সন্তান-শিক্ষায় অভিভাবকদের দায়িত্ব

লেখক
সায়ন চক্রবতী

কথায় আছে পশুপাখী সহজেই পশুপাখী,  জন্মসূত্রেই পশুপাখী৷ কিন্তু মানুষ সহজেই মানুষ নয়, মনুষ্যত্ব অর্জন করলে তবে সে মানুষ৷ আর  এই মনুষ্যত্ব অর্জন করার শ্রেষ্ঠ উপায় বা মাধ্যম হল শিক্ষা৷ প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই একজন প্রকৃত  মানুষ হয়ে উঠে৷

একটি শিশু যখন পৃথিবীতে প্রথম আসে তখন তো সে কিছুই জানে না কাউকে চেনেও না৷ ধীরে ধীরে সে একে একে সবাইকে চেনে মা-বাবা, দাদা-দিদিকে... একে একে সব কিছুই জানে এটা কী,ওটা কী৷ কিছু  কিছু বিষয় শিশুরা সহজাত বৃত্তির দ্বারা পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিজে নিজেই শেখে,অনেক কিছু বিষয় আবার শেখাতেও হয়৷ আর শেখানোর জন্যই মানুষের সমাজে গড়ে উঠেছে নানারকমের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ইত্যাদি৷ যা পশু পাখীদের দরকার পড়ে না৷ বাবা মায়েরা নিজের ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তুলতে এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেন৷ অনেকের ধারণা নামি দামী স্কুল কলেজে একবার ভর্তি করে দিলেই ছেলে মেয়েরা আদর্শ মানুষ হয়ে উঠবে৷ কিন্তু সত্যিই কি তাই? বিষয়টা কি এতই সহজ! না একটি শিশুকে  একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলাটা এতটা সহজ নয়৷

এই শেখা আর শেখানোর ব্যাপারে যদি কোনো ত্রুটি থেকে যায় যথেষ্ট প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও একটা শিশু প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে না৷ আজকের তথাকথিত শিক্ষিত সভ্য সমাজে যে অমানুষদের ভিড় দেখি তা ঐ ত্রুটিরই ফল৷ এর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী হলেন শিশুটির ৰাৰা মা৷ তারপর রয়েছে পরিবার পরিজন, সমাজ, শিক্ষক, স্কুল কলেজ সরকার.....ইত্যাদি ইত্যাদি৷

তা তাঁদের অজ্ঞতাই হোক আর কর্তব্যে গাফিলতি  হোক বা  অবহেলাই হোক না কেন ত্রুটিতো রয়েছেই৷ প্রত্যেক মা বাবাই চান নিজের  সন্তান যেন একজন আদর্শ মানুষ হয়ে উঠে, সমাজে ১০ জনের একজন হয়ে উঠে৷ কিন্তু একজন আদর্শ মানুষ বলতে ঠিক কী বোঝায় এই ধারণাটা সবার এক রকম নয়৷ আমরা  নিজের মত করেই একটা ধারণা তৈরী করে নিই আর সেই অনুযায়ীই কাজ করি৷ শিক্ষাটা আসলে একটি শিশুকে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্যই শুধু নয়, শিক্ষা হলো শিশুকে মনুষ্যত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য৷ এইজন্য শুধু পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন কিংবা কারিগরি দক্ষতা অর্জনই যথেষ্ট নয়, এর পাশাপাশি মানবিক গুণাবলীও অর্জন করা দরকার, মানসিক উৎকর্ষতা বিধানও দরকার৷ মনে রাখতে হবে মানুষের জীবনটা হলো ত্রিস্তরীয়---শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক---এই তিনটি স্তরে বিস্তৃত মানুষের জীবন৷ জীবনে সাফল্য পাওয়া বলতে শুধু জাগতিক স্তরে কিছু উন্নতি করাকেই বোঝায় না  তা করতে হবে তিনটি স্তরেই৷

তাই শিক্ষার সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে....‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’৷

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই জাগতিক স্তরে  প্রতিষ্ঠিত হওয়াকেই জীবনের সাফল্য বলে মনে করে৷ আর এই ভুল ধারণার ফলেই জাগতিক সাফল্য পেতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষই অর্থের পেছনে ছুটে চলেছে...অর্থই যেন জীবনের সব কিছু...! জীবনের  শক্তি, সামর্থ্য, সময় সবই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে শুধু জাগতিক চাহিদা মেটাতে গিয়েই৷ ফলে সূক্ষ্ম মানসিক জগৎ তথা আধ্যাত্মিকতার সন্ধান পাওয়া আর হয়ে উঠছেনা..৷ অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেকেই নূ্যনতম নৈতিকতা তথা ন্যায় অন্যায় বোধটুকুও হারিয়ে ফেলছে.. জড়মুখী জীবনে মানসিক শান্তির ব্যর্থ প্রয়াসে মানুষ আজ দিশাহারা৷ তাই দেখা যায় সমাজ সেবায় নিয়োজিত সমাজে  প্রতিষ্ঠিত নেতা, মন্ত্রী, আমলারাও অর্থ পিপাসুদের মতই সরকারী অর্থ আত্মসাত করছে৷ জনগণের কাছ থেকে কাটমানি খেতেও তাঁদের সংকোচ বোধ হয় না৷ এমনকি বিপুল সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও আরও  অর্থের লোভে কেউ কেউ আবার গোরু পাচার করতেও কুন্ঠা বোধ করেনা৷

আজকের এই পরিস্থিতির জন্য বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থাই বেশী দায়ী.....তাছাড়া অনিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থা, দুর্নীতিগ্রস্ত  প্রশাসনও সমানভাবে দায়ী... এই সমস্যা দূর করতে হলে সবক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন দরকার৷

একটি সুন্দর মালা গাঁথতে হলে যেমন সুন্দর সুন্দর ফুল দরকার আর সুন্দর ফুল পেতে হলে আবার একটি সুন্দর বাগান দরকার... ঠিক তেমনি একটি আদর্শ সমাজ গড়তে হলেও আগে আদর্শ মানুষ গড়া দরকার৷

আর আদর্শ মানুষ তৈরী করতে হলে আদর্শ একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে৷ প্রশিক্ষন প্রাপ্ত আদর্শ শিক্ষকও গড়তে হবে৷

আমাদের দেশে একসময় শিক্ষা ছিলো                  নিঃশুল্ক...গুরুকুল আশ্রমের আদর্শ পরিবেশে শিক্ষা দেওয়া হতো৷ আজকাল শিক্ষা জিনিসটা বাজারি পণ্য হয়ে গেছে৷ শিক্ষা নিয়ে রমরমা কারবার চলছে৷ সরকারও শিক্ষাকে শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রি বলেই গণ্য করে৷ বড় বড় শিল্পপতিরা শিক্ষা শিল্পে মোটা টাকা বিনিয়োগ করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে যাচ্ছে৷ পাশাপাশি নিঃশুল্ক সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই অযত্নে অবহেলায় ধুঁকছে...৷ দুর্নীতির কবলে পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থাও ক্রমশ নড়বড়ে হয়ে পড়ছে... উঠছে নানান অভিযোগ৷

এমনই এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে শিক্ষা জগতকে নতুন দিশা দেখালেন মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ যিনি শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি নামেই বেশি পরিচিত৷ শ্রী সরকার আদর্শ মানুষ তৈরীর উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক নোতুন এক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেন৷ যা নব্য মানবতাবাদী শিক্ষা হিসাবে পরিচিত শিক্ষা জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই শিক্ষা ব্যবস্থা গোটা