রেলের বেসরকারী করণ সর্বনেশে সিদ্ধান্ত

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে ভারত সরকার তার হাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উদ্যোগ বা শিল্প সংস্থাগুলিকে একে একে পুঁজিপতিদের হাতে বিক্রয় করে দিচ্ছে৷ ভারতীয় রেল দেশের বৃহত্তম পরিবহন সংস্থা৷ এতদিন পুরোপুরি কেন্দ্রের হাতে ছিল৷ দেশের সর্বসাধারণের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িত৷ সর্বসাধারণের যাতায়াতের মুখ্য মাধ্যম রেল৷ দেশের প্রায় সমস্ত কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা এর ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল৷ কৃষি বীজ থেকে শুরু করে সার, কীটনাশক উৎপাদন যন্ত্রের পরিবহন, কৃষি উৎপাদিত দ্রব্যের লেনদেন সব কিছুর জন্যেই রেলের ওপর নির্ভর করতে হয়৷ ছোট বড় সমস্ত শিল্পের যন্ত্র, যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল, পরিবহন, শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, শিল্পোৎপাদিত পণ্যের পরিবহন তথা বণ্টন সবই রেলের ওপর নির্ভরশীল৷ এ হেন জাতীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটিকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে৷

প্রাথমিক ভাবে ১৫০টি যাত্রীবাহী ট্রেন ও ৫০টি রেল ষ্টেশনের দায়িত্ব পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে৷ ধীরে ধীরে রেলকে পুরোমাত্রায় বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়াই সরকারের সিদ্ধান্ত৷

সরকার সরকারের মন্ত্রী বা সাংসদদের জনসাধারণের বোটে (ভোট) নির্বাচিত হতে হয়৷ তাই জনসাধারণের প্রতি তাদের অনেকটা দায়বদ্ধতা থাকে৷ কিন্তু বর্তমানে সংসদে যে কোন ভাবেই হোক বিপুল সংখ্যাধিক্যের জোরে আজ কেন্দ্রীয় সরকার এই জাতীয় সম্পত্তিটিকে যাদের হাতে তুলে দিচ্ছে জনসাধারণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকার কথা নয়৷ তারা শুধু দেখে তাদের মুনাফা৷ এক্ষেত্রে জনসাধারণের সুবিধা-অসুবিধা তারা ততটা নাও দেখতে পারে৷ তারা যখন দেখবে রেল ছাড়া উপায় নেই তখন তারা যাত্রীভাড়া বা পরিবহন খরচ ক্রমাগত বৃদ্ধি করে গেলে কোন কিছু করার থাকবে না৷ বিশেষ করে গরীব জনসাধারণ, সাধারণ চাষী, ক্ষুদ্র শিল্পোৎদ্যোগীরা ভয়ানক বিপদে পড়বেন৷ ধনলোলুপ বৈশ্যদের শোষণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে৷

রেল ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার বেচে দিচ্ছে ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেডের সরকারের হাতে থাকা ৫৩ শতাংশ শেয়ার, নর্থ ইষ্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার কর্পোরেশন সহ আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প৷ পেট্রোল ডিজেলের ওপর সারা দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল৷ সমস্ত রকমের গাড়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন কলকারখানা তেলের ওপর নির্ভরশীল৷ মুনাফাখোর পুঁজিপতিদের হাতে এগুলো সম্পূর্ণরূপে চলে গেলে এগুলোর লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধিও আটকানোর ব্যবস্থা থাকবে না৷ সারা দেশের জনসাধারণের ভাগ্যও এদের মুষ্টিতে চলে আসবে৷

তাই দেশের জনসাধারণের হাতে নির্বাচিত সরকারের এ হেন জাতীয় সম্পত্তিগুলির বেসরকারীকরণ দেশবাসীর আর্থিক দুর্দশাকে খাদের কিনারায় ঠেলে দেবে৷ সরকার দূর-ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে  সাম্প্রতিক অর্থের ঘাটতি মিটিয়ে রাজকোষ পূর্ণ করার জন্যে এই যে নীতি নিয়ে চলেছেন তা দেশবাসীর ক্ষেত্রে সর্বনেশে নীতি৷

আসলে একটা জনকল্যাণকামী সরকারের ক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক নীতি ঠিক কি হওয়া উচত এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনও ধারণাই নেই৷ তাই তারা আশু লাভটার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চলেছেন, সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনাই নেই৷

