প্রাউটের দৃষ্টিতে গ্রামোন্নয়ন

লেখক
একর্ষি

‘‘বাণিজ্যে  বসতি লক্ষ্মী’’–এই প্রবাদ বাক্যটি দিয়েই মূল প্রসঙ্গে আসা যাক৷ ভারতীয় ‘‘দেব–দেবী ভাবনায় ‘লক্ষ্মী’ হ’ল ধনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী৷ কিন্তু যেখানেই ‘ধন’ সেখানেই অর্থের কেন্দ্রীকরণ৷ অর্থ এক জায়গায় সঞ্চিত অথবা এক বা মুষ্টিমেয় মানুষের কুক্ষীগত না হলে ধন সৃষ্টি হয় না৷ পুঁজিপতি হওয়া যায় না৷ অতিরিক্ত ধন বা পুঁজি কেন্দ্রীকরণ হলেই বঞ্চনা শোষণের ক্ষেত্র তৈরী হয়৷ আবার বাণিজ্যে ধনাগম মানেই মুনাফামুখী অর্থনৈতিক ক্রিয়া–কলাপ৷ সর্বাধিক মুনাফা যেখানে লক্ষ্য, সেখানে শোষণ–বঞ্চনার ক্ষেত্র তৈরী হয়৷ কেননা জনস্বার্থ এক্ষেত্রে  উপেক্ষিতই থেকে যায়৷ কাজেই মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ কাম্য হলে অর্থ–মুনাফার কেন্দ্রীয়করণ নয়, চাই বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা৷ অর্থাৎ বিশ্বের সবাই এক বিশ্বস্রষ্টা পরমপিতমার সন্তান–এই ভাবে পৈতৃক সম্পত্তির মত প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে সম্পদের যুক্তিসঙ্গত  বন্টন, বা উৎপাদিত সম্পদের লভ্যাংশ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত সবার মধ্যে যুক্তিসঙ্গত ভাবে বন্টন করে দেওয়া৷ ফলে এক বা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষীগত হবার কোন সুযোগই থাকবে না৷ সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নাম অর্থনৈতিক গণতন্ত্র৷ অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ভিন্ন পল্লী উন্নয়ন একটি বাগাড়ম্বর সর্বস্ব আভিধানিক শব্দ মাত্র৷

প্রশ্ণ হ’ল বিকেন্দ্রীকরণ বা অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের সূচনা হবে কোথা থেকে কীভাবে? শুরু করতে হবে ব্লক (উপভুক্তি) থেকে৷ ব্লকভিত্তিক ও আন্তর্ব্লক পরিকল্পনাই হবে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রথম সোপান৷  ব্লকের প্রশাসনিক কেন্দ্র (হেড–কোয়ার্টার)কে ঘিরে থাকা গ্রামগুলি নিয়ে তৈরী এক একটি অর্থনৈতিক এলাকা৷ প্রতিটি উপভুক্তি (ব্লক) সমৃদ্ধ–সচ্ছ্বল অর্থনৈতিক ইউনিট হিসাবে গড়ে উঠবে৷ তবে একটা কথা, এক–একটি ব্লক অন্য ব্লকে থেকে অর্থনীতির উৎস বা উৎপাদন উৎস বিচারে অল্প হলে স্বতন্ত্র৷ অর্থাৎ প্রাকৃতিক জলনির্গমণ প্রণালী, ভূমি বৈশিষ্ট্য, মৃত্তিকার উপাদান, প্রাকৃতিক সম্পদ মিল থাকলেও অভেদ চরিত্রের (আইডেনটিক্যাল/Identical) নয়৷ আবার অনেকগুলি সম্পদ একাধিক ব্লক জুড়ে বিন্যস্ত৷ এমনও দেখা যায় একই গ্রামের পূর্ব মাঠে যা ভাল হয়, পশ্চিম মাঠে সে ফসল হয়ই না৷ তাই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে ব্লকস্তর থেকে৷ ব্লক স্তর থেকে জেলা স্তর৷ জেলা স্তর থেকে রাজ্য স্তর (স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল)৷ রাজ্যস্তর থেকে রাষ্ট্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় স্তর৷ তারপর গ্লোবাল  স্তর পর্যন্ত (বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠার পর)৷ অর্থাৎ পরিকল্পনা (রচিত হবে) উঠে আসবে নীচ থেকে উপর দিকে৷ উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া চলবে না৷ সংশ্লিষ্ট ব্লক–পরিকল্পনা তার সংশ্লিষ্ট  অর্থনৈতিক অঞ্চলের Economic Zone)–এর সঙ্গে  সামঞ্জস্য বজায় রেখে রূপায়িত হবে৷ তাত্ত্বিক পরিভাষায় একে বলা হয়–‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা করা Universal in spirit but regional in approach.)৷

