সমাজ বিপ্লবের রণকৌশল

লেখক
মোহন সরকার

একটি ফুল  অথবা  একটি ফুলের মালা৷ কোনটি অধিক নয়নাভিরাম? সকলেই বলবেন মালাটি৷  কেননা মালাটি বহুফুলের বৈচিত্র্যের  সমাহার৷ তবে এর পাশাপাশি আর  একটি তথ্য মনে রাখতে হয়, মালাটির সৌন্দর্য ও চমৎকারিত্ব পরিপূর্ণভাবে প্রতিটি ফুলের সৌন্দর্য্যেকে আশ্রয় করেই৷

অনুরূপভাবে মানব সমাজ বহু ব্যষ্টির ও তাদের সাংসৃকতিক মনস্তাত্ত্বিক ও বৌদ্ধিক বিভিন্নতার সমবায়ে ও বৈচিত্র্যে অনুরণিত এক সুৃহৎ পুষ্পোদ্যানের মত৷ মানুষে মানুষে যে মনস্তাত্বিক পার্থক্য ও বৈচিত্র্য তা মানব সংস্কৃতির প্রগতির  পক্ষে একটি  প্রধান উপাদান৷ বিশেষ সময় ও সুনির্দিষ্ট  ভূখণ্ডে যখন একটি  বিশেষ সাংসৃকতিক অভিস্ফূরণ ঘটে তখন ঝতে হবে তৎ সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীর পক্ষে  সেটিই একটি দৃঢ় ভাবগত ঐতিহ্য নির্র্মণ করেছে৷ এক কথায়  এই ভাবগত  ঐতিহ্য তথা ভাবপ্রবণতাগত বৈশিষ্ট্য বিশেষ  কোন জনগোষ্ঠীর  সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংসৃকতিক জীবনযাত্রার ফলশ্রুতি৷ এই ভাবগত  প্রধান ত্রিবিধ অবলম্বন--- সংস্কৃতি, ভাষা ও সামজিক রীতি৷ এই তিনের সমবায় সমাজের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে চলে৷

সুতরাং পুষ্প পরিচর্র্যকারী যেমন সমান মমতা  ও সমান আগ্রহের সঙ্গে উদ্যানের সমস্ত ফুলের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত থাকেন তেমনই মানবসমাজের প্রতিও আমাদের সেইরকম সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ চাই৷  ইতিহাসের শিক্ষা এই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দর্শনের আবির্র্ভব হয়েছে ঠিকই কিন্ত মানব সমাজের  সার্বিক প্রগতির পক্ষে কোনটিই উপযুক্ত নির্দেশনা যোগাতে পারেনি৷

আজকের মানবসমাজ এক চরম সংকটমুহুর্তে এসে  উপনীত হয়েছে৷ দেখা দিয়েছে  সার্বিক  অবক্ষয়৷ সর্বক্ষেত্রে সমস্যার  পাহাড়  সৃষ্টি হয়ে সমাজের অগ্রগতির পথকে  রুদ্ধ করে  দিয়েছে৷ তাই এই সময় সমাজে এমন একটি  সর্বানুসূ্যত সামাজিক অর্থনৈতিক অর্থনীতিক সাংসৃকতিক দর্শনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে যা ভৌতিক (স্থূল জাগতিক), মানসিক ও আধ্যাত্মিক --- তিন স্তরে পরিব্যাপ্ত থেকে সমাজের সর্ববিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংসৃকতিক  শোষণকে নির্মূল করবে ও মানব সমাজকে দ্রুততার সঙ্গে প্রগতির  পথে এগিয়ে নিয়ে চলবে৷

প্রাউট ঃ ‘প্রাউট মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার  প্রবর্তিত প্রগতিশীল উপযোগতত্ত্ব সংক্ষেপে ‘প্রাউট’ জীবনের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত এমনি এক সমাজ-দর্শন যা বর্তমান সঙ্কটক্ষুদ্ধ যুগ যন্ত্রণার অবসান ঘটাবে৷ বিশ্বৈকতার মর্মবাণীটি সঠিকভাবে এতে  অনুরণিত৷ ‘প্রাউটের’ একটি অন্যতম  প্রধান দর্াী হল, মানব, জীবজগৎ ও উদ্ভিদকুলের সর্বাত্মক  স্বার্থে বিশ্বের সমস্ত  সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ ও যুক্তিসঙ্গত বন্টন৷ সুতরাং ‘প্রাউট’ সরকার  এমন একটি সর্বাঙ্গসুন্দর  সমাজ স্থাপনের গ্যারান্টি  দিতে পারে যা সর্ববিধ শোষণ  ও ভাব জড়তা (ডগ্মা) থেকে মুক্ত৷ ‘প্রাউট’ সমাজ একাধারে  ব্যষ্টি ও সমষ্টির সর্বাত্মক বিকাশের উপযুক্ত পন্থা৷

