‘নীলকন্ঠ দিবস’-এর শপথ

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই,অতীতে যখনই কোন নূতন আবিষ্কার বা আদর্শ মানব সমাজের যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চেয়েছে তখনই সেই আদর্শের বিরোধিতায় যূথবদ্ধ হয়েছে সমস্ত অশুভ-শক্তি৷ পুরাতনের জীর্ণ কঙ্কালকে আঁকড়ে ধরে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দীর্র্ঘয়িত করার চক্রান্তে সামিল হয়েছে তারা৷ নূতনের বার্তাবহ,ধারক-বাহকের ওপর চলেছে অশেষ নির্যাতন, নিপীড়ন, প্রাণঘাতী অত্যাচার --- এমনকি নেমে এসেছে অকাল মৃত্যুর  নিষ্ঠুর আঘাত৷ গ্যালিলিও,সক্রেটিস, যীশুখ্রীষ্ট, হজরত মহম্মদ কিংবা  মহাসম্ভূতি সদাশিব ও শ্রীকৃষ্ণ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আনন্দমার্গ ও প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ক্ষেত্রেও৷ বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের সমাজ জাত-পাত, ধর্মমত, গোষ্ঠী সম্প্রদায়-ভেদে  শতধা বিভক্ত৷ এই বিভাজনের ফলে মানুষে মানুষে সংঘাত,গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ সমাজের ভিতকে ক্রমশঃ দুর্বল করে চলেছে আর  এর সুযোগ নিয়ে  দুর্নীতিবাজ  শোষকের দল মানব সমাজের চরম সর্বনাশ করতে উদ্যত৷ কোথাও বর্ণ বৈষম্য, কোথাও তথাকথিত  ধর্মমতের চূড়ান্ত আগ্রাসন,কোথাও দাম্ভিক রাষ্ট্র-নায়কের হুঙ্কার সমগ্র পৃথিবীকে  হিংসা ও সন্ত্রাসের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করেছে৷ লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল নর-নারী-শিশুর দল সহায় সম্বলহীন হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে বন-জঙ্গল,পাহাড়-পর্বত, দুস্তর মরু অঞ্চল, প্রতি মূহূর্তের মৃত্যুর হাতছানি দেওয়া উত্তাল তরঙ্গমালাধৃত জলধির বুকে ভেলা ভাসিয়ে--- শুধুমাত্র একটুকু নিরাপদ শান্তির আশ্রয়ের খোঁজে৷ একদিকে তথাকথিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্র্মন্ধদের আস্ফালন, অন্যদিকে পঁুজিবাদী-জড়বাদী আর্থিক-সামাজিক দর্শনের দুরভিসন্ধিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ, সমস্যা জর্জরিত৷  পার্থিব সম্পদের অসম বন্টনে মুষ্টিমেয় মানুষ সম্পদের চূড়ায় বসে  আমোদ-প্রমোদে মত্ত আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা, তৃষ্ণা, রোগভোগের তাড়নায় যন্ত্রনাক্লিষ্ট৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের  রণদামামা--- পারমাণবিক, রাসায়নিক  মারণাস্ত্রের বল্গাহীন প্রতিযোগিতা৷ আর একশ্রেণীর কপটাচারী দুর্নীতির ধবজাধারীরা শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে সদাব্যস্ত--- তাদের ভাবখানা এই, যে যা করে করুক , আমরা আমাদের আখের গোছাই যাতে আমাদের সন্তান-সন্ততি, নাতি-পুতিরা দুধে ভাতে থাকে সারাজীবন৷ অথচ কোটি কোটি মানুষ অনাহার , অপুষ্টি, দুর্ভিক্ষ, মহামারীর কবলে নিরুপায় হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী৷ অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কু-সংস্কার ও সর্বগ্রাসী ভয় তাদের নিত্যসঙ্গী৷ এই বিভিন্নমুখী সংঘাতের ফলশ্রুতিতে  সমগ্র মানব সমাজ  ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ক্রমশ ধবংসের  রসাতলে নিমজ্জমান৷