প্রাউটের ব্লকভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় উৎপাদন  ব্যবস্থা কয়েকটি নির্ণায়ক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত৷ যথা–

(১) উৎপাদন ব্যয় ঃ–কৃষিকে সুসংঘটিত শিল্পের মর্যাদা দিয়ে শিল্প দ্রব্যের মত কৃষি পণ্যেরও মূল্য নির্ধারণ করতে হবে৷ লক্ষ্য থাকবে কৃষি পণ্যের উৎপাদন ব্যয় তার বাজার দরের চেয়ে কোন ক্রমেই বেশী না হয়৷

(২) উৎপাদন ক্ষমতা ঃ– সংশ্লিষ্ট সামাজিক অর্থনৈতিক ইউনিটের চাহিদা ও সামর্থ্যকে বিচার করে সর্বাধিক উৎপাদন করা৷ অর্থাৎ পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে উপভোগের লক্ষ্যে উৎপাদন বৃদ্ধি করা৷ এই নীতিতে ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে ও বিনিয়োগযোগ্য মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে ক্রমবর্ধমান হারে৷

(৩) ক্রয়ক্ষমতা ঃ– মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে যেতে হবে৷ এই জন্যে (ক) মানুষের সামূহিক প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত সামগ্রীর যোগান দিয়ে যেতে হবে৷ (খ) ভোগ্যপণ্যের বাজারদর বেঁধে দিতে হবে৷ (গ) মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে হবে৷ (ঘ) ক্রমবর্দ্ধমান হারে কর্মীদের মাসিক আয় ও মজুরী মাঝে মাঝে বাড়িয়ে যেতে হবে৷ (ঙ) সামূহিক সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে যেতে হবে৷

(৪) সামূহিক প্রয়োজন ঃ–সামূহিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পনা রচনা করতে হবে৷

ব্লকের সার্বিক উন্নয়ন সংক্রান্ত যে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে তা হ’ল (ক) প্রচলিত রাজনৈতিক বিভাগ–ব্লক স্বয়ম্ভরতায় অপূর্ণ হলে ব্লকের স্বার্থে ব্লক পুনর্গঠন করতে হবে৷ (খ) বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী উপত্যকা পরিকল্পনা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা, বনসর্জন, আর্থিক উন্নতির পরিবেশগত প্রভাব, বড় শিল্প স্থাপন৷ ভূমিক্ষয় রোধ, জল সরবরাহ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে লক্ষ্য রেখে আন্তর্ব্লক পরিকল্পনা রচনা করতে হবে৷ (গ) ব্লকগুলির সীমানা নির্দ্ধারণ করার ভিত্তি হবে (১) ভূপ্রকৃতি ও নদী উপত্যকা, (২) জলাশয়, (৩) ভূমির ঢাল (৪) স্থানীয় মৃত্তিকার প্রকৃতি (৫) সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের সামাজিক–র্থনৈতিক প্রয়োজন ও সমস্যা (৬) এলাকার পশু–পক্ষী ও উদ্ভিদ (৭) এলাকার মানুষের শারীরিক, সামাজিক আশা–আকাঙক্ষা প্রভৃতি সুষ্ঠু বিকেন্দ্রিকৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্যে এই বিজ্ঞানসম্মত ব্লক সীমানা নির্দ্ধারক তত্ত্বগুলিকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করতে হবে৷