আর, সমাজের সর্বাত্মক প্রগতিকে বাস্তবায়িত করতে  প্রাউট নিয়েছে  ‘সমাজ-আন্দোলনের’ পথ৷

সম-সংস্কৃতি ও সম-অর্থনৈতিক সমস্যাযুক্ত সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার  উপযুক্ত এক এক এলাকাকে প্রাউট সমাজের একক ইয়ুনিট রূপে  গ্রহণ করেছে৷ আর ওই সম-সংস্কৃতি ও সম-অর্থনৈতিক সমস্যাযুক্ত এলাকা ভিত্তিক মানসিক-অর্থনৈতিক  শোষণমুক্তির আন্দোলনকে সমাজ-বিপ্লবের প্রাথমিক কর্মসূচি রূপে  গ্রহণ  করেছে৷ এই কর্মসূচির নামই ‘সমাজ আন্দোলন’৷’

‘সমাজ আন্দোলন’কে প্রাউটের ব্যবহারিক অভিপ্রকাশরূপে চিহ্ণিত করা যায়৷ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বৈচিত্র্যময় সামাজিক  আর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্যা ও তদনুসারে আন্দোলনের ধারাকে সার্বিক শোষণ মুক্তির পথে অগ্রসর করে দেওয়াই এর মূল লক্ষ্য৷

ট্রান্স ন্যাশানাল কর্র্পেরেশন

অর্থনৈতিক মুনাফার দিকে দৃষ্টিকে পুরোপুরি র্নিদ্ধ রেখে এক সময় যে শিল্প বিল্পব দানা বেঁধে উঠেছিল সেটি তার নিশ্চিন্ত  আশ্রয়রূপে বেছে  নিয়েছিল  গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামোকে৷ এরই   ফলশ্রুতি হল তথাকথিত কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ধারণা৷ কিন্তু  এই তথাকথিত ‘কল্যাণকামী রাষ্ট্রে’র সমস্ত উদ্যোগ বর্তমানে সমর্পিত হয়েছে ব্যষ্টিগত স্বেচ্ছাচারিতা তথা ধনতন্ত্রের পোষকতায়৷ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর পরই  তা ক্রমে ট্রান্সন্যাশানাল কর্র্পেরেশন (টি এন সি)-এর চেহারা লাভ করেছে৷ পৃথিবী জুড়ে কর্র্পেরেশনের উন্নতিও সর্বত্র মানব সমাজকে  আর্থনৈতিক ও মানস -আর্থিক শোষণের শিকারে পরিণত করেছে ও জন্ম দিয়েছে অর্থনৈতিক ঔপনিবেশিকতার৷ এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই  মানব প্রগতি চরমভাবে চোট খেয়েছে৷ শুধু তাই নয় মানুষের মূল্য কেবলমাত্র একটি পণ্য সামগ্রীর স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে৷ ক্রমান্বয়ে সমাজ হয়েছে মানবিকতাবর্জিত ও খণ্ডবিচ্ছিন্ন একতাল জড়পিণ্ডের মত৷ এ বিষয়ে অর্থনৈতিক উন্নত দেশগুলি দ্রুত তাদের সাংসৃকতিক ঐতিহ্য ও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে চলেছে৷ কেননা ট্রান্স ন্যাশানাল কর্র্পেরেশনের  মালিকরা সেই সব দেশেরই নাগরিক৷

রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ

 মারাত্মকভাবে কেন্দ্রীভূত সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রকল্প সমূহ ও উৎপাদন পন্থার ব্যাপক রাষ্ট্রীয়করণ ধনতন্ত্রীদের শোষণ নীতিকেও ম্লান করে দেয়৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ একসময় কমিউনিষ্ট দুনিয়ার কর্র্ত সোবিয়েত ইয়ূনিয়নের নাম করা যায়৷ সেখানে রাষ্ট্র পুঁজিবাদের রমরমা কারুর কাছে গোপন ছিল না৷ সেখানে মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার ওপর চালানো হয় রাষ্ট্রকর্র্তদের স্টীমরোলার৷ দেশের অর্থনীতি  সেনা শক্তির সহায়তায় সচল  রাখা হয়৷ এব্যাপারে জনগণের  কোন রকম মত প্রকাশের  অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়৷ এ  প্রসঙ্গে  একজন  বিশিষ্ট রুশ অর্থনীতিবিদের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য ঃ ‘‘এখন একটি সোবিয়েত  ইয়ূনিয়ন বা একটি সোবিয়েত  অভাবী সর্বহারা অর্থনীতির  অস্তিত্ব নেই৷ একদিকে অর্থনীতি  ও অন্যদিকে সামরিক শক্তি নিয়ন্ত্রিত একচেটিয়া শাসক কম্যুনিষ্ট গোষ্ঠী কাদের হাতে রয়েছে --- এই দ্বিবিধ চেহারা প্রকট৷’’দেশের সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদগুলির ওপর প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীর একচেটিয়া মালিকানা৷ তাই স্বাভাবিকভাবে যে সোবিয়েত ইয়ূনিয়নে  চেকশ্লোবাকিয়া থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পর্যন্ত সর্বত্রই সোবিয়েত উপগ্রহ-রাষ্ট্রগুলিতে সমরসজ্জা বাড়িয়ে চলেছিল৷ অথচ মুখে তারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নিরস্ত্রীকরণ ইত্যাদি মিষ্টি বুলি দিয়ে আসর মাত করার কপটতায় লিপ্ত ছিল৷ বিক্ষুদ্ধ রুশ বিজ্ঞানী নোবেল জয়ী আন্দ্রেই সাখারবের মন্তব্যে এই রূপটি সঠিক ধরা পড়ে৷ তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশ মুখোশের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রেখেছে৷’

আমরা দেখেছি, পরবর্তীকালে  কম্যুনিষ্ট শাসকগোষ্ঠীর শোষণে শোষিত জনগণ বিদ্রোহ  করে ও অত্যাচারী কম্যুনিষ্ট শাসনব্যবস্থাকে  আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে দেয়৷ বর্তমান চীনের অবস্থা অগ্ণিগর্ভ৷  এও সোবিয়েত রাশিয়ার পরিণতির দিকে এগুচ্ছে৷ বিপুল সামরিক শক্তি দিয়ে জনগণের মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে৷

শোষণের তিনটি কারণ

যে তিনটি কারণ সর্বধবংসী শোষণের জন্ম দেয় সেগুলি হল ঃ---

১) বিভিন্ন তথাকথিত উন্নয়ন মূলক প্রকল্প সমূহ  যখন মানুষের  বিবিধ চাহিদার  (সাংসৃকতিক সঙ্কট, আর্থিক পরিস্থিতি প্রভৃতি) সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না, তখন দেখা দেবে শোষণ৷ কেননা আজকের দুনিয়ায়  উন্নত ও উন্নতিকামী সমস্ত দেশগুলিতে অর্থনৈতিক প্রকল্প ট্রান্সন্যাশানাল কর্র্পেরেশন (পুঁজিপতি চক্র) অথবা রাষ্ট্রীয় আমলাদের  দ্বারা রচিত হয়ে থাকে৷ সুতরাং স্বভাবতঃই এই সমস্ত প্রকল্পগুলিতে জনগণের বাস্তব আশা আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষিত থেকে যায় ও শোষণকামী সম্প্রদায়কে মদত যোগায়৷ 

২) মুনাফার অভিপ্রায় ঃ মুনাফামুখী অর্থনীতি শ্রমিকের  উদ্বৃত্ত শ্রমকে আত্মসাৎ করে তাকে আর্থনীতিক, মানস-রাজনৈতিক ও মানস অর্থনৈতিক শোষণের শিকারে পরিণত করে৷ কমিউনিষ্ট দেশগুলিতে রাষ্ট্রীয় আমলাদের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় তারাও নির্বিচারে  সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও চাহিদাকে অগ্রাহ্য করে৷ অন্যদিকে দৈত্যাকার কেন্দ্রিত ধনতন্ত্র ব্যষ্টিগত আর্থিক উদ্যোগগুলিকে স্ফীত করে তোলে৷ গণ-মাধ্যমগুলিকেও মুনাফাকামী শ্রেণীর দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে ও জনগণ তার দাসে পরিণত হয়৷ এগুলিকে সুবিধাভোগী শ্রেণীকে গণশোষণে প্রণোদিত করে৷