এই যুগসন্ধিক্ষণে আবির্ভূত হলেন মহাসম্ভূতি তারকব্রহ্ম  শ্রীশ্রী আনন্দমূর্তিজীওরফে শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তিনি লক্ষ্য করলেন , মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো কুসংস্কার,  ভাবজড়তা ও তথাকথিত ধর্মমত বা ইজ্মগুলির  গোঁড়ামি--- যার ফলে মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ, হানাহানি ও হিংসা-সন্ত্রাস৷  পৃথিবীতে যত ভয়ানক যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে তার বেশীরভাগেরই কারণ এই ধর্র্মন্ধতা ও অযৌক্তিক গোঁড়ামি৷ মানুষকে  এই অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যে প্রবর্তন করলেন সর্বানুসূ্যত আধ্যাত্মিক দর্শন আনন্দমার্গ৷ আনন্দমার্গের মূল বক্তব্য হলো প্রতিটি মানুষের ধর্ম এক৷ জলের ধর্ম যেমন ভিজিয়ে দেওয়া, আগুনের ধর্ম পুড়িয়ে দেওয়া, ঠিক তেমনি মানুষের ধর্মও অনন্ত সুখপ্রাপ্তি৷ প্রতিটি মানুষ সুখ পেতে চায় আর এই সুখ যখন অনন্তের দিকে ধাবিত হয়, তখন তাকে বলে আনন্দ৷ সুতরাং আনন্দপ্রাপ্তিই মানুষের একমাত্র ধর্ম আর প্রকৃত আনন্দ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার পথেই অর্জন করা সম্ভব৷ আনন্দমার্গের মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমগ্র সৃষ্টিই  পরমব্রহ্ম থেকে উৎসারিত--- একইভাবে প্রতিটি মানুষ ও জীব,জড়, উদ্ভিদ সবই পরমব্রহ্ম পরমপুরুষের সন্তান৷ তাই সকল মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টির  এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বেঁচে থাকার, আনন্দ পাওয়ার, এগিয়ে চলার সমান অধিকার রয়েছে আর এই অধিকার পরমপুরুষপ্রদত্ত৷ এই অধিকারকে খর্ব করার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি, বরং এই অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব সকলকেই নিতে হবে৷ পৃথিবীতে কেউ একাকী বেঁচে থাকতে পারে না৷ প্রতিটি ক্ষেত্রে জীবনধারণের উপকরণের জন্যে প্রত্যেক জীব, জড়, উদ্ভিদ ও মানুষকে অপরের উপরে নির্ভর করতেই হয়৷ মানুষ জল-হাওয়া-খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে না৷ তাই মানুষকে জড় পদার্থ জল হাওয়া ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ, শস্যরূপী উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর নির্ভর করতে হয়৷ একইভাবে অন্যান্য জীব, জড়, উদ্ভিদের প্রতি মানুষের কর্ত্তব্যও বর্র্তয়৷ এই  কর্তব্যবোধই নব্যমানবতাবাদের উৎস ও প্রেরণা৷ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের জলবায়ু ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে মানুষের গাত্রবর্ণ, উচ্চতা , দৈহিক গঠনে বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়৷ মূলতঃ প্রত্যেক মানুষেরই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ধূলিকণাতে  রয়েছে সমান অধিকার৷ পরমব্রহ্ম পরমপিতার সৃষ্টি সকল সত্তার  মধ্যে এই যে সমতাভাব ও সম অধিকার---এটিই হচ্ছে আনন্দমার্গ দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য৷ সেই কারণেই প্রতিটি মানুষের ধর্ম এক, উৎসও এক৷ কেউ কোনোভাবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করতে পারে না৷ কোন অজুহাতেই কেউ কারোর ওপর কোনরকম শোষণ বা বঞ্চনাকে চাপিয়ে দেওয়ারও অধিকারী নয়৷