 গ্রামে গাঁথা বাঙলা তথা ভারতবর্ষ৷ কাজেই গ্রাম বাঙলার ব্লক উন্নয়নে যথাযথ তথ্য ও বাস্তব সত্যকে বিবেচনায় রাখতে হবে৷ যথা (১) একদা বাঙলায় ছিল সন্তুলিত (balance) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা৷ মোটামুটি জনসংখ্যার ৪০ ভাগ ছিল  কৃষির সঙ্গে যুক্ত৷ ৪০ ভাগ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আর বাকি ২০ভাগ ব্যবসাদি অন্যান্য পেশায়৷ কিন্তু ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ১০ বৎসরের মধ্যে বেনিয়া ইংরেজ সব শিল্প ধবংস করে দেয়৷ ফলে শিল্পের মানুষগুলো অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে কৃষিতে ভীড় করে৷ সেই হার আজো বজায় আছে৷ তাই কৃষিতে নিযুক্ত বাড়তি ৩০–৪০ভাগ মানুষকে কৃষি থেকে সরিয়ে কৃষিভিত্তিক ও কৃষিসহায়ক শিল্প ও অন্যান্য শিল্পে নিয়োগ করতে হবে৷ এটা ব্যালান্স ইকোনমিরই সারণ সত্য৷ মোট কথা ব্লকের উন্নয়ন করতে হলে কৃষি ও শিল্পের সমান্তরাল বিকাশ করতে হবে৷ উৎপাদন বাড়াতে হবে৷ গ্রামীণ উৎপাদন বলতে  প্রথমেই আসে কৃষি উৎপাদনের কথা৷ কৃষি  উৎপাদন বাড়াতে গেলে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করতে হবে৷ এরজন্যে চাই (ক) আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার৷ (খ) জমির ও সময়ের সর্বাধিক উপযোগ৷ এই শর্ত দুটি পূরণ করতে গেলে চাষের পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে৷ পদ্ধতি হবে দুধরণের (১) মালিকানাগত (২) প্রয়োগগত৷ আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ ব্যয়বহুল যা সাধারণ চাষীদের পক্ষে বহন করা কষ্টসাধ্য৷ আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোতে আধুনিক প্রথায় চাষ সম্ভব নয়৷ কিন্তু ছোট ছোট জোতগুলি একত্রিত করে কৃষি সমবায় গঠন করলে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষের যুক্তিসঙ্গত আয়তনের জমি পাওয়া যাবে৷ আবার সকল সদস্যের মিলিত সামর্থ্যে ব্যয় ভার বহন করাও সহজ হবে৷ এই সঙ্গে ক্রয়–বিক্রয় ব্যবস্থাও সমবায়ের মাধ্যমে হলে উৎপাদক ও ভোক্তা সকলের জন্যে ন্যায্য মূল্যের ব্যাপারটা সুনিশ্চিত হবে৷ ফড়ে, দালাল, মহাজনদের শোষণও বন্ধ হবে৷ তবে আর একটা কাজ করতে হবে কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিতে হবে৷ অর্থাৎ শিল্পজাত দ্রব্যের যে পদ্ধতিতে দাম ধার্য্য করা হয় সেই একই পদ্ধতিতে সমস্ত ধরণের খরচ–খরচা ধরে কৃষি পণ্যেরও মূল্য নির্দ্ধারণ করতে হবে৷

