নির্মল পৃথিবীর সন্ধানে

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

 পৃথিবীতে কেউ কখনো বলে না,--- মনটা ভালো নেই, শরীরের জোরে কাজ করছি৷ কিন্তু একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়--- শরীরটা ভাল নেই, মনের জোরে কাজ করছি৷৷ কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মানুষ তার শরীরটা নিয়ে যতটা যত্নশীল, তার এক শতাংশও মনকে নিয়ে নয় শরীরকে সুস্থ-সবল রাখতে, শরীরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে , শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে  মানুষের সারাদিনের সিংহভাগ সময় কেটে যায়৷ কিন্তু মানুষ বোঝে না সে মন প্রধান জীব, শারীরিক চাহিদার মধ্যে দিয়ে সে মনকে তৃপ্ত করতে চায়৷ কিন্তু সীমিত শারীরিক চাহিদায় মন  তৃপ্ত হয় না৷ কারণ মানুষের মন চায় অসীম অন্তকে৷ প্রার্থিব জগতের কোন কিছুতেই যার পূর্তি সম্ভব নয়৷ তাই মানব মনের স্বাভাবিক গতি অসীম অনন্তের দিকে৷ কিন্তু অজ্ঞ মানুষ শুধু শরীরের চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত থাকে সীমিত সম্পদ নিয়ে৷ শরীরের এই চাহিদাগুলো মেটাতে গিয়ে মানুষের মন হয়ে যাচ্ছে সংকীর্ণ স্বার্থপর, হিংস্র দূষিত৷ আজকের সমাজের সর্বস্তরে যে অন্যায় অবিচার, দুর্নীতি, স্বার্থের সংঘাত তার আসল কারণ এটাই৷ প্রভাত সঙ্গীতের ভাষায় ‘‘মানুষ মানুষ হারায় হুঁস কোথায় চলেছ  তুমি, আকাশ সাগর বিষিয়ে দিয়ে  নরক করে মর্ত্যভূমি৷’’

মানুষের মনুষ্যোচিত আচরণ ও মানবিক ব্যবহার বর্তমান সমাজে খুবই দুর্লভ৷ এমন এমন নৃশংস বর্বরোচিত ঘটনা ঘটছে যাতে মানুষের  সঙ্গে পশুর পার্থক্য করাটা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে উঠছে৷ এমনকি সন্তান-সন্ততির সঙ্গে পিতা-মাতার যে স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক সেটাও বিষিয়ে গিয়ে কখনো কখনো নৃশংস রূপ ধারণ করছে৷

এই মূহূর্তে মহা সংক্রমণ ব্যধিতে আক্রান্ত পৃথিবীর মানুষ৷ এর থেকে পরিত্রাণ পেতে বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে আবদ্ধ, ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলতে৷

কিন্তু এইভাবে আর কতদিন! প্লেগ! ইনফ্লুয়েঞ্জা, স্মলপক্স, কলেরা একের পর এক মারণ ভাইরাস আসতেই থাকে৷ কোভিড-১৯ও একদিন বিজ্ঞানের নিয়ন্ত্রণে আসবে৷ কিন্তু তারপর ? আর একটা মারন ভাইরাসের জন্য অপেক্ষা করা৷

করোনাভাইরাস শুধু দৈহিক আক্রমণে থেমে থাকেনি, ব্যষ্টি মানুষের মানসিক ও সমষ্টির সামাজিক পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে৷ মানুষ হতাশা ও মানসিক অবসাদে ভুগছে৷ কাল  করোনা যদি নিয়ন্ত্রণে আসে তবুও এই মানসিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান সহজে আর হবে না৷

এই সমস্যা সমাধানের একটাই রাস্তা, মানুষের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে৷ মানুষকে বুঝতে হবে যে সে মন প্রধান জীব, আর পাঁচটা পশুর মত সে নয়৷ মানুষের  ভাবনা চিন্তায় যে বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটেছে সেটা আর কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে হয়নি৷ তাই মানুষ শুধু দুটো হাত দুটো পা নিয়ে জন্মালেই মানুষ নয়৷ দেহ মন আত্মার সমন্বয়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে৷ মানুষকে  দেহের প্রতি যতোটা যত্নশীল হতে হবে, তার চেয়েও বেশি মনের অনুশীলনের যত্ন নিতে হবে, আরও বেশি করে নিতে হবে  তার আধ্যাত্মিক চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য৷ ঋষি অরবিন্দ বলেছেন---‘‘আজ বহিঃ প্রকৃতির ঐশ্বর্যের বিপুল দানে যখন ভরে উঠেছে মানুষের অঞ্জলি, তখনও তার প্রাণের গহনে কোথায় বেজে চলেছে এক অতৃপ্ত হাহাকার৷ আলো চাই, স্বাতন্ত্র্য চাই, চাই অমৃততত্ত্বের অধিকার, চাই দিব্য জীবনের ভাস্বর মহিমা৷ এই অভিপ্সা নিয়ে যেমন মানুষের যাত্রা শুরু তেমনি এর চরিতার্থ-তাতেই তার ইতি৷ এরচেয়ে বৃহত্তর কামনা তার মনেরও অগোচর৷’’

মানুষ তার মনের এই স্বাভাবিক কামনার কথা ভুলে শুধুমাত্র দৈহিক সুখের আশায় দিশাহীনভাবে ছুটে চলেছে বহিঃ প্রকৃতির সীমিত সম্পদের দিকে৷ আজ সমস্ত প্রকার দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ব্যাধির মূল কারণ এটাই৷ তাই শুধু করোনার ভ্যাকসিন নয়, মানুষের জীবন ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের পথ ধরে৷ বিশ্ব কবির  কথায়---‘‘সাধনা করে তবে মানুষকে মানুষ হতে হয়, তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ৷’’ সেই মানুষ হওয়ার সাধনায়  মগ্ণ হতে হবে মানুষকে৷ এই বোধ মানুষের মধ্যে আনতেই হবে৷

আজ প্রাচীন ভারতের প্রজ্ঞার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে জাগাতে হবে নতুন চেতনা, তবেই গড়ে উঠবে আদর্শ জীবন, আদর্শ সমাজ৷ জগতের কর্মের মধ্যে দিয়ে,কল্যাণের মধ্যে দিয়ে মানুষকে হতে হবে দিব্য স্বরূপের পথের যাত্রী৷ সেটাই হবে মানুষের জীবন আদর্শ৷ এই বৈপ্লবিক জীবনাদর্শের পথই আনন্দমার্গের পথ৷ আনন্দমার্গের এই জীবন আদর্শের সারকথা হলো---নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে, সাধনার দ্বারা, সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা মানুষকে এগিয়ে চলতে হবে দিব্য স্বরূপের দিকে৷ তবেই মানুষ সর্বগ্লানিমুক্ত,  সর্বকলুষ মুক্ত, সর্ব শোষণমুক্ত এক নির্মল পৃথিবীর  বাসিন্দা হবে৷