পুরুলিয়া জেলার জন্ম কথা

লেখক
পথিক বর

লর্ডকার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন ইতিহাসে স্থান পেয়েছে৷ কিন্তু এই বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করেই আর একটা আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল, যে আন্দোলন চলেছিল দীর্ঘ ৪৪ বছর৷ ১৯১১ সালে ব্রিটিশ শাসক বঙ্গ-ভঙ্গ রোধ করতে বাধ্য হলো৷ কিন্তু চতুর ব্রিটিশ ও কংগ্রেসের হিন্দী লবির চক্রান্তে বাঙালীর বিরুদ্ধে নূতন এক ষড়যন্ত্র শুরু হয়৷ চতুর ব্রিটিশ বাংলা ভাষী অঞ্চল মানভূম সিংহভূম ধলভূম প্রভৃতি বিস্তীর্ন অঞ্চল বিহার ও উড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়৷ ১৯১২ সালে ওই অঞ্চলের বাঙালী জনগোষ্ঠী মূল বাঙলার সঙ্গে যুক্ত  হবার আন্দোলন শুরু করেন৷ সেই সময় কংগ্রেস  অধিবেশনে বাঙলার নেতারা মানভূম প্রসঙ্গ তুললে তৎকালীন কংগ্রেস নেতারা  প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ চলে যাবার পর বাঙলার অংশ বাঙলাকে ফেরৎ দেওয়া হবে৷ বাঙলার কংগ্রেস নেতারা সরল মনে সেটা বিশ্বাস করেছিলেন

কিন্তু ১৯৪৭ সালে তথাকথিত স্বাধীনতার পর কংগ্রেস নেতারা  তাদের প্রতিশ্রুতি রাখেনি৷ খণ্ডিত পশ্চিম বাঙলার কংগ্রেস নেতারাও বিহার উড়িষার সঙ্গে যুক্ত বাঙলার অংশ ও বাঙালীদের  কথা ভাবেননি৷ মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সামাজিক অর্থনৈতিক ও ভাষা সংসৃকতির দিক থেকে অবদমিত হচ্ছিল ওইসব অঞ্চলের বাঙালী জনগোষ্ঠী৷

সেই সময় মানভূমে শুরু হয় তীব্রগণ আন্দোলন তৎকালীন বিহারের বাঙলার অংশ মানভূম জেলাকে বাঙলার সঙ্গে যুক্ত করবে৷ সেইদিন বিহার সরকার আন্দোলন দমন করতে যে নির্যাতন করেছিল আন্দোলনকারীদের ওপর , তা সাম্রাজ্যবাদী বিট্রিশ সরকারকেও ম্লান করে দিয়েছিল৷ মানভূমের  সাংসদ ভজহরী মাহাত সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে বিহার সরকারের অত্যাচার বর্ণনা করে তিনি বিহারের সঙ্গে থাকতে অস্বীকার করেছিলেন৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় সেদিন বাঙলার কোন নেতা আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান নি৷

আসলে সেদিন মানভূমের পাশে বাংলাদেশ দাঁড়ায়নি৷ তবু মানভূমের বাঙালীরা সেদিন পিছিয়ে থাকে নি৷ ১৯১২ সাল থেকেই বিহারের বাংলাভাষী অঞ্চলের সুকলগুলি থেকে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হতে থাকে৷ ১৯৫২-র অনেক আগেই ১৯১২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল বিহার প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত বাঙলার মানভূমে৷ সেই আন্দোলন তীব্ররূপ ধারণ করে ১৯৪৭ সালের পর৷ দাবী ওঠে মানভূম জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার৷ শুরু হয় টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন ---সেই আন্দোলনকে প্রেরণা দিতে রচিত কালজয়ী গান---

‘‘শুন বিহারী ভাই

তোরা রাইখত্যে লারবি ডাঙ্গ দেখাই

তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি

বাংলা ভাষায় দিলি ছাই

ভাইকে ভুলে করলি বড়

বাংলা বিহার বুদ্ধিটাই৷’’

অবশেষে দীর্ঘ আন্দোলনের পর বিহার সরকার মাথা নত করে৷ বহু অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে মানভূমের আন্দোলনকারীরা আংশিক জয়ী হলেন৷ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি৷ তবু ব্রিটিশ সরকারের চেয়েও ধূর্ত সেদিনের কংগ্রেস নেতারা মানভূমকেও ভাগ করে দেয়৷ মানভূমের শুধু পুরুলিয়া মহকুমা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়,সেইদিনটা ছিল ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর৷ পশ্চিম বাঙলার একটি জেলা পরিচয়ে পুরুলিয়ার নবজন্ম হলো৷ অবশিষ্ট মানভূম সিংভূম বিহারেই থেকে যায়৷ আজও বাঙলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিহার, উড়িষা ঝাড়খণ্ডের সঙেগ যুক্ত আছে৷