ঋণ

লেখক
সৌরভ মুখ্যোপাধ্যায়

ঘোষক যখন তাঁর নামটা ঘোষণা করলেন, মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর অশেষ স্যান্যাল৷ সামনের টেবিলে রাখা বিরাট পুষ্পস্তবকের পাশে সুদৃশ্য মানপত্র আর পুরস্কারের চেকটা সাবধানে রেখে , ধীর পায়ে  গিয়ে দাঁড়ালেন পোডিয়ামের  সামনে৷

কর্মবহুল, ব্যস্ত জীবনে অনেকবারই  সভা-সমিতি-সেমিনারের বত্তৃণতামঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে প্রতিভাধর গণিতবিদ অশেষ সান্যালকে৷ পোডিয়ামে দাঁড়ানো, স্পটলাইটের আলো গায়ে নেওয়া তাঁর কাছে জলভাত৷  সংবর্ধনার  উত্তরে  ধন্যবাদসূচক  ভাষণ এতবার দিয়েছেন, এখন ভাবতে  টাবতে  হয় না৷ মুখস্থ বয়ানের মতো তরতর  করে ভাষায় স্রোত চলে আসে৷

কিন্তু আজ, জীবনের সর্ববৃহৎ পুরস্কারটি পাওয়ার পর, পোডিয়ামের মাউথপিসের  দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন  অশেষবাবু৷ যেন কথা হাতড়াচ্ছেন, ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না৷

দর্শকদের  মৃদু গুঞ্জন ও উসখুসানিতে তাঁর অন্যমনস্কতার  ঘোরটা ছিঁড়ে গেল৷ যেন একটু চমকে  উঠে নিজেকে গুছিয়ে নিলেন, তারপর  ঈষৎ অপ্রতিভ  হেসে শুরু  করলেন তাঁর ভাষণ৷

‘‘আজ এই আলো-ঝলমলে পুরস্কার-মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি মুহূর্তের  জন্য আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিলাম, আপনারা  কিঞ্চিৎ অবাক  হয়েছেন, কেউ কেউ  হয়তো এ-ও ভেবেছেন যে গণিতের গবেষণার এই বিপুল  সম্মান ও বিশাল অর্থমূল্যের  পুরস্কারটি পেয়ে আমি অভিভূত হয়ে পড়েছি৷ অনেকে এমন প্রত্যাশাও করছেন, আমি অতি বিনয়ের  সঙ্গে বক্তব্য রাখব যে এত বড় সম্মানের আমি যোগ্য নই... ইত্যাদি যেমন প্রথাগতভাবে বলা হয়ে থাকে৷

‘‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মহোদয়গণ, আপনারা সকলেই ঠিক ভেবেছেন৷ আমি সত্যিই বিমূঢ় হয়ে পড়েছি এক তীব্র আবেগের ধাক্কায় ও আমি সত্যিই এই পুরস্কারের যোগ্য প্রাপক নই৷ এ আমার বিনয় নয়, নিছক প্রথাসম্মত লিপ-সার্ভিস নয়৷  এ আমার অন্তরের কথা৷

‘‘আজ এই মঞ্চ থেকে আপনাদের বিস্মিত করা জন্যেই আমি একটা পুরানো তথ্য তুলে ধরতে চাই৷ এতক্ষণ ধরে অন্যান্য গুণিজনরা আমার সম্বন্ধে যেসব ভারী ভারী ও মনোহর বিশেষণ প্রয়োগ করলেন, তার পরে এই কথাটা শুনলে  অনেকেই বিশ্বাস করবেন না৷  কিন্তু কথাটা সত্যি৷ আমি  ছোটবেলায় অঙ্কে দারুণ কাঁচা ছিলাম৷ ‘‘শুধু কাঁচা বললে কিছুই বলা হল না৷ ওই বিষয়কে প্রচন্ড ভয় পেতাম  আমি৷ অঙ্কের  নাম শুণলে  আমার গায়ে   জ্বর আসত৷  অঙ্কের ক্লাসকে মনে হত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প৷ অন্তত ক্লাস সিক্স অবধি, যতদূর মনে পড়ে আমার অঙ্কের নম্বর পাঁচ পেরোয়েনি  কখনও৷ হ্যাঁ, ঠিকই  শুণলেন আপনারা৷ পাঁচ!