৩) যথার্থ সংস্থার অভাব ঃ যে সমস্ত সংস্থাগুলি জনগণের কল্যাণের  উদ্দেশ্যে প্রগতিশীল সামাজিক  অর্থনৈতিক কাঠামো প্রবর্তনে উদ্যোগী হয় ট্রান্সন্যাশানাল কর্র্পেরেশন অথবা রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলি তাদের কাজকর্মে  সর্বতোভাবে বাধা দেয়৷ বর্তমানে প্রায় সমস্ত দেশ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দাবী করে  থাকে বটে কিন্তু  সর্বত্রই শোষণকামী ধনতন্ত্রী সংস্থাগুলির রমরমা অব্যাহত৷ উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে একের পর এক উপগ্রহ-রাষ্ট্র তৈরী করা৷ মূলত বহুজাতিক  কর্র্পেরেশনে সম্পদের  পরিমাণ বিশ্বের দুই  তৃতীয়ংশ দেশের মোট জাতীয় আয়ের চেয়ে বেশী৷

বর্তমান যুগসঙ্কট ও সমাজ

প্রাউটের সমাজ আন্দোলন একদিকে যেমন সমসাময়িক সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলি তুলে ধরেছে, অন্যদিকে মানব সমাজের সাংসৃকতিক সেতুবন্ধনে ব্রতী হয়েছে৷

সর্বপ্রকার মানবিক অভিস্ফুরণকে সংস্কৃতি বলতে পারি৷ আবার অভিস্ফুরণকে প্রভাবিত করে স্থান-কাল-পাত্র৷  প্রসঙ্গক্রমে মানুষের নৃতাত্ত্বিক বিভিন্নতার দিকটি এক্ষেত্রে আলোচ্য৷ মানবগোষ্ঠী প্রধানত চারটি নৃতাত্ত্বিক স্তরের পর্র্যয়ভুক্ত৷ যথা, মঙ্গোলয়েড, নিগ্রোয়েড, আর্য ও অষ্ট্রিক৷ এই যে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্নতার সেই সূত্রেই বিবিধ মানস-আর্থিক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবণতা-জাত বহু বিচিত্র ভাবগত ঐতিহ্যের সৃষ্টি৷ এই সমস্ত ভাবগত ঐতিহ্য স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মানব সংস্কৃতির নানা ধরণের আঞ্চলিক অভিষ্ফুরণ ঘটিয়ে থাকে৷ বর্তমানে  এই ভাবগত ঐতিহ্য মূলত দুটি মৌল উপাদানের  ওপর আধারিত ঃ ১) সংস্কৃতি  যার সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী প্রকাশ মাধ্যম মাতৃভাষা ২) অর্থনৈতিক উপাদান৷ এটি আবার দুটি উপাদানের সঙ্গে অন্বিত ১) অর্থনৈতিক সংকট ২) আর্থিক সম্ভাবনা৷

প্রাউট পরিকল্পিত অর্থনৈতিক সুত্রাবলী

১) প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে৷

২) ব্যষ্টির যোগ্যতার  ভিত্তিতে তাকে অতিরিক্ত সুবিধা দান৷

৩) জনগণের জীবন যাত্রার নূ্যনতম মানের উন্নয়ন সমাজের প্রাণশক্তির নিদর্শন৷

এখন আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিকল্পনার প্রয়োজন ৷ আর নিম্নোক্ত নীতিগুলির ভিত্তিতে ওই পরিকল্পনা করতে হবে৷

(ক) উৎপাদন মূল্য ঃ যথার্থ উপযোগ ভিত্তিক অর্থনীতিতে যে কোন পণ্যের বাজার দর তার উৎপাদন  ব্যয়ের সঙ্গে প্রান্তিক লভ্যাংশ যোগে  স্থির  করা হয়৷ যদি কোন অতাবশ্যকীয় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেশী হয়, তাহলে তার সঙ্গে সামান্য লাভ রেখেই বিক্রয়মূল্য স্থির করতে হবে৷ বিক্রয়মূল্য অলাভজনক হলে ওই অত্যাবশকীয় পণ্যের উৎপাদেেন বিপর্যয় দেখা দেবে৷

