান বলা বহা জলপাইগুড়ি -বালুরঘাটকে পঞ্জাব বলারই সামিল হবে৷ কী হাস্যকর ব্যাপার৷’’

শ্রদ্ধেয় শ্রী সরকারের বক্তব্যের মর্মার্থ দাঁড়ায়---

l পশ্চিমবঙ্গের নাম শুধু ‘‘বঙ্গ’’ করাটা নিতান্ত হাস্যকর ব্যাপার!

l  কারণ আজকের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে  সেকালের ‘বঙ্গের’ কোন সম্পর্ক নেই৷

তাই ‘বঙ্গ’ নামকরণ ইতিহাস বিরোধী ও ভৌগোলিক ঐতিহ্য বিরোধী কাজ হবে৷