‘‘আমাকে  অঙ্কে  মজবুত  করার জন্যে আমার অভিভাবকরা  অনেক খুঁজে পেতে  এক জাঁদরেল টিউটর জোগাড় করেছিলেন৷ গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করার জন্যে  খ্যাতি ছিল তাঁর৷ ইয়াববড় গোঁফ, মোটা ভুরুর নিচে আগুনে চোখ, হাতে বেতের ছড়ি৷  গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর৷ মাঝে মাঝে যখন ধমকাতেন, আওয়াজটা মেঘগর্জনের  মতো লাগত৷ ঘড়ি ধরে দু’ঘন্টা, সপ্তাহে  চারদিন তিনি  আমাকে হামানদিস্তের মধ্যে ফেলে অঙ্কের  মুগুর দিয়ে থ্যাঁতলাতেন৷ এই  বুড়ো বয়সে  আর লুকিয়ে লাভ নেই, সেই টিউটরটিকে  আমি সাক্ষাৎ যম  মনে করতাম৷ যেদিন -যেদিন তাঁর আসার কথা, সকাল থেকেই  আমার  হাত-পা ঘামতে শুরু করত৷

‘‘তাঁর পড়ানোর পদ্ধতিও ভয়াবহ ৷ প্রশ্ণমালার  পর প্রশ্ণমালা অঙ্ক গড়গড় করে কষে দিতেন খাতায়, বুঝেছি  কি বুঝিনি সে-বিষয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যাথা ছিল না৷ নিজের কষা  শেষ হলেই  নির্দেশ  দিতেন, অন্য খাতায়  সেই অঙ্কগুলিই কষতে হবে আমাকে৷ না পারলেই  বেদম প্রহার৷ প্রাণের  দায়ে আমি  ওই কষানো  অঙ্কগুলিকে  দাঁড়ি কমা -সমেত  মুখস্থ করার চেষ্টা  করতাম৷ তার ফল  হত, মোক্ষম সময়ে  উল্টোপাল্টা হয়ে যেত  সব, স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করত, বুদ্ধিতে  জট পড়ে যেত৷  বাড়িতে মার খাওয়ার  মাত্রা যত বাড়ত, তত কমত পরীক্ষায় নম্বর৷  আর ততই তীব্র হত অঙ্কের ভীতি৷ ‘‘সিক্সের হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষায় একশোর মধ্যে শূন্য পেলাম৷

‘‘তখন আমার  জ্যাঠামশায় একদিন  সেই  বিভীষণ-টিউটরকে বিদায় দিলেন৷ বাবাকে বললেন, একটা লোক আছে হাতে, অঙ্কটঙ্ক জানে শুনেছি....কিন্তু বেজায় গরিব৷ টিউশনি খুঁজছে৷ ফর আ চেঞ্জ, একবার  দেখাই যাক না৷ যদি বুঝিয়ে-টুঝিয়ে মাথায় কিছু ঢোকাতে পারে!  মেরেধরে তো কিছু হল না৷

‘‘আমার বুকটা কিন্তু টিপ টিপ করছিল৷  আবার নতুন মাস্টার! তপ্ত চাটু  থেকে গনগনে উনুনে এসে পড়ব না তো! ঠাকুরকে  ডাকছিলাম যাতে চেহারাটা দেখেই হৃদকম্প না হয়, যেন একটু নরম সরম মানুষ অবশ্য ভরসা পাচ্ছিলাম  যে খুব, এমনটা নয়৷  অঙ্কের মাস্টাররা দুনিয়ার কঠোরতম মাস্টার  ও ভয়ঙ্করতম মানুষ হয়ে থাকেন---এই ধারণাটা বদ্ধমূল ছিল আমার মনে৷