উৎপাদন বৃদ্ধি প্রসঙ্গে আরো একটি প্রসঙ্গ আসে তা হ’ল পদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণার পরিবর্তন, কৌশলগত পরিবর্তন৷ এখন আর একটা সময়ে একটা ফসলের চাষ নয়–চাই (ক) মিশ্রচাষ–একই জমিতে, একই সময়ে প্রধান ফসলের সঙ্গে দুই বা ততোধিক ফসলের চাষ–যেমন পাটের সঙ্গে বাদাম–সয়াবিনের চাষ, তিলের সঙ্গে মিষ্টি আলু–বাদাম চাষ ইত্যাদি৷ (খ) অনুপূরক চাষ–যেমন বর্ষাকালে ধানের জমিতে মাছ চাষ (গ) পর্যায়ক্রমিক চাষ–যেমন বছরের শুরুতে আউশ, তারপর আমন ধান৷ তারপর জলদি জাতের বোরো, তারপর নাবি জাতের বোরো চাষ করলে বছরে একই জমিতে চারটি ধান চাষ হবে৷ এভাবে চাষ করলে উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাবে৷

কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারণাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি না  সুসংবদ্ধ কৃষির ধারণা থাকে৷ কৃষিকাজের প্রধান উদ্দেশ্যই হ’ল আর্থিক স্বয়ম্ভরতা৷ তাই সুসংবদ্ধ কৃষি বলতে বোঝায়–বিভিন্ন কৃষি পণ্যের উৎপাদন, ফলের চাষ, পুষ্প চাষ, রেশম চাষ, লাক্ষা চাষ, মউমাছি পালন, গোষ্ঠ পালন ও পশুপালন, মৎস্যচাষ, কীটঘ্ণের ব্যবহার, উপযুক্ত সারের প্রয়োগ ইত্যাদি৷ কৃষি সম্পর্কে এই সামগ্রিক দৃষ্টি ভঙ্গি থাকলে তবেই কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা সম্ভব৷ (কণিকায় প্রাউট–১৬)

সুসংবদ্ধ কৃষির একটি অঙ্গ হ’ল জলসংরক্ষণ ও বনসর্জন  আধুনিক পদ্ধতিতে তথা বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ করতে হলে প্রচুর জল চাই৷ নির্বিচারে অরণ্য ধবংস করে ফেলার ফলে আমাদের দেশে প্রায় শতকরা চল্লিশ ভাগ বৃষ্টিপাত কমে গেছে৷ গভীর ও অগভীর নলকূপ খনন করে ব্যাপকভাবে জলের ব্যবহার করার ফলে ভৌমজলের স্তর হুহু করে নামছে৷ এভাবে চলতে থাকলে গাছপালা মরে যাবে৷ দেশটা মরুভূমি হয়ে যাবে৷ খাল–বিল–নদী–নালা মজে গেছে, জলই থাকে না৷ কাজেই সুসংবদ্ধ কৃষির সাফল্য আনতে গেলে প্রথমেই নদী–নালা–খাল–বিল– ইত্যাদি জলাশয়গুলো সংস্কার করতে হবে৷ বৃষ্টির জল ধরে জলাধার তৈরী করে সংরক্ষণ করতে হবে৷ নদ–নদীতে নাব্যতা বজায় রাখার জন্যে ড্রেজিংয়েরও ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ এতে যে কেবল সেচের সুরাহা হবে তাই নয়, বহুমুখী উদ্দেশ্য সাধন হবে–মৎস চাষ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে৷ সোজা কথা বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে উৎপাদন বৃদ্ধি হবে না, সুসংবদ্ধ কৃষিতে সাফল্য আসবে না৷ মাটির নীচের জল নয়৷ মাটির উপরে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করতে হবে জলাধার তৈরী করে৷ এই সঙ্গে প্রয়োজন বর্ষার সময় নদীর জল জলাধারে এনে জলাধারগুলো ভরে নিতে হবে৷ প্রয়োজনে নোতুন নোতুন জলাধার খনন করতে হবে৷ এর ফলে ভৌম জলের স্তরও উপরে চলে আসবে৷