(খ) উৎপাদনশীলতা ঃ যেখানে কাঁচামালের সরবরাহ সুলভ সেখানেই  প্রাথমিক (মূল শিল্প) ও মাঝারি মানের  শিল্পস্থাপন করতে হবে৷

তাই প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিকেন্দ্রিত কৃষি-ভিত্তিক শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে৷

(গ) ক্রয়ক্ষমতা ঃ চাহিদা, উৎপাদন, উপযোগ, কর্ম বিনিয়োগ, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ক্রয়ক্ষমতা এগুলি পরস্পর নির্ভরশীল৷ আর্থিক  পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হবে জনগণের ক্রয়ক্ষমতাক বাড়িয়ে তোলা৷ এটি দুভাবে করা যেতে পারে৷ প্রথমত ঃ এ দ্রব্য মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাদের বেতন ও মজুরীর বৃদ্ধি ঘটিয়ে অথবা উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে ও পণ্যের বাজার দর নিচে নামিয়ে এনে৷

(ঘ) সামূহিক চাহিদাসমূহ ঃ সামূহিক চাহিদা হল যে কোন অর্থনৈতিক এলাকার অন্তর্ভুক্ত  প্রতিটি মানুষের পক্ষে প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক পণ্য সমূহের  সরবরাহের গ্যারান্টি৷ ব্যষ্টিগত চাহিদার চেয়ে সামূহিক প্রয়োজনের ওপর বেশী জোর দিতে হবে৷ আর্থিক উন্নতির প্রাথমিক স্তরে বিলাস দ্রব্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর যতদূর সম্ভব কম গুরুত্ব দিতে হবে৷

এছাড়া নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আর যে সমস্ত উপাদানগুলি স্মরণে রাখতে হবে,তার মধ্যে রয়েছে, শিল্প স্থাপনের জন্যে প্রয়োজনীয়  সুবিধা, স্থানিক বৈচিত্র্য, সাংসৃকতিক উপাদানসমূহ ও যোগাযোগ৷ সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লেষণাত্মক রাজনৈতিক কাঠামোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে চাই যৌথ নব্যমানবতাবাদী নেতৃত্ব৷ এই নেতৃত্ব নিজ নিজ ভাবগত ঐতিহ্যের প্রতিনিধিও হবেন৷ অর্থনীতি হবে বিকেন্দ্রিত ও তা হবে সমবায় ভিত্তিক৷ নৈতিকতা, সামাজিক অর্থনৈতিক চেতনা ও শিক্ষা--- এই তিনের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হবেন৷

বিকেন্দ্রীত অর্থনীতি

প্রাউট ত্রিস্তরীয় বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির পক্ষপাতী৷ তিন ধরনের  শিল্প ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ১) মূল শিল্প ২) মাঝারি শিল্প বা সামবায়িক প্রতিষ্ঠান ৩) ক্ষুদ্র বা ব্যষ্টিগত মালিকানাধীন শিল্প৷

মূল শিল্পের উদ্দেশ্যে হবে অর্থনীতির দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর সেক্টরগুলিতে কাঁচামাল যুগিয়ে ও নানা ভাবে তাদের বিকাশে সহায়তা করা৷

মূল শিল্পের আওতায় পড়বে কয়লা, লোহা, ইস্পাত প্রভৃতি কাঁচামাল উৎপাদন, যোগাযোগ প্রভৃতি৷ যেখানে কাঁচামালের যোগান আছে এমন কোন স্থানে  এগুলি স্থাপিত হবে৷ এর পরিচালন ভার থাকবে স্থানীয় স্বায়ত্ব শাসিত সংস্থা অথবা রাজ্য সরকারের ওপর৷ মূল শিল্পের আর্থিক নীতিটি হবে ‘লাভ নয় ক্ষতি নয়’ (নো প্রফিট নো লস)৷