‘‘কিন্তু যেদিন বিকেলবেলা জ্যাঠার পিছন পিছন আমাদের বাড়িতে  ঢুকলেন নতুন  টিউটর, আমি ভয় পাওয়া তো দূরের কথা একটু হেসেই ফেললাম৷

‘‘একী... মাস্টারমশাই আবার এরকম হয় নাকি? রোগা ডিগডিগে মাথায় উড়োখুড়ো একরাশ চুল, খোঁচাখোঁচা দাড়ি, জামাকাপর তেমন আলুথালু ময়লা মতন৷চোখে মোটা কাঁচ লাগানো কালো ফ্রেমের চশমা৷ একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে মানুষটা, কীরকম যেন সংকুচিত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে৷ কাঁধে একটা ছেঁড়া ব্যাগ , তার চেনটাও কাটা একতারা কাগজ উঁকি মারছে সেটা থেকে৷  আমি ভয় পাব কী এ মানুষটাই তো সিটিয়ে রয়েছে সর্বক্ষণ৷

‘‘প্রথম দর্শনেই  ভয়টা একদম  কেটে গিয়েছিল আমার৷  তাই বেশ স্মার্ট ভঙ্গিতে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম৷ আমার নতুন মাস্টার মশাইতো খুব সংকুচিত ভঙ্গিতে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন আমার পিঠে, তারপর সেই অপরাধী অপরাধী চাউনিতে একবার পর্র্দ ঝোলানো দরজার দিকে তাকিয়ে নিলেন৷  খুব গোপন কথা বলছেন এইভাবে ফিস ফিস করে আমাকে  জিজ্ঞেস  করলেন, ‘তুমি অঙ্কে খুব কাঁচা?’’

‘‘আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম৷ উনি বললেন, ‘ভয় পাও খুব?’

‘‘আমি ঘাড় নাড়তে কিছুক্ষণ চুপ  করে রইলেন, তারপর গলাটা আরও  একটু  নামিয়ে  করুণ মুখে বললেন,‘‘আমিও ৷ কাউকে বোলো না কিন্তু৷’

‘‘আমি হাঁ করে তাকিয়ে৷ আর-একটু  ঝুঁকে এসে আমার নতুন অঙ্ক -স্যার বললেন, ‘টিউশনটা চলে গেলে খেতে পাব না , জানো? ঝপ করে রাজি হয়ে গেছি৷ কিন্তু অঙ্ক আমি তেমন পারি-টারি না৷ ভয়ও পাই শক্ত অঙ্ক দেখলে৷ এখন তুমিই আমার ভরসা৷

‘‘আমি তুতলে-মুতলে  একাকার, ‘আ-আমি ক-কি করে ভ-র.....

‘‘স্যার আমার হাতের মুঠো ধরে ফেলে বললেন, ‘তুমি একটু সাহায্য কোরো আমায়৷ আমি তো প্রায় সল্ভ করতে গিয়ে আটকে যাব, তুমি মাথা খাটিয়ে উত্তরে দিও সে সব জায়গাগুলো৷ তোমার কমবয়সী ব্রেন, ফ্রেশ বুদ্ধি... তুমি ঠিক পারবে৷ আর কাউকে যেন কিচ্ছুটি বলে ফেলো না, খুব বিপদ হয়ে যাবে আমার...