মানুষের অস্তিত্ব ত্রিভৌমিক--- শারীরিক বা জাগতিক, মানসিক ও আত্মিক বা আধ্যাত্মিক৷ তাই মানবিক অস্তিত্বের সর্বাত্মক উন্নতির জন্যে জাগতিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক ত্রিবিধ উন্নতি একান্ত প্রয়োজন--- কোনটিকেই অবহেলা করা চলবে না, নচেৎ জৈবিক সন্তুলন ও সামঞ্জস্য বিঘ্নিত হতে  বাধ্য৷ মানুষের চাহিদা অনন্ত৷ এই অনন্ত চাহিদাকে সীমিত জাগতিক সম্পদে তৃপ্ত করা সম্ভব নয়৷ সেই কারণে জাগতিক সম্পদের চাহিদাকে নিয়ন্ত্রিত করে  অসীম মানসিক ও আধ্যাত্মিক জগতে পরিচালিত করতে পারলে অশান্ত মন শান্তির পথে অগ্রসর হবে৷ এই উদ্দেশ্যেই আনন্দমার্গ দর্শনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে  আধ্যাত্মিক সাধনা পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষের মনকে শান্ত ও নিবৃত্ত করার ব্যবস্থা যুক্ত হয়েছে৷ অপরপক্ষে  মানুষের জাগতিক ও ভৌতিক প্রয়োজনকে  সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তন করেছেন অর্থনৈতিক সামাজিক দর্শন ‘প্রাউট’ (ঞ্ঝট্টঞ্জড্ডট) বা প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব৷  প্রাউট দর্শনের মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল সম্পদের মালিক সৃষ্টিকর্র্ত পরমব্রহ্ম ও সমগ্র সম্পদে  সকলের ভোগদখলের সমান অধিকার রয়েছে৷ সৃষ্টিকর্র্ত কারোর নামে কোনো সম্পদের মালিকানা লিখে দেন নি৷  সুতরাং এই সম্পদকে যথোচিত পদ্ধতি অবলম্বন করে সর্র্বধিক উপযোগের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে৷ উপযুক্ত কারণ ও পরিস্থিতি ছাড়া কাউকে সঞ্চয় করার অধিকার দেওয়া যাবেনা৷ সীমিত সম্পদ যদি কেউ অত্যধিক সঞ্চয় করে তবে  অন্যদের বঞ্চনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই ভৌতিক সম্পদকে  সুষমবন্টনের মাধ্যমে  সকলের উপকারে লাগাতে হবে যাতে কেউ বঞ্চিত বা শোষিত না হয়৷

মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ সমাজের প্রতিটি মানুষের নূন্যতম প্রয়োজন পূর্তির সংস্থান  (অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা) অবশ্যই করতে হবে ও জাগতিক সম্পদকে  বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও মেধার ব্যবহারে আরও উন্নত করে এই নূ্যনতম মানকে প্রগতিশীলভাবে বর্ধিত করতে হবে৷ এই উদ্দেশ্যে প্রাউটের অর্থনীতি অনুযায়ী পৃথিবীর  সমস্ত অঞ্চলের স্থানীয় অর্থনীতিকে  কার্যকরী ও উন্নত করতে হবে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে৷  সেই ব্লকের খনিজ, বনজ, জলজ অন্যান্য প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদকে ভিত্তি করে পূর্ণ অর্থনৈতিক ও সুসংহত পরিকল্পনা গ্রহণ করে একশত শতাংশ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে৷  এরফলে প্রতিটি মানুষের ক্রয় ক্ষমতার নিশ্চিততা ও  তার ক্রমাগত বৃদ্ধি সম্ভব হবে৷ স্থানীয় স্তরে উৎপাদন, বন্টন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হবে সমবায় প্রথার মাধ্যমে যার মূলে থাকবে উৎপাদন সমবায়, উপভোক্তা সমবায় প্রভৃতি৷  এই প্রক্রিয়ায়  ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে শোষণ ও বঞ্চনার সম্ভাবনা সমূলে উৎপাটিত  হবে৷ সমাজের প্রাণ রস শোষণ করে যারা নিজেদের মৌড়সী পাট্টা বজায় রাখত সেই পরগাছাদের  কোন স্থান কোথাও থাকবে না৷ সমগ্র সমাজ ব্যবস্থার পরিচালনায় থাকবেন আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত , নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত, বলিষ্ঠ চারিত্রিক গুণবিশিষ্ট আপসহীন নীতিবাদী সদবিপ্র গোষ্ঠী৷ সুতরাং এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সুন্দর শোষণহীন, নব্যমানবতাবাদী সমাজ রচনা সম্ভব হবে৷

