পুঞ্জীভূত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুখে বলছেন, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সবার উন্নয়নই তাঁর তথা তাঁর পার্টির লক্ষ্য। এই শ্লোগান দিয়েই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। জনগণ তাঁর কথার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ ছিল জনগণ সেই অতীতের ঘটনাকে আমল দেননি।

ক্ষমতায় এসে প্রথম প্রথম তিনি তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে কাজ করেছিলেন। কিন্তু গত কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচনে তাঁর দলের অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে এখন ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে পেছন থেকে আর এস এস তার কাজ পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে। আর এস এস-এর ঘোষিত নীতিই হল হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ এদেশে মুসলীম বা অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মৌলিক দাবীকে তাঁরা আমল দিতে চান না।

তাই বিভিন্ন সময়ে মাংস ভক্ষণ নিয়ে বা গবাদি পশুর কেনা বেচা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নোতুন নোতুন আইন পাশ করছেন ও দেশে স্বাভাবিক ভাবে অশান্তির সৃষ্টি করছেন। ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক অসন্তোষ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। হঠাৎ যদি এই পুঞ্জীভূত বারুদস্তুপ বিস্ফোরণের রূপ নেয় তাহলে দেশ জুড়ে বহু রক্তপাত হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিজ্ঞতা দেশবাসীর আছে। স্বাধীনতার অব্যহিত পূর্বে এমনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দুদেশের মাটি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। এই দাঙ্গায় কেবল যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবপন্ন মানুষ হতাহত হন তা নয়, বরং বেশিরভাগ নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ এই দাঙ্গার শিকার হন।

এই ধরণের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দেশের উন্নয়নের পক্ষে চরম বাধা। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে চাই ঐক্য ও সুবুদ্ধি। এছাড়া কখনই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

তাই মোদী সরকার যদি সত্যই দেশের উন্নতি চান অবিলম্বে যে সমস্ত কর্মসূচী সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে, সে কর্মসূচী পরিত্যাগ করুন। দেশের যথার্থ উন্নতির জন্যে, দেশের ঐক্যের জন্যেও। দেশের জাত-পাত সম্প্রদায় নির্বিশেষে যারা দরিদ্র তারা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ে রয়েছেন। তাদের উন্নতির জন্যে পরিকল্পনা নিন। এতে দরিদ্র হিন্দু, মুসলীম, খ্রীষ্টান, জৈন--- যে মানুষ হোক না কেন তারা উপকৃত হবেন।

হিন্দু ধর্মমতের তথাকথিত ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর মধ্যেও এমন অনেকে আছেন তাঁরা অতি দরিদ্র। তথাকথিত হরিজন ও আদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তো ব্যপক ভাবেই দারিদ্র রয়েছে। আবার এই তথাকথিত হরিজন বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেও কিছু অবস্থাপন্ন বা ধনী ব্যষ্টি আছেন। তাই জাত-পাত সম্প্রদায় ধরে উন্নয়ন বা সংরক্ষণ নীতিও অনৈতিক। দরিদ্র মানুষের মধ্যে যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেই সুবিধা যেন সমস্ত সম্প্রদায়ের সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষের কাছে পৌঁছায়।

দেশের যেকোন যথার্থ কল্যাণকামী সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত, দেশের প্রতিটি মানুষের ক্রয়ে ক্ষমতা অর্জন। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি মানুষের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা। সরকার তো দেশের কর্মসংস্থানের জন্যে মুখ্যত নির্ভর করছেন দেশী ও বিদেশী পুঁজিপতিদের ওপর।

কিন্তু পুঁজিপতিরা সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমেই কলকারখানা গড়ে তোলেন। এইসব শিল্পে অত্যন্ত অল্প মানুষেরই কর্মসংস্থান হয়। আর বেশিরভাগ তারাই সুযোগ পায় তাদের প্রযুক্তির জ্ঞান আছে।

কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া মানুষ--- যাদের কথা আগেই বলেছি--- তাদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষ খুবই কম। এক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের শিল্পে ওই দেশের দরিদ্র মানুষদের কতটুকু উপকার হবে।

তার চেয়ে বরং দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ওপরই সর্র্বধিক গুরুত্ব দিতে হবে। যা নেতারা মোটেই দেন নি। মুখে নিজেদের জনগণের সেবক বললেও কার্যত, তাঁরা পুঁজিপতিদের সেবাতেই সদাব্যস্ত। আজ মূলতঃ দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বিরোধী সংগ্রাম দিয়েই সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কোন জাত-পাত সম্প্রদায়ের ভেদ করলে চলবে না। বিজেপি এপথে না চললে দেশের ও যেমন বিপদ তেমনি বিজেপির চরম বিপদ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজী এই সত্যকে যথার্থভাবে উপলদ্ধি করে যদি দলের বা তাঁর গোষ্ঠীর অনেকেরই মনে যে নানা ধরণের ভেদবুদ্ধি বাসা বেঁধে আছে--- তা কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ না করেন, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।