‘‘বিস্ফারিত চোখে নতুন মাস্টারমশাইকে দেখছিলাম আমি৷  কীরকম কাঁচুমাচু  মুখ, কাঁদো-কাঁদো স্বর! চোখ দুটো দেখে ভারী মায়া এল৷ হঠাৎ মনে একটা কীরকম  একটা অদ্ভূত জোর এল৷ আপনারা জানেন, সহানুভূতি কত তীব্র একটা আবেগ...বিপন্নকে  সাহায্য করার জন্য  ভিতু, দুর্বল মানুষও এক নিমেষে প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কখনো কখনো!  আমারও সেইরকমই মনে হলো৷ কোনও একটা ভাল কাজ করার ইচ্ছে জাগলে  যেমনভাবে স্নায়ুরা চনমনিয়ে ওঠে, তেমনই উদ্দীপনা টের পেলাম বুকের মধ্যে৷  ঠিক করলাম, বাঁচাতেই হবে মানুষটাকে! তার জন্য নিজে নিজে  অঙ্ক কষা চাই৷ কষব ঠিক৷ মাথা খাটাব ভাবব অঙ্ক নিয়ে, প্রাণপণ চেষ্টায়  আয়ত্ত করব সমাধানসূত্রগুলোকে৷ যদি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাই, লোকে যদি বোঝে আমার উন্নতি হয়েছে--- তবে এঁর চাকরিটা থাকবে৷

আহা, মানুষটা বড় অসহায় যে!

‘‘আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, পরের দিন থেকেই  অঙ্কের  ভয়টা কর্পূরের মতো উবে গেল আমার মন থেকে! সব সাবজেক্ট ছেড়ে অঙ্কের বই নিয়ে  পড়ে রইলাম দিনরাত৷  উদাহরণ দেখে দেখে চ্যাপাটারের পর চ্যাপ্ঢার বুঝতে শুরু করলাম৷ রোখ চেপে গিয়েছিল যেখানটা জটিল লাগছে  সেখানটা নিয়ে রগড়াচ্ছি ঘন্টার পর ঘন্টা৷ দেখছি শেষ অবধি ঠিক খুলে যাচ্ছে জট৷ নিজেই অতিক্রম করছি সব বাধা৷ একটাই লক্ষ্য মাস্টার মশাইকে বাঁচানো৷ সপ্তাহ তিনেকের মধ্যের টের পেলাম , অঙ্ক কিলবিল করছে মাথায়৷ সমস্যা দেখামাত্র সমাধানের সুত্রগুলো  স্টেপ বাই স্টেপ বুঝতে পেরে যাচ্ছি৷ আর একটা জিনিষ এতদিন বুঝতে পারিনি--- একটা শক্ত অঙ্ক কষে ফেলার মধ্যে  যে এত আনন্দ  লুকিয়ে আছে জানতামই না আগে৷

‘‘মাস্টার মশাইও খুব চেষ্টা করছিলেন৷ কিন্তু তিনি প্রায়ই আটকে যেতেন৷ কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকা প্রায় পাল্টাপাল্টি হয়ে গেল৷  হয়তো একই অঙ্ক দুটো খাতায় দুজন কষে বার করব বলে লড়ছি৷ আমার উত্তর বেরিয়ে গেল, তিনি  তখনও কাটছেন  আর কাটছেন৷ ‘এঃ হে, তুমিই তো আগে করে ফেললে... কী প্রসেসে করলে একটু  বুঝিয়ে দাও দেখি, বলে করুণ হাসলেন৷ আমিই যেন মাস্টারমশাই, এরকম ভঙ্গি করে আমি তাঁকে বোঝাতে শুরু করলাম৷ ‘ওহ, এই ব্যাপার , বলে, যেন নিজের লজ্জা  ঢাকতেই , আরও শক্ত একটা অঙ্ক দেখিয়ে তিনি বললেন, এটা কিন্তু অত সহজে  হবে না মনে হচ্ছে! আমার  মাথায় জেদ চেপে যায়৷ চোয়াল শক্ত করে ভুরু কঁুচকে মগজ  খাটাই, তারপর ঠিক রাস্তাটা বেরিয়ে যায় কিছুক্ষণের  মধ্যেই ৷ মাস্টারমশাই এর মুখ সরল হাসিতে মাখামাখি৷ বললেন, ‘তোমার তো দারুণ মাথা৷ পরীক্ষায় পারবে তো সব ঠিকঠাক?  দেখো বাবা, আমার টিউশনটা থাকে যেন....! ততদিনে বিপুল আত্মবিশ্বাস তৈরী হয়ে গেছে  আমার৷  বলতাম, দেখে নেবেন শুধু, হ্যাঁ!