জল সংরক্ষণ প্রকল্প সাফল্য পাবে না যতদিন একই সঙ্গে বনসর্জন প্রকল্প বাস্তবায়িত না হয়৷ ‘‘সব জল প্রবাহের দুটি তীরই গভীর অরণ্য আচ্ছাদিত হওয়া উচিত৷ এর পিছনে বিজ্ঞানটা হ’ল এই যে গাছের শেকড় জলকে ধরে রাখে৷ যখন জলস্তর নেমে যায় তখন গাছের শিকড় ধীরে ধীরে জল ছাড়তে শুরু করে৷ তাই গাছ–পালা দিয়ে ঘেরা পুকুরের জল কখনই  শুকিয়ে যাবে না৷ গাছের পত্ররাজি জলের বাষ্পীভবনের মাত্রাকেও কমিয়ে রাখে৷ এছাড়া গাছের পাতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে যা মেঘকে আকর্ষণ করে৷ এইভাবে গাছ বৃষ্টিপাত বাড়াতে সাহায্য করে৷’’ (ক.প্রা.–১৭)

‘‘বন রচনার যে কোনো বিজ্ঞান সম্মত পরিকল্পনার দুটো দিক থাকা উচিত৷ প্রথম স্তরে, শীঘ্র বাড়ে এমন গাছ লাগাতে হবে৷  সেই গাছ নির্বাচিত করতে যা ছয় মাস বা দু’ বছরের মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় পৌঁছে যায় আর গহন সবুজ বনানী তৈরী করে দেয়৷ দ্বিতীয় স্তরে যে সব গাছ বর্ধিত হতে বেশী সময় নেয় কিন্তু তারাও গহন সবুজ বনানী তৈরী করে৷ তাদের লাগাতে হবে৷ এই পদ্ধতিতে কোন অঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য দ্রুত পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হবে৷’’

‘‘পুকুর পাড়–বাঁধ–খাল–সায় বা জলাশয়ের পাড়ে বন রচনা করা উচিত৷ যেমন, এ সব স্থানে বাবুল বা খয়ের গাছ লাগানো যেতে পারে এদের মাঝখানে লাগানো যেতে পারে বকফুল৷ আবার তাদের মাঝখানে লাগানো যেতে পারে ভারতীয় প্রজাতির শাল৷ এর কারণ বকফুল বাড়ে তাড়াতাড়ি ও পাঁচ বছরেই দীর্ঘ বৃক্ষে পরিণত হয়৷ কিন্তু বাবুল বাড়তে এর থেকে বেশী সময় নেয়৷ শাল বাড়ে ধীরে৷ কিন্তু অনেক দিন বাঁচে৷ এইভাবে বকফুলের গাছ তাড়াতাড়ি বড় হয়ে সেগুলি মেঘকে আকর্ষণ করে বৃষ্টিপাত ঘটায় ও অন্যগাছকেও বাড়তে সহায়তা করতে পারবে৷ তারপর পাঁচ ছয় বছরে সেই গাছগুলি পূর্ণত্বে পৌঁছলে কেটে ফেলা যাবে৷ কিন্তু ততক্ষণে শালের এক গভীর বন তৈরী হয়ে যাবে৷

এই গাছগুলির আবার অন্যদিক থেকেও উপযোকিতা আছে৷ যেমন বকফুলের পাতা গোরুর দুধ বাড়ায়৷ আবার এর পাতা বা কাণ্ড থেকে সুতোও তৈরী করা যায়৷ শালগাছ  বৃষ্টিপাত বাড়ায় আর গোড়ায় জল ধরে রাখে৷ এর ফুল থেকে প্রচুর পরিমাণে মধু পাওয়া যায়৷ পত্র থেকে পত্রথালি তৈরী করা যাবে৷ রস থেকে আঁঠা তৈরী হবে যা ধূপবাতি শিল্পে ব্যবহূত  হবে৷ আর গাছে অ–তুঁত রেশম চাষ হবে যা থেকে তরল সিল্ক্ পাওয়া যাবে৷ এর বীজ মানুষের খাদ্য৷ আর শালের মধুর ঔষধীয় গুণ থাকায় আর্থিক দিক দিয়ে মূল্যবান, কেননা তা রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসাবে বিদেশী মুদ্রা আনতে পারবে৷ যদি প্রয়োজন হয় শালের মাঝখানে পিয়াশালও লাগানো যেতে পারে৷ (ক.প্রা.১৭খণ্ড)