আনন্দমার্গের আধ্যাত্মিক সাধনা পদ্ধতিতে  বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল মানুষকে , নারীপুরুষ নির্বিশেষে,  সমান ধর্র্মচারণ অধিকার প্রদানের মাধ্যমে  তথাকথিত ধর্মমতাবলম্বী কুসংস্কারী ভণ্ডদের একাধিপত্য নষ্ট হয়ে যাবে৷ অন্যদিকে  প্রাউটের বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিবাদের ভিত্তিতে রচিত সমাজ ব্যবস্থার উত্থানে মানব জাতির রক্তচোষা পুঁজিবাদীর আর পশুত্বের প্রতিভূ  জড়বাদের প্রবক্তারা তাদের মৃত্যুর ঘন্টা শুণতে পেয়ে একযোগে আনন্দমার্গ ও প্রাউট দর্শনের বিরোধিতায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করে৷ মানব সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত আনন্দমার্গের বিশ্বব্যাপী সেবাকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার জন্যে হাজারে হাজারে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী -সন্ন্যাসিনীর দল সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েন৷  ভারতবর্ষেও বহুবিধ সেবা ও ত্রাণ  শিক্ষার বিস্তারে  বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়৷ এই বিশাল কর্মযজ্ঞকে রূপায়িত করার জন্যে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের কেন্দ্রীয় কার্র্যলয় পুরুলিয়ার গড় জয়পুর ব্লকের বাগলতায় প্রতিষ্ঠিত হয়, আনন্দনগর নামে৷ সেখানে সুকল, কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ছাত্রাবাস, অন্ধাশ্রম, কুষ্ঠাশ্রম, হাসপাতাল, অনাথাশ্রম, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতের  তথা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে অনগ্রসর অঞ্চলে পূর্ণ উদ্যমে সেবাকাজ চলতে থাকে ও এইসব কার্যক্রম বিপুল সংখ্যায় জনসমর্থন লাভ করে৷ এসব দেখে শয়তানের দলও নিশ্চুপ বসে ছিল না৷ দুবৃর্ত্তদের চক্রান্তে ১৯৬৭সালের ৫ইমার্চ আনন্দমার্গের কেন্দ্রীয় আশ্রম আনন্দনগরে হামলা চালিয়ে ৫জন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীকে হত্যা করা হয় ও সমগ্র সেবাকার্যের কেন্দ্রবিন্দু ভবনগুলিকে গুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়৷ আনন্দমার্গীরা এই আক্রমণে ভীত না হয়ে আবার নব উদ্দীপনায় সেবাকার্য পরিচালনার কাজে নেবে পড়েন৷ বহুবিধ আক্রমণ, নির্যাতন, গুপ্ত হত্যা, মামলা মোকদ্দমায়  আনন্দমার্গকে বিপর্যস্ত ও বিব্রত করেও কিছুতেই তার অগ্রগতিকে রোধ করতে পারে নি শোষকশ্রেণী ও পঁুজিবাদী -জড়বাদী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মিলিত চক্র৷ 

এরপর  তাদের লক্ষ্য হন সংঘের প্রাণপুরুষ আনন্দমার্গের প্রতিষ্ঠাতা মার্গগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ওরফে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ ১৯৬৯ সালে কোচবিহার  ধর্মমহাচক্রের সময় তাঁকে প্রথমবার মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়৷ আবার ১৯৭১ সালেও একইভাবে রাঁচীতে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়৷ এই দুইক্ষেত্রে তাঁকে বেশিদিন কারান্তরালে  আটকে রাখা যায়নি৷  শেষ পর্যন্ত সমস্ত আট-ঘাট বেঁধে  সিবিআইয়ের মাধ্যমে চরম আঘাত আসে  ১৯৭১ সালেরই  ২৯শে ডিসেম্বর৷ সেই সময় বারাণসী ধর্মমহাচক্রের আগে তাঁকে পটনার পাটলীপুত্র কলোনীর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়৷ দিনের পর দিন,  মাসের পর মাস বিভিন্ন জেলে চলে তার উপর  অকথ্য অত্যাচার নিপীড়ন ও নির্র্যতন৷ দুঃসহ নরক যন্ত্রণার মধ্যে তাঁর এই কারাবাসের দিনগুলি অতিবাহিত হচ্ছিল৷ তারপর এল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় সেই দিন৷ ১৯৭৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারী  বাঁকিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে  রাত্রি ১১টার সময় সিবিআই অফিসারেরা  ডাক্তারের ছদ্মবেশে মার্গগুরুকে ঔষধের নামে বিষ প্রয়োগ করে৷ ঔষধটি খাবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন ও  পরের দিন সকাল ৭টা নাগাদ তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে৷ বিষপ্রয়োগের ফলে তিনি তখন পাঁচ রকমের প্রতিক্রিয়ায় ভুগছিলেন---

