নিন্দাবাদের বৃন্দাবনে বাঙাল

লেখক
একর্ষি

পূর্বপ্রকাশিতের পর

বাঙালী চরিত্রের মুণ্ডুপাত তো এক ধরণের ‘হননচরিত ইতিহাস৷’ সে চরিত ইতিহাসকে সামনে রেখেই মন্তব্য গুলো হয়েছে৷ কিন্তু কারা বলছে, কেন বলছে, তাদের উদ্দেশ্য কী যাচাই কেউই করেননি৷ একবার কলঙ্ক রটিয়ে দিতে পারলেই হল৷ তাহলেই কিস্তিমাত, কেল্লাফতে৷ ওই যে একটা বহুল প্রচলিত বিশ্বাসঘাতী কথা---যা কিছু রটে, কিছু কিছু তো বটে!---তাঁরা একেই শিরোধার্য করেছেন৷ তবে ধান ভানতে শিবের গীতের মত শোনালেও এ প্রসঙ্গে ‘‘সাবল্টার্ণ থিয়োরীর প্রচারক ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহের বক্তব্যটি স্মরণ করা যেতে পারে৷ তাঁর কথায় বর্তমান‘‘ইতিহাসবিদ্যার জন্ম এ দেশে ইংরেজ রাজশক্তির ঔরসে ও ভূমিষ্ট হবার পর থেকেই তা ঔপনিবেশিক শাসনদণ্ডকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে৷ যাঁরা এই ধারায় প্রথম ইতিহাস লেখেন তাঁরা সকলেই হয় সরকারী কর্মচারী কিংবা সরকারের প্রসাদপুষ্ট ও ইংরেজ শাসনের সমর্থক বেসরকারী সাহেব মোসাহেব---উদ্দেশ্য হয় একেবারে সরাসরি শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন সিদ্ধ করা কিংবা বেসরকারি রচনা হলেও কার্যত তার সাহায্যে ব্রিটিশ প্রভুশক্তি ও প্রভুসংস্কৃতিকে আরো জোরদার করা৷ এমন কী এইসব লেখকরা যখন অতীত বিষয়ক বক্তব্যগুলি রিপোর্ট, মিনিট বা ওই জাতীয় সরকারী নথি হিসেবে না লিখে নিছক ইতিহাস হিসেবেই লেখেন তখনও বিজেতা ও শাসকের দৃষ্টির কাছে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সংকুচিত হয়৷’’

ব্রিটিশ ভারতের প্রেক্ষাপটে ড. গুহের পর্যবেক্ষণ মোটামুটি ১৭৬০ সালের পর থেকে৷ প্রকৃত রহস্য খুঁজতে হলে আমাদের আরো পিছনে হাঁটতে হবে৷ বাঙালীর জাতিসত্তায় আঘাত তথা বাঙালীত্বকে পেষাই শুরু হয় খ্রীষ্ট্রিয় একাদশ শতাব্দী থেকে৷ আরো শুরু হয় আর্যাবর্তের আর্যামি ও দ্বাদশ-ত্রয়োদশ থেকে চলে আরবীয়করণ৷ ব্রিটিশের শাসন কালের মতই তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর শাসনাধীনে বাঙলায় সামরিক-ভাষা,ধর্মমত, সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করতে বাঙালীর মনোবল-নৈতিকবল-প্রতিবাদীশক্তি মননসামর্থ ধবংস করতে  চরিত্র হনন করে হীনমন্যতা ঢোকাতে তৎপর ছিল৷ সে হিসাব তো সমালোচকেরা করেনি৷ পরদেশী ভিনগোষ্ঠীর শাসকের কলঙ্কচর্চিত পিণ্ডী গিলে তাঁরা অম্লোদগীরণ করেছেন৷

বাঙালীর এই দশদশা তথা দশকলা সামনে রেখে দেখা যাক বাঙালীর চিরবিদ্রোহী স্বভাবধর্মে আতঙ্কিত বাঙালী বিদ্বেষীদের বিজাতীয় রঙিন চশমা পরে নামজাদা বাঙালী বিদ্বৎজনেরা স্বজাতি সম্বন্ধে কী বলছেন৷

একজন প্রখ্যাত বাঙালী ঐতিহাসিকের চোখে--- বাঙালীর বৃত্তি  যথার্থতঃ বৈতসী...

১) হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়লুতা, চরিত্রবলের অভাব...৷ হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্রিয়লুতাই বাঙালীর সৃষ্টি, প্রতিভার মূল, ইহারাই তাহার শক্তি, ইহারাই আবার তাহার দুর্বলতাও...প্রাচীন বাঙালীর সৃষ্টির ধারায় গভীর মনন, প্রশস্ত ভাবনা- কল্পনার অভাব৷

২) বাঙালীর ও বাঙলাদেশের যে সর্বব্যাপী মহতী বিনষ্টির সম্মুখীন হয়েছিল সেই পরাধীনতা ও  বিনষ্টির হাত থেকে বাঁচিতে হলে যে চরিত্রবল, যে সমাজশক্তি ও সুদৃঢ় প্রতিরোধ থাকা প্রয়োজন সমসাময়িক বাঙালীর তাহা ছিল না৷

৩) সমাজের চরিত্র শিথিল,ব্যাপক সামাজিক দুর্নীতি,---তখন রাষ্ট্রে,ধর্মে শিল্পে, সাহিত্যে, দৈনন্দিন জীবনে যৌন অনাচার, নির্লজ্জ কামপরায়ণতা, মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, রুচিতারল্য ও অলংঙ্কারবাহুল্যের বিস্তার৷

৪) সমাজের উচ্চস্তরগুলি একান্তভাবে ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন.... সে দৃষ্টি রক্ষণশীল ও চলচ্ছক্তি হীন৷

৫) সে সমাজ একান্তই ভাগ্য, অর্থাৎ জ্যোতিষ নির্ভর... সেই হেতু সমাজে প্রতিরোধের ইচ্ছা শক্তি অত্যন্ত শিথিল৷

৬) গুহ্য, গোপন, রহস্যময়...গোষ্ঠীর প্রভাবে সমাজে ধর্মের নামে ব্যাভিচার, অসামাজিক কাজকর্ম---সমাজকে ভিতরে ভিতরে পঙ্গু ও দুর্বল করে দিয়েছিল৷

৭) সমাজের নিম্নতর কৃষিজীবী স্তরগুলি একান্ত অবজ্ঞাত, হতচেতন ও সংকীর্ণ৷

মান্যবর ঐতিহাসিক উপরের নেতিবাচক দিকগুলো বাঙালীর স্বভাবগত কিনা তা যাচাই করেননি৷ অবশ্য এই সঙ্গে তিনি বাঙালী চরিত্রের কতগুলো আশাব্যাঞ্জক সংবেদী বৈশিষ্ট্যের কথাও শুনিয়েছেন---

৮) ওর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন শক্তি ছিল৷ সে শক্তি মানবতার ও সাম্যভাবনার শক্তি৷

৯) ভূমিনির্ভর, কৃষিনির্ভর সমাজের স্থায়িত্বের দৃঢ়তা দিয়েছিল৷

১০) শক্তিধর্মের প্রতি বাঙালীর ক্রমবর্দ্ধমান আকর্ষন৷

১১) সৃজ্যমান বাংলা ভাষা৷

১২) ঘাত-প্রতিঘাত, দান-গ্রহণ, সমন্বয় ও সাঙ্গীকরণের  বিবর্তন... (ক্রমশঃ)