‘‘বিজ্ঞানসম্মত ভাবে শস্য উৎপাদন৷ জল সংরক্ষণ ব্যবস্থার এক অত্যাবশ্যক অঙ্গ’’ আবার জলসংরক্ষণ ব্যবস্থার আর অঙ্গ হ’ল বনসর্জন৷ ফলের গাছ গোড়ায় যথেষ্ট জল ধরে রাখতে পারে৷ তাই নদীর দুই ধারে, খালের পাড়ে, বিলের খাড়া পাড়ে, শস্য ক্ষেতের কাছে ফলের গাছ লাগানো উচিত৷ এই গাছ লাগানোতে জল সংরক্ষণের সুবিধা হবে৷ মূর্খ কালিদাসের মত মানুষের নির্বুদ্ধিতায় ও লোভ–এ নদীর দু’পাড়ের গাছ নিশ্চিহ্ণ৷ জলাশয়েক পাড়গুলো বৃক্ষহীন৷ এজন্যে অনেক নদী মৃত প্রায়৷ বড় বড় জলাশয়ও শুকিয়ে যায়৷ কাজেই পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের জন্যে, জলসংরক্ষেণর জন্যে বনজ সম্পদ ব্যবহারে গ্রামীন আর্থিক উন্নতির জন্যে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বনসর্জন করতেই হবে৷ অনেকে হয়ত বলবেন, জায়গা কোথায়? এতে চাষের জমি নষ্ট হবে৷ উত্তর হ’ল–মানসিকতা বদলাতে হবে৷ বনসর্জনই আয়ের উৎস হবে৷ চাষের ক্ষতি পুষিয়েও মানুষ লাভবান হবে৷ তাছাড়া শুরুর প্রথম কয়েক বছর মিশ্র চাষও করা যাবে৷

গ্রামের মানুষের স্বয়ম্ভরতার দ্বিতীয় ক্ষেত্র হ’ল শিল্প৷ গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্রিটিশের দ্বারা ধবংস প্রাপ্ত শিল্পচিত্র আজো বজায় আছে৷ ফলে কৃষির যেমন নাভিশ্বাস উঠেছে তেমনি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও সঙ্কুচিত হয়েছে৷ ফলে স্বাধীনতার দীর্ঘকাল পরেও গ্রামের তেমন উন্নতি হয়নি৷ এমন গ্রামোন্নয়ন কী? গ্রামের মানুষের যা প্রয়োজন তা যদি বাজারে থাকে আর তা কেনবার সামর্থ্য যদি থাকে তাহলেই গ্রামোন্নয়ন হয়েছে বলা যাবে৷’’ এজন্যে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করতে সমান্তরাল শিল্প বিকাশ চাই৷ এরজন্যে শিল্পপতি ধরতে বিদেশী পুঁজি আনতে সরকারী (জনগণের) অর্থে মচ্ছব করে বিদেশে ভ্রমণে যেতে হবে না৷ চাই কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষি সহায়ক শিল্প৷ এ ব্যাপারে গ্রামের মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক্ হতে হবে৷ শিল্প–কৃষি দুইয়েরই উৎপাদন বাড়িয়ে যেতে হবে৷ তবে ‘‘আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপারে যদি গ্রামবাসীরা স্বনির্ভর না হন তাহলে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষও করা যাবে না, উৎপাদনও বাড়বে না৷ সেজন্যে গ্রামবাসীদেরই সম্মিলিত ভাবে কৃষি সহায়ক শিল্প জেলায় জেলায় সামবায়িক পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে৷ জেলায় যদি অন্তত একটা কৃষি সহায়ক শিল্প না থাকে তাহলে প্রতিটি গ্রাম তার সুফল থেকে বঞ্চিত হবে৷ সেই সুফল থেকে যাতে কেউ বঞ্চিত না হয় সে জন্যেই সেই সমবায় পদ্ধতিতে চালাতে হবে৷’’