‘‘কখনও আবার মাস্টার মশাই কোত্থেকে সব খিটকেল অঙ্ক বেছেগুছে নিয়ে আসতেন৷ বলতেন, ‘এগুলো আমি একদম ধরতে পারছি না৷ দ্যাখো তো, তোমার ব্রেনে যদি কিছু আসে...বড্ড শক্ত, তুমিও বোধহয় পারবে না...৷ রক্ত গরম হয়ে উঠত শুণে৷  পারব না! ‘দ্যাখো তো, তোমার ব্রেনে যদি কিছু আসে ... বড্ড শক্ত, তুমিও বোধহয় পারবে না৷....’ রক্ত  গরম  হয়ে উঠত এ কথা শুনে ৷  পারব না! খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে পড়তাম আমি, এদিক সেদিক দিয়ে মাথা খোঁড়াখুড়ি করতাম৷ পাশে বসে  মাস্টার মশাইও একটা-দুটো ক্লূ হাতড়াতেন ৷  তারপর একসময় ‘ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে ঊঠতাম আমি, গড়গড় করে সমাধান করে ফেলতাম, কৃতজ্ঞ গলায় মাস্টারমশাই বলতেন, ‘উফ, ভাগ্যিস তুমি ছিলে....’৷ ইশকুলের স্যাররাও বেশ অবাক হচ্ছিলেন৷ ক্লাসে যে অঙ্কই দেওয়া হোক, সবার আগে করে ফেলছিলাম আমি৷ অবিনাশ স্যার একদিন বলেই ফেললেন, তোর নিরেট মাথাটা কোন ম্যাজিকে  এরকম খুলে গেল রে! বিশ্বাসই হয় না! ফস করে বলে ফেললাম , ‘এবার অ্যানুয়াল পরীক্ষার নম্বর দিতে গিয়েও আপনার বিশ্বাস হবে না, স্যার৷’

বাড়িতে কিন্তু  মাস্টারমশাই ওই কথাটা শুনে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ওরকম আগে থাকতে বড়াই করতে নেই৷ যদি পরীক্ষায় আগেকার মতো সব ভুলে টুলে যাও!’

‘‘আমি স্থির চোখে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘ভুলে যাব কী করে? আমার মগজে এখন অঙ্ক ঠাসা থাকে জানেন না? আর কারও জন্যে না হোক , আপনার জন্যে পারতেই হবে আমাকে, তাই না?’

‘‘সেই প্রথম তাঁর ভিতু-ভিতু চোখ দুটোকে আমি চিক চিক করে উঠতে দেখছিলাম৷ অশ্রুতে নাকি উত্তেজনায়---তখন বুঝে উঠতে পারিনি৷’’

গ্লাস থেকে জল খেলেন ডক্টর স্যানাল৷ গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, ‘‘আর বেশি সময় আমি ব্যয় করব না৷ অনেক ধৈর্য্য নিয়ে শুনছেন আপনারা, কিন্তু গল্প এবার শেষ হয়ে এসেছে

‘‘রেজাল্ট যেদিন বেরোল, সেদিন স্কুলের স্যারেরা হতবাক হয়ে গেলেন৷ একদম আষাঢ়ে গল্পের মতো শোনাবে আজও৷ যে-ছেলে জীবনে কখনও দু’অঙ্কের নম্বরও ছুঁতে পারেনি, সিক্স থেকে সেভেনে উঠছে সে এক্কেবারে তিন অঙ্ক নিয়ে৷ একশোয় পাক্কা একশো! মিরাক্ল্ বললেও কম বলা হয়৷তিনবার দেখা হয়েছে অঙ্কের খাতা, একটা নম্বর কমাতে পারেননি অবিনাশ স্যার!