দ্বিতীয় স্তরের শিল্প ব্যবস্থার আয়তার থাকবে অন্যান্য সমস্ত বড় ও মাঝারি মানের শিল্প সংস্থাগুলি৷  সমবায়ের ভিত্তিতেই এগুলি পরিচালিত হবে৷  প্রশ্ণ উঠতে পারে সারা বিশ্বে যখন সমবায় ব্যবস্থার  ইতিহাস কেবল ব্যর্থতার ইতিহাসে  পর্যবসিত সেক্ষেত্রে কোন্ যুক্তিতে এই সমবায় ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য ? আসলে সমবায় ব্যবস্থার ক্ষেত্রে  বরাবরই  কতকগুলি অপরিহার্য বিষয়  উপেক্ষিত থেকেছে৷ সেগুলি হল, ১) সততা ও নৈতিকতা ভিত্তিক কড়া প্রশাসন, ২) জনগণের সমর্থন ৩) দীর্ঘস্থায়ী চাহিদার গ্যারান্টি ৪) অসুস্থ প্রতিযোগিতার  উন্মাদনা থেকে সমবায়কে রক্ষা করা৷ ৫) সুশৃঙ্খল কর্ম শক্তি প্রভৃতি৷ যদি উপরিউক্ত শর্তগুলি  পূরণ করা হয় তবে এর সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না৷

মুনাফার দিকে লক্ষ্য রেখে যখন বৃহৎ শিল্পগুলি ব্যষ্টির  মালিকানাধীনে আনা হয় তখন সেখানে পুঁজিবাদের আবির্র্ভব অবশ্যম্ভাবী৷ সুতরাং সমাজের  সকল সম্পদের ন্যয়সংগত ও সুষ্ঠু বণ্টনের  স্বার্থে প্রতিটি মানুষের সর্বনিম্ন চাহিদা মেটানোর  গ্যারাণ্টি দিতে হলে ব্যষ্টিকে অবাধ সঞ্চয়ের সুযোগ দিলে  চলবে না৷  তার নির্দিষ্ট সীমা পরিষ্কারভাবে স্থির করে দিতে হবে৷ সমবায়ের প্রতি সরকারের সম্পর্কটি হবে ত্রিমুখী৷ প্রথমত, সরকার সমবায়কে  আর্থিক সহায়তা যোগাবেন৷ দ্বিতীয়ত, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন৷ তৃতীয়ত, সমবায়ের প্রশাসনকে বাহ্যিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখবেন৷ তাতে সরকারী হস্তক্ষেপও বাঞ্ছনীয় নয়৷ এইভাবে সমবায়  ব্যবস্থাকে কার্যকর  করতে পারলে অবশ্যই তা সমাজ থেকে পুঁজিবাদের বিলোপ ঘটাতে সক্ষম হবে৷ সেই সঙ্গে জনগণকে অর্থনৈতিক শক্তির অংশীদার করে তুলতে পারবে৷ এইভাবে সমাজ থেকে বেকারত্বের অভিশাপ মুছে ফেলা যাবে ও স্বয়ং জনগণই তাদের আর্থিক জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হবে৷

ক্ষুদ্র শিল্প অর্থাৎ যার আওতায় পড়ছে ছোটোখাটো দোকান ও ছোটোখাটো ব্যবসা তা ব্যষ্টি মালিকানার অধীনে রাখা যেতে পারে৷ কেননা এই সমস্ত ক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়োগ বাড়িয়ে মাত্রাছাড়া মুনাফা অর্জনের সুযোগ সীমাবদ্ধ৷ অতএব পুঁজিবাদীদের বিকাশের সম্ভাবনা এখানে নেই৷

প্রাউটের ত্রিস্তরীয় আর্থিক কাঠামো সর্বপ্রকারে আর্থিক উন্নতির সহায়ক হবে৷ এটি আর্থিকনীতির ক্ষেত্রে যেমন আপামর জনগণের চাহিদাকে মূল বিষয় করেছে তেমনই ব্যষ্টির স্বাধীনতা ও সামূহিক স্বার্থের মধ্যে একটি সূষম সমন্বয় ঘটিয়েছে৷

এককথায় ধনতন্ত্র ও কমিউনিজমের কুপ্রভাব থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করে একটি সুস্থ আর্থিক নীতির বনিয়াদ রচনা করেছে৷ সকল মানুষের  কল্যাণে সম্পদের যথার্থ উপযোগ গ্রহণ করাই প্রাউটের  অর্থনীতির মূলকথা৷