(গ্রামোন্নয়ন–ত্র্যম্বকেশ্বরানন্দ অবধূত)

ব্লকে ব্লকে শিল্পায়নে কৃষি সহায়ক শিল্পের সঙ্গে গড়ে উঠবে কৃষি নির্ভর শিল্প৷ সেটা কেমন? কৃষি–বন–বাগান থেকে উৎপন্ন পণ্য বাজারে বিক্রী করতে গেলে যে সব দ্রব্য সরাসরি ভোগ করা যায় না তাকে ব্যবহার্য দ্রব্যে পরিণত করতে হবে৷ আবার যা পচনশীল তাকে দীর্ঘস্থায়ী ভোগ্যপণ্যে পরিণত করার জন্যে ব্লকে ব্লকে কৃষি নির্ভর শিল্প গড়তে হবে৷  মধ্যসত্ত্বভোগী–দালাল ফড়েদের হাত থেকে উৎপাদকদের বাঁচাতে গ্রামের মানুষেরই পরিচালনায় শিল্প ক্ষেত্রগুলি সমবায় প্রথায় গড়তে হবে৷ অবশ্য অতি ছোট ক্ষেত্রগুলি ব্যষ্টিগত মালিকানায় থাকবে৷ তবে বিপণন ব্যবস্থা অবশ্যই সমবায় পদ্ধতিতে হবে৷ স্থানীয় উৎপন্ন কৃষিজাত বনজ পণ্য দিয়ে রকমারি শিল্প গড়ে উঠবে–যা সুসংবদ্ধ কৃষিব্যবসারই আবশ্যিক অঙ্গ৷ যেমন–

(১) পাট, শোন, ম্যাস্তাপোট ও অন্যান্য তন্তুজ ফসল থেকে বয়ন শিল্প৷

(২) ধান থেকে–ধানকল, তেলকল, সিমেন্ট শিল্প (ধানের তুষ দিয়ে) ৷

(৩) গম থেকে–আটাকল, বেকারী ইত্যাদি৷

(৪) তৈলবীজ থেকে–তেলকল, সার তৈরী, রঞ্জন শিল্প, অন্যান্য৷

(৫) চীনী শস্য থেকে –(ইক্ষু, সুগারবীট, খেজুর, তাল ইত্যাদি)৷

(৬) মসলা চাষ থেকে–মশলা শিল্প৷

(৭) ঔষধী উদ্ভিদ থেকে–উদ্ভিজ্জ ভেষজ শিল্প৷

(৮) চা,কফি থেকে–পানীয় শিল্প৷

(৯) রবার গাছ থেকে–রবার শিল্প৷

(১০) ফল থেকে–ফল সংরক্ষণ শিল্প, যেমন জ্যাম, জেলি, মার্মলেড, মেওয়াফল ইত্যাদি৷

(১১) ফুল থেকে–এসেন্স শিল্প, মধু সংগ্রহ ইত্যাদি৷

(১২) কীট থেকে–রেশম চাষ, লাক্ষা শিল্প, মউ পালন৷

(১৩) মৎস্য চাষ থেকে–মৎস সংরক্ষণ ও অন্যান্য৷

(১৪) আবর্জনা, পশুর বিষ্ঠা, কচুরিপানা, পচা–শাক সব্জী থেকে জৈব সার, অপ্রচলিত বিদ্যুৎ৷

