প্রাউটের প্রকরণ ও প্রস্তাবনা

লেখক
ড. দিলীপ হালদার, (অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়)

প্রোগ্রেসিব ইয়ূটিলাইজেশন্ থিওরি Progressive Utilization Theory) কথাটাকেই সংক্ষেপে প্রাউট(PROUT) বলা হয়৷ প্রাউট প্রভাতরঞ্জন সরকারের একটি মৌলিক আর্থ-সামাজিক তত্ত্ব৷ বাংলায় প্রাউটকে তিনি প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব বলেছেন৷ এর উদ্দেশ্য হ’ল মানুষের জাগতিক দুঃখ-কষ্ট লাঘব করে পরমার্থ লাভের সন্ধান দেওয়া৷Progressive-এরPRO, Utilization-এরU ওTheory-রT এই তিনটি অংশ মিলে প্রাউট কথাটার সৃষ্টি৷ প্রতিটি অংশেরই আলাদা-আলাদা মানে আছে৷

Progressive বা প্রগতিশীল কথার মানে হ’ল বর্তমান অবস্থান থেকে উন্নততর অবস্থানে নিয়ে যাবার প্রবণতা৷ এই উন্নয়ন দু’ধরণের হয়৷ গুণগত Quality-র) উন্নয়ন, অন্যটি পরিমাণের(Quantity-র) উন্নয়ন৷ প্রগতির জন্যে এই দু’য়েরই প্রয়োজন৷ প্রভাতরঞ্জন এই দু’ধরণের উন্নয়ন বা প্রগতির কথাই বলেছেন৷ প্রকৃতির অফুরন্ত দানের প্রতি উপকরণের মধ্যেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপযোগ বা উপযোগিতা সঞ্চিত আছে৷ উপযোগিতা সাধারণতঃ বস্তুকে আশ্রয় করে থাকে৷ এটা বস্তুর একটা বিশেষ গুণ যা ভোক্তার চাহিদা মেটায় ও তাকে তৃপ্ত করে যেমন খাদ্যবস্তু ক্ষুধা মেটায়, জল তেষ্টা মেটায়, এইভাবে ভোক্তা তৃপ্ত হয়৷ বস্তুর এই ধরণের চাহিদা মোটানোর ক্ষমতাকেই বলা হয় উপযোগিতা৷ অর্থশাস্ত্রে উপযোগিতার (ব Utility-র) এটাই সংজ্ঞা৷

বস্তু বলতে আমরা সাধারণতঃ যা বুঝি তা হ’ল সেই জিনিস যা আমরা ধরতে-ছঁুতে পারি অর্থাৎ পঞ্চেন্দ্রিয়ের আওতায় পড়ে৷ এক অর্থে অনেকটাই স্থূল (বাconcrete)৷ উপযোগিতা ইন্দ্রিগ্রাহ্য স্থূল বস্তুর বাইরেও অবস্থান করে৷ মানুষের জীবনে এমন অনেক জিনিস আছে যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, চোখে দেখা যায় না৷ কিন্তু চাহিদা মেটানোর জন্যে অপরিহার্য৷ অর্থাৎ তাদের উপযোগিতা আছে কিন্তু বস্তু নির্ভর নয়৷ যেমন সেবা (বাService) যা অনেক ধরণের হয়৷ পরামর্শ, উপদেশ, শিক্ষাদান, চিকিৎসা, বিচার ও এই রকম আরও অনেক ধরণের সেবা আছে, যা বস্তু নয় কিন্তু মানুষের চাহিদা মেটায়৷ তাই বস্তু না হলেই যে তার সাধারণত উপযোগিতা থাকবে তা যেমন ঠিক নয় আবার উপযোগিতা থাকলেই তাকে বস্তু হতে হবে তাও ঠিক নয়৷ বস্তু ও যা বস্তু নয় তাদের উভয়কেই উপযোগিতা সংযোজন করলে মানুষের চাহিদা মেটাানোর ক্ষমতা জন্মায়৷ বস্তুর ক্ষেত্রে স্থান place), কাল time) ও আকৃতির form) পরিবর্তন করে উপযোগিতার সৃষ্টি করা হয়৷ এই উপযোগিতা সম্বলিত বস্তুকেই বলা হয় দ্রব্য comidity) যার আর্থিক ও সামাজিক মূল্য আছে৷ আর্থিক মূল্য দ্রব্যের চাহিদা যোগানের ভারসাম্যের উপর নির্ভরশীল৷

স্থান পরিবর্তন করে উপযোগিতার সৃষ্টি করার উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে পানীয় জলের যেখানে অভাব সেখানে পানীয় জলের উপযোগিতা তুলনামূলকভাবে বেশী যেখানে পানীয় জলের পরিমাণ বেশী সেখানের চেয়ে৷ তাই জল যেখানে বেশী আছে সেখান থেকে যেখানে কম আছে সেখানে আনলে জলের উপযোগিতার মোট পরিমাণ বাড়ে৷ সাথে সাথে আর্থিক মূল্যও৷ আর এর আর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হ’ল খনিজ তেল৷ এছাড়া কাল(time) বা সময়ের পরিবর্তন করে দ্রব্যের উপযোগিতা বাড়ানোর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, চাষী যদি ফসল উৎপাদনের সময় অতিরিক্ত ফসল মজুত করে রাখে তবে যে মরসুমে শস্যের অভাব সেই মরসুমে তার ফসলের উপযোগিতা বেড়ে যায়৷ দামও বাড়ে৷ আয়তনের সঙ্গে বা পরিমাণের সঙ্গে উপযোগিতার বিপরীতমুখী সম্পর্কের Inverse relation) জন্যে এটা হয়ে থাকে৷