উযুপক্ত সংঘটন প্রয়োজন

উপযুক্ত সংঘটন ছাড়া আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ তথা প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের নিয়াদ গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ এই প্রয়োজনেই আজ পৃথিবীর  বিভিন্ন প্রান্তে ‘সমাজ-আন্দোলন’ দানা বেঁধে উঠেছে৷ এই সমাজগুলি প্রাউটের বিকেন্দ্রিত অর্থনৈতিক তত্ত্বের ওপর আস্থাশীল, নব্যমানবতাবাদী নেতৃত্বের বিকাশের আগ্রাহী, তথা আপন আপন এলাকার ভাবগত ঐতিহ্যের যথার্থ প্রতিভু৷

ভাবাদর্শ

আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠার জন্যে চাই একটা দৃঢ় ভিত্তিক ভাবাদর্শ৷ মানসাধ্যাত্মিক সমন্তরাল তা হল যথার্থ ভাব৷ এই ভাবের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকবে ভাবাদর্শ৷ তার জন্যে চাই একটা সর্বাত্মক --- সর্বানুস্যূতদর্শন৷ এই দর্শন বিশ্বের সমস্ত সুষ্টু সমাধানের বাস্তব পথ নিদের্শনার দিতে পারবে৷ ‘প্রাউট’ হল সেই ভাবাদর্শ৷

নেতৃত্ব

সমাজের গড্ডলিকা প্রবাহে যারা ভেসে যায়, আত্মসুখবাদী ও তাৎক্ষণিক পরিস্থিতিতে তাদের চিন্তাশক্তি আচ্ছন্ন হয়ে যায়৷ তারা সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে  পারে না৷ অতীতে এ ধরণের ছদ্ম নেতারা সমাজে নানাভাবে শোষণই চালিয়ে এসেছে৷

যারা সাময়িক কোন পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, সমসমাজতত্ত্বের  আদর্শে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, উচ্চ ভাবাদর্শ বাস্তবায়িত করার কাজে অক্লান্তভাবে সমস্ত বাধা বিপত্তিকে তুচ্ছ করে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলতে পারবে, তারাই হলেন প্রকৃত নেতা৷ এই নেতাকে বলা যাবে ‘সদবিপ্র’৷

‘প্রাউট’আদর্শে কীভাবে এই সদ্বিপ্র চরিত্রে গড়ে উঠবে তারও পথ নির্দেশ রয়েছে৷ আধ্যাত্মিক মানবতাবাদী আদর্শের বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে ‘সদবিপ্র’ অর্থাৎ আদর্শ নেতা তৈরী হবে সঙ্গে সঙ্গে সমাজ আন্দোলনের  মাধ্যমে তারা এক এক এলাকার জনগোষ্ঠীর ভাবগত ঐতিহ্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠবে৷  এভাবে  তাঁরা---জনগণের  কাছের মানুষ হয়ে উঠবে৷ জনগণ থেকে জনগণের ভাবগত ঐতিহ্য থেকে দূরে থাকা তথাকথিত ‘ওপরতলা’র মানুষ আদর্শ নেতা হতে পারেন না৷ সমাজ আন্দোলনের মাধ্যমে এইসব ওপরতলাকার মানুষেরা এমনিতেই ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছেন৷

আন্দোলনের রণনীতি ঃ

যে আন্দোলন যথার্থই মানব সমাজের প্রগতির আকাঙ্ক্ষা করে তাকে সমাজের প্রাণশক্তি স্বরূপ ভাবগত ঐতিহ্যের ভূমিতে তাকে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে৷ ভাষা হল সাংসৃকতিক অভিব্যক্তির জোরাল মাধ্যম৷ মানব সংস্কৃতির বিবিধ বিষয়গুলি ভাষার দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে৷ সমাজের প্রতিটি উপশাখা ভাষাকে হাতিয়ার করে সামুহিকভাবে সমগ্র মানব অভিব্যক্তিকে রূপ দেয়৷  বিশ্ব জুড়ে সমাজ আন্দোলন প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ভাষাকে শক্তিশালী করে তুলে সমাজের আর্থিক ও সাংসৃকতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রয়াসী হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে৷ প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মানসিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনার ভিত্তিতেই ওই সব  আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরী করতে হবে ৷ এই পরিকল্পনার  মূল ভিত্তিভূমি হবে ঃ (১) ভাবাদর্শ, কেননা, মাানব অস্তিত্ব এক ভাবাদর্শের প্রবাহ (২) সামাজিক মনস্তাত্বিক পটভূমি (৩) অর্থনৈতিক আদর্শ, (৪) রাজনৈতিক আদর্শ (৫) নব-নেতৃত্ব৷