(১৫) বেত–বাঁশ দিয়ে হস্ত শিল্প৷

(১৬) খেজুর পাতা দিয়ে মাদুর শিল্প৷

(১৭) মাছ ধরার নানান সাজসরঞ্জাম তৈরী৷

(১৮) ডাল শস্য থেকে ডাল, পাঁপড়, বড়ি ইত্যাদি৷

(১৯) উদ্ভিজ্জ–সাবান, শ্যাম্পু, তরলসাবান, ডিটারজেন্ট ইত্যাদি৷

(২০) গ্রামীণ প্রচলিত শিল্প হিসাবে–মৃৎ শিল্প অন্যান্য৷

সুসংহত পরিকল্পনার মাধ্যমে আলোচিত রকমারি কৃষিনির্ভর শিল্পগুলি গ্রামবাঙলার সার্বিক উন্নয়নকে সুনিশ্চিত করবে৷

পরিশেষে পরিকল্পনা রচনা ও প্রয়োগের সময় কয়েকটি বিষয়ের কথা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে (১) উৎপাদন পদ্ধতি আধুনিকীকরণ বা যন্ত্রায়নের ক্ষেত্রে অঞ্চলের প্রতি কর্মক্ষম মানুষের পূর্ণ নিয়োগের  কথাটা মাথায় রাখতে হবে৷ (২) গ্রামের মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণে ও তা সক্ষমতায় উত্তোরণের ক্ষেত্রে পরিপূরক দ্রব্য উদ্ভাবন ও সন্ধানের নিরন্তর প্রয়াস থাকবে৷ উদ্দেশ্য বহুমুখী–(ক) নোতুন নোতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি (খ) পরিবর্তনশীল রুচি ও পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান৷ একটি পণ্যের চাহিদা হ্রাস পেলে৷ সামগ্রিক উৎপাদন ব্যহত হবে না৷ কর্মসংস্থানেরও সমস্যা হবে না৷ পরিবর্ত দ্রব্য বিদায়ী দ্রব্যের স্থান করে নেবে৷ প্রগ্রেসিভ মানসিকতা থাকতে হবে৷ (৩) স্থানীয় দ্রব্যের উৎপাদন ও বাজার রক্ষায়, শিল্পোন্নত অঞ্চলের উন্নতমানের কমদামের দ্রব্যের আমদানি বন্ধ করতে হবে৷ (৪) স্থানীয় মানুষের সামাজিক–র্থনৈতিক  জীবনধারা সাবলীল৷ গতিশীল রাখতে স্থানীয় উৎপাদিত দ্রব্যের ব্যবহার (অসম্ভব না হলে) আবশ্যিক করতে হবে৷ বাইরের দ্রব্যের উপর নির্ভরতা ও আসক্তি বন্ধ করতে হবে দামে বেশী মানে কম হলেও স্থানীয় সামাজিক–র্থনৈতিক স্বার্থেই এটা অবশ্যই করতে হবে৷ (৫) স্থানীয় প্রয়োজন উৎপাদনের প্রাথমিক ভিত্তি হবে৷ উদ্বৃত্ত উৎপাদন কেবল দুঃসমেয়ের সঞ্চয় ও ঘাটতি এলাকার চাহিদা পূরণ৷ (৬) ব্লক–গ্রাম বৃত্তটি–শিক্ষা, চিকিৎসা পরিবহন তথা সর্বাধুনিক নাগরিক জীবনের পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে৷ এতে শহরমুখী গ্রামের মেধা সম্পদের বহিঃস্রোত বন্ধ হবে৷  গ্রামোন্নয়ন সফল হবে৷ অনেক সমস্যাও কমে যাবে৷ তাই জীবনযাত্রার মানের ক্রমোন্নয়নের বিরামহীন প্রয়াস চলবে৷ এ বিষয়ে উৎপাদক সমবায়, উপভোক্তা সমবায় সকলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে৷

পরিশেষে বলি, গ্রামের উন্নয়নের কাজ গ্রামের মানুষই করবে৷ মোট কথা স্থানীয় প্রয়োজন, স্থানীয় কাঁচামাল, স্থানীয় মানুষই হবে প্রকল্পের রূপকার৷ সুসংগঠিত ব্লকস্তর ও আন্তরিক পরিকাঠামোয় মানুষ কাজের সন্ধান করবে না৷ কাজই মানুষের সন্ধান করবে৷