১) সারা শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতাবোধ৷

২) সারা শরীরে স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া৷

৩) দুই চোখ দিয়ে প্রচুর পরিমাণে জল গড়ানো৷

৪) মস্তিষ্কে দারুণ যন্ত্রনাবোধ৷

৫) মস্তিষ্কের নিষ্ক্রিয়তাবোধ৷

তিনি এই বিষপ্রয়োগের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী জানান৷ কিন্তু সরকার পক্ষ তাঁর কোনো দাবীকে আমল দেয় নি৷ সমগ্র পৃথিবীর আনন্দমার্গীগণ, সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবি ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা বিভিন্নভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানান৷  মার্গগুরুর ওপর পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বহু মার্গী সন্ন্যাসী আত্মাহুতির পথ বেছে নেন৷ সরকার পক্ষ তাঁর দাবী না মানায় শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ১৯৭৩ সালের ১লা এপ্রিল থেকে অনশন শুরু করেন যা চলে ১৯৭৮ সালের  ২রা আগষ্ট পর্যন্ত (৫বছর ৪মাস ১দিন যা পৃথিবীর বুকে একটি রেকর্ড) যেদিন পটনা  হাইকোর্টের রায়ে তিনি নির্র্দেষ প্রমাণিত হন৷  তাঁর বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত, মিথ্যা ও মসিষ্ক প্রসূত ষড়যন্ত্রমূলক৷ তাই সেগুলোকে খারিজ করে দেওয়া হয় ও তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হয়৷ এই ঘটনার পূর্বে ও পরে আরও বহু অত্যাচার উৎপীড়ন নির্যাতন  আনন্দমার্গের বুকে নেবে এসেছে৷ ১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল কলকাতার বিজন সেতু বণ্ডেল গেট অঞ্চলে আনন্দমার্গের ১৭জন সন্ন্যাসী- সন্ন্যাসিনীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে৷ এতদ সত্ত্বেও আনন্দমার্গের বিজয়রথ সমানে এগিয়ে চলেছে৷

শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী নিজ ঐশী শক্তি  প্রয়োগে মানবতার শত্রু, দুষ্ট, কুচক্রী, শয়তানদের দেওয়া বিষ গলাধঃকরণ করে নীলকন্ঠ হয়ে ৫বছর ৪ মাস ১দিন ঐতিহাসিক অনশন করে ও বহু নির্যাতন সহ্য করেও মানবজাতির তথা সমগ্র সৃষ্টির কল্যাণে তাঁর বিশাল কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন তাঁরই লক্ষ লক্ষ অনুগামীদের মাধ্যমে সাধনা সেবা ও ত্যাগের আদর্শে৷  বিশ্বের লক্ষ লক্ষ আনন্দমার্গী ১২ই ফেব্রয়ারী দিনটিকে ‘‘নীলকন্ঠ দিবস’’ হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেন ও  সত্য ধর্ম প্রতিষ্ঠার, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার, ভূলুন্ঠিত মানবতা রক্ষার শপথ গ্রহণ করেন৷ তাই এই পবিত্র দিনে সমগ্র বিশ্বের সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন ধার্মিক সত্যাশ্রয়ী  মানুষের কাছে আহ্বান জানাই যেন সকলে মিলে আনন্দমার্গ, প্রাউট ও নব্যমানবতার আদর্শে উদ্বোধিত হয়ে এক সুন্দর শোষণহীন সকলের বাসযোগ্য নোতুন পৃথিবী রচনা করি৷