‘‘রেজাল্ট নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেই বাবাকে বললাম, ‘আমাকে এক্ষুনি মাস্টার মশাইয়ের কাছে নিয়ে নিয়ে চলো! তাঁকে না দেখানো পর্যন্ত  আমার ছটফটানি কমবে না, বেশ বুঝতে পারছিলাম৷

‘‘বাবার মুখটা দেখলাম কেমন গম্ভীর৷ চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ আমি যে এত ভাল রেজাল্ট করেছি তাতে কোন উচ্ছ্বাস নেই৷ খুব শান্ত, নিচু গলায় ধীরে ধীরে বললেন , ‘‘হ্যাঁ, তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাব বলেই অপেক্ষা করছি৷’’

‘‘একটু থেমে যোগ করলেন, তিনিও তোমাকে দেখতে চান৷’’

আমাদের গাড়ীটা কিন্তু কোন বাড়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল না৷ ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম , সামনে একটা হাসপাতালের গেট!

‘‘বাবার  মুখের দিকে তাকালাম৷ কী ব্যাপার ....এখানে?

‘তোমার মাস্টারমশাই  খুব অসুস্থ৷

পরশু থেকে অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন৷ আমরাই খবর পেয়ে তাঁকে ভরতি করেছি হাসপাতালে৷ কিছুক্ষণ আগে একটু জ্ঞান ফিরেছে, কেবলই তোমাকে খুঁজছেন....’  বাবা হঠাৎ চুপ করে গেলেন৷

‘‘আমার গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে এল৷ চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম ওয়ার্ডের গলি ধরে৷ অনেকগুলো মোড় ঘোরার পর মাস্টারমশাইয়ের  বেড৷ নিঃশব্দে পাশটিতে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ এই দু’তিন দিনেই তাঁর রোগা শরীর একদম বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে৷ চোখের কোনে গভীর কালি৷ তবু  আমার মার্কশিটটা দেখে মুহূর্তের জন্য উজ্বল হয়ে উঠল তাঁর চোখ৷ কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল, আমার হাতদুটো নিজের মুঠোয় চেপে ধরছিলেন বারবার৷ তখন আর একবার মাস্টারমশাইয়ের করুণ চোখদুটিতে আমি অশ্রু চিক চিক  করে  উঠতে  দেখেছিলাম৷ প্রাণপণ ভাঙা-ভাঙা স্বরে হাঁফাতে হাঁফাতে বাবাকে বললেন ‘আপনাকে ...যা বলেছিলাম দেখবেন... ঠিক যেন....

‘‘বাবা আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আপনি সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন৷’

থামলেন অশেষ সান্যাল৷ মাথাটা নিচু করে রইলেন কিছুক্ষণ, মাইক্রোফোনের ধাতব দণ্ডটা চেপে ধরলেন মুঠোয়৷ ঢোক গিললেন একবার৷ তারপর একটা শ্বাস চেপে নিয়ে বললেন, সেই তাঁকে আমার শেষ দেখা৷  সেই রাত্রেই তিনি মারা যান৷ তাঁর মৃতদেহ আমাকে দেখানো হয়নি৷

‘‘পরের দিন রাত্রে বাবা আমাকে ডাকলেন৷ বললেন, ‘তোমার মাস্টারমশাই তোমাকে এটা দিয়ে গেছেন৷’

দেখলাম একটা ফিতে বাঁধা মলিন ফাইল৷ তাঁর মধ্যে গোটা তিনেক ডাইরি আর কয়েক দিস্তে কাগজ৷ নীল কলির কলমে কষা অদ্ভূত অদ্ভূত অঙ্কে ভর্তি৷ প্রচুর কাটাকুটি, তার ফাঁকে ফাঁকে অজস্র সংখ্যার  মেলা৷

‘‘এসব  অঙ্কের বিন্দু বিসর্গ আমার জানা নেই৷ শুধু হাতের লেখাটি খুব চেনা৷ আর  ওই হিজিবিজি কাটাকুটির ধরণটিও৷