সর্বাধুনিক যুগান্তকারী প্রাউট দর্শনে বলা হয়েছে দেশের শিল্প বা অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা উচিত৷ (১) ছোট ছোট অর্থনৈতিক উদ্যোগ যেমন কুটির শিল্প, অতি ক্ষুদ্র মাপের শিল্প বা ছোট ছোট দোকান এগুলো থাকবে ব্যষ্টিগত পরিচালনাধীনে৷ (২) দেশের মূল শিল্পগুলি থাকবে স্থানীয় প্রশাসনের হাতে, মূল শিল্প বলতে বোঝাবে বিশেষ করে সেই সব বৃহৎ শিল্প যার ওপর অন্যান্য শিল্প নির্ভরশীল হবে৷ যেমন লৌহ ও ইষ্পাত শিল্প৷ লৌহ ও ইষ্পাতের ওপর অপর অন্যান্য শিল্প নির্ভরশীল৷  তেমনই বিদ্যুৎ, ডিজেল, পেট্রোল, রেল পরিবহন প্রভৃতির ওপর দেশের সমস্ত শিল্প ও সর্বসাধারণ নির্ভরশীল৷ তাই এগুলোও এ পর্যায়ে আসা উচিত৷ যেহেতু এর সঙ্গে সামগ্রিকভাবে পুরো দেশের স্বার্থ জড়িত---এছাড়া নানান কারণে এগুলি সমগ্র রাষ্ট্রের পরিভূতে পড়ে এই কারণে এইসব শিল্প বা বৃহৎ অর্থনৈতিক উদ্যোগ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকা উচিত৷ এগুলোকে বেসরকারী হাতে দেওয়া কখনোই উচিত নয়৷

আর প্রাউটের মতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্প (মূল শিল্প) ছাড়া অন্যান্য মাঝের শিল্পগুলি সমবায় ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়াই দেশবাসীর পক্ষে মঙ্গলজনক৷ যদিও বর্তমানে সমবায়ের দিকে কি কেন্দ্র কি রাজ্য সরকার কারোর বিশেষ একটা ধ্যান নেই, সমবায় বলতে এরা বড়জোর সমবায় ব্যাঙ্কের কথা ভাবেন৷ কিন্তু না, দেশের কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন ও বণ্টনের প্রধান মাধ্যম হওয়া উচিত সমবায়৷ সমবায় ছাড়া দেশের জনসাধারণের  প্রকৃত কল্যাণ ও উন্নয়ন সম্ভব নয়৷ সমবায় পরিভূ বৃদ্ধি করা ছাড়া পুঁজিবাদী শোষণ থেকে সর্বসাধারণকে বাঁচানোর অন্য কোন রাস্তা নেই৷

যাইহোক, এখানে রেল, পেট্রোল-ডিজেল প্রভৃতি অর্থনৈতিক উদ্যোগ অর্থাৎ এই সংক্রান্ত উৎপাদন শিল্প ও ব্যবসার সম্পর্কে যেটা দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে হয় এগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই রাখা উচিত৷ আর, ‘না লাভ না ক্ষতি’ ভিত্তিতে এগুলো পরিচালিত করা উচিত ও এক্ষেত্রে সর্বসাধারণের সুবিধার দিকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷

মনে রাখা উচিত সরকার জনগণের সেবার জন্যে নির্বাচিত হয়েছেন৷ এখানে মুনাফার প্রশ্ণ যেমন ওঠে না, তেমনই ব্যষ্টিস্বার্থ বা গোষ্ঠী স্বার্থের দিকে তাকালেও চলবে না৷

এটা ভুললে চলবে না, ধন লোভী মুষ্টিমেয বৈশ্য শ্রেণী এখন সমস্ত দেশের অধিকাংশ সম্পদই কুক্ষিগত করে নিয়েছে৷ সরকারের লক্ষ্য সর্বসাধারণের অর্থনৈতিক মান বৃদ্ধি , সর্বসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি৷ ভয়াবহ দারিদ্র ও বেকার সমস্যা থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতে হবে৷

আজ দেশের মানুষের দ্রুত কর্মসংস্থান করাটাই সরকারের মুখ্য কর্তব্য৷ আমরা জানি বৃহৎ বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্টী দেশের কর্মসবস্থান বৃদ্ধির জন্যে যাদের ওপর সরকার অতি মাত্রায় নির্ভরশীল তারা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পরিবর্তে দ্রুত কর্মী ছাঁটাই করে চলেছে৷ সম্প্রতি খবরে প্রকাশ বড় বড়  কোম্পানীগুলি ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই করে চলেছে৷ মারুতি সুজুকী কোম্পানী ইতোমধ্যেই তিন হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে৷ পার্লে বিসুকট কোম্পানী দশ হাজার কর্মী ছাঁটাই করতে চলেছে৷ বড় বড় গাড়ী কোম্পানীগুলিও হাজার হাজার কর্মচারী ছাঁটাই করছে৷

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলের মন্তব্য ভারত সরকারের সবচেয়ে লাভজনক সংস্থা রেলের বিভিন্ন পরিষেবার বেসরকারীকরণ হলে প্রায় তিন লক্ষাধিক কর্মী ছাঁটাই হবে৷ এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের পুঁজিবাদী ঘেঁষা নীতি অবিলম্বে পরিবর্তন করতে হবে৷ সরকারী সম্পত্তি পুঁজিপতিদের হাতে বিক্রয়ের উদ্যোগ বন্ধ করে দেশকে বাঁচাতে হবে নাহলে জনসাধারণ আপনাদের ক্ষমা করবে না৷