বস্তুর আকৃতির form-এর) পরিবর্তন ঘটিয়েও আমরা উপযোগিতার সৃষ্টি করি৷ যদি জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনি তার একটি উপযোগিতা থাকে যা আমাদের চাহিদা মেটায়৷ আবার সেই কাঠ দিয়ে যদি আমরা আসবাবপত্র তৈরী করি তবে সেই আসবাবের উপযোগিতা পূর্বাবস্থার কাঠের উপযোগিতার চেয়ে অনেক বেশী৷ তাই তার দামও বেশী৷ প্রধানত এই তিন ভাবেই আমরা স্থূল বস্তু ও সেবার মধ্যে উপযোগিতার সৃষ্টি করি৷ তাই আমরা যে জিনিসে উপযোগিতা থাকে তাকে বস্তু না বলে বলতে পারি দ্রব্য বা পণ্য(Commodity), তা সে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যই হোক কিংবা অতিন্দ্রিয়ই হোক৷ এইভাবে দ্রব্য প্রস্তুতকেই অর্থনীতির ভাষায় উৎপাদন (বাProduction) বলে যা সম্পদ সৃষ্টির সহায়ক৷ এইভাবে সম্পদ সৃষ্টি করে মানুষ প্রকৃতপক্ষে ব্যষ্টিগত আয় ও জাতীয় আয় বাড়িয়ে সমাজকে প্রগতিশীল করে৷ এটা প্রভাতরঞ্জনের প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের একটা অন্যতম দিক৷

উপযোগ সৃষ্টির প্রবণতা উৎসাহিত হয় আর্থিক আয় বা ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদে৷ ক্রয়ক্ষমতা যার যত বেশী সে তত বেশী ধনী৷ আর দ্রব্য বা ভোগ্য বস্তু কিনে চাহিদা মেটানোর ক্ষমতাও তাদের বেশী৷ আর্থিক আয় বা ক্রমক্ষমতার পার্থক্যই ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে৷ মানুষের ভোগলিপ্সা সীমাহীন৷ তুলনায় ভোগ্যপণ্যের যোগান ও তার কেনার ক্ষমতা তুলনায় অপ্রতুল৷ তাই অর্থ-উপার্জনের জন্যে মানুষ উপযোগ সৃষ্টিতে বা উৎপাদনের কর্মযজ্ঞে সদা ব্যাপৃত৷ মানুষের জাগতিক দুঃখের অন্যতম কারণ অর্থের অভাব৷ অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থানের জন্যে অর্থের প্রয়োজন৷ এই অর্থের অভাব মানুষের জাগতিক বা ভৌতিক জগতের দুঃখের কারণ৷ তাই প্রভাতরঞ্জনের মতে ‘‘মানুষ যাতে বিধিসম্মতভাবে তার সমস্ত সম্পদ নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে ভাগ করে কাজে লাগাতে পারে তার একটা ব্যবস্থা দরকার ছিল---যা না করার জন্যে সমাজজীবনে যে অনুপপত্তি (অসঙ্গতি) থেকে গিয়েছিল, সেই অনুপপত্তির জন্যেই মানুষের যত দুঃখ-কষ্ট ভোগ চলছিল৷ এটাই তো বন্ধ করতে হবে৷ মানুষ যখন বুদ্ধিমান জীব তখন তার মধ্যে এই ধরণের একটা বড় ত্রুটি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী কেন চলতে থাকবে! যাতে এটা না হয়---যাতে মানুষ তার মহত্তর লক্ষ্যকে চোখের সামনে রেখে জাগতিক দুঃখ, ক্লেশগুলোকেও দূর করার চেষ্টা করে, সেই জন্যেই প্রাউট দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে৷ প্রাউট দর্শনকে সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনও পথ ছিল না৷ তা যদি না হ’ত আরও হয়ত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের দুঃখ-ক্লেশ চলতে থাকত৷ প্রাউট ছাড়া এই ক্লেশ দূর করে ‘মানবতাকে রক্ষা করার অন্য কোনও উপায় নেই৷ অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই, চিকিৎসা চাই, নিবাস চাই৷ আর এই প্রয়োজন মেটাবার জন্যেই আমি একদিন অবস্থার চাপে পড়ে প্রাউট দর্শন সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়েছি৷ কারণ যে মানুষটা খেতে পাচ্ছে না আগে তাকে অন্ন দেব তারপর তাকে শেখাব অধ্যাত্ম দর্শন৷ তারপর তাকে সাধনায় বসাব৷ তাই প্রাউট প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক স্তরেও অধ্যাত্ম স্তরে(Physical Sphere and Spiritual Sphere) সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে৷ আর মানসিক স্তরে ক্লেশ ভোগটা হবে বটে, কিন্তু সেটার সঙ্গে যুঝবার সামর্থ্য মানুষের এসে যাবে৷ একথাটা মনে রেখে তোমরা দ্রুত নোতুন একটা মানব সমাজ গড়ে তোল৷’

মানুষ বুদ্ধিমান জীব৷ তাই তার কর্তব্য হ’ল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করে বিশ্বের অফুরন্ত জাগতিক ও মানসিক সম্পদের অতিরিক্ত উপযোগ সৃষ্টি করে তা অন্যের মানসিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরণের জন্যে নিয়োজিত করা৷ এটাই প্রকৃত অর্থে উন্নয়ণশীল উপযোগ সৃষ্টির ব্যকরণ৷ কীভাবে এটা করা সম্ভব তারও রূপরেখা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরল ভাষায় বলে গেছেন৷