‘‘সব হায়ার ম্যাথামেটিক্স৷  গবেষণামূলক কাজ৷ মানুষটা যে এতবড় গুণী, তা আমরা কেউ বুঝতে পারিনি, বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘রিসার্চটা শেষ করে যেতে পারলেন না৷  সাধারণ লোকের পক্ষে এর মর্ম বোঝা সম্ভব হবে না৷  কিন্তু এই সমস্ত  কাজ উনি তোমায় দিয়ে গেছেন৷ বলে গেছেন, তুমি যেন বড়ো হয়ে এই গবেষণাটা শেষ  করো...এই তাঁর ইচ্ছে৷ আর্শীবাদ করে গেছেন , এই কাজটাতে সফল হয়ে তুমি দেশের মুখ উজ্জ্বল কোরো৷’’

চশমা খুলে ফেলেছেন অশেষ সান্যাল ৷ মুছছেন কাচ দুটো৷ মুছেই চলেছেন৷ দর্শকমন্ডলীর মধ্যে সূচ-পড়া স্তব্ধতা৷ একটু কাশলেন গণিতবিদ, একটু দম নিলেন৷ নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে উদগত আবেগকে চাপার চেষ্টা করলেন বুঝি৷

‘‘আমার গলাটা যে বার বার ধরে আসছে, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন ৷ হ্যাঁ, মহাশয়গণ, আমি আমার কান্নাকে নিয়ন্ত্রণ করার অক্ষম চেষ্টা করছি কেবল৷ আর বিশেষ কিছু বলারও নেই, শুধু যে কথাটা ইতোমধ্যে আপনারা বুঝেই ফেলেছেন সেটাই  আমি নিজের মুখে স্বীকার করতে চাই সবার সামনে৷ হ্যাঁ, আমার ঋণ৷ আমার স্বর্গত মাস্টারমশাইয়ের কাছে৷ যিনি আমার সামনে অভিনয় করছিলেন, নিজে অঙ্ক পারেন না এই বলে উশকে দিয়েছিলেন আমার ঘুমিয়ে থাকা চেতনাকে৷ ছাত্রকে  উজ্জীবিত করার জন্যে যে শিক্ষক সমস্ত ইগো বিসর্জন দিয়েছিলেন যিনি বদলে দিয়েছিলেন আমার জীবন৷

‘‘না, এইটুকু বললে বোধহয় ঠিক বলা হল না৷ শুধুই কি বদলে দিয়েছিলেন? না, না৷  সত্যি কথাটা এই যে, তিনিই আমাকে আজকের এই জীবনটা দিয়ে গেছেন৷ হি মেড হোয়াট আই অ্যাম৷ এই পুরস্কারও তাঁরই পুরস্কার৷ এই যে বিপুল সম্মান আজ বর্ষিত হল আমার ওপর, মৌলিক সংখ্যার অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে যে গবেষণার জন্যে এই শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার পেলাম  আমি---এ সবই আমার দরিদ্র, অখ্যাত মাস্টারমশাইয়ের স্বহস্তে কেটে তৈরী করা পথে  হেঁটে আসার ফল৷ তাঁর সেই ডাইরি  আর কাগজগুলোতে তিনিই গোড়াপত্তন  করে গিয়েছিলেন এই গভীর ও মহৎ অনুসন্ধানের৷ আমি সেগুলোকে তাদের লক্ষ্য পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি, এইটুকুই আমার যোগদান৷

‘‘সুধীবৃন্দ, আমার  এই পুরস্কারের সমস্ত অর্থ দিয়ে আমি একটি তহবিল গড়ব বলে মনস্থ  করেছি৷ গণিতে বিরল মেধার  অধিকারী অথচ দুঃস্থ, এমন ছাত্রদের নিয়মিত বৃত্তি দেওয়া হবে এ থেকে৷ নাম হবে শিবনাথ সরকার মেমোরিয়াল স্কলারশিপ৷

‘‘হ্যাঁ, এই শিবনাথ সরকারই ছিলেন আমার ছোটবেলার সেই অঙ্কের মাস্টার মশাই৷

‘‘হি মেড মি হোয়াট আই অ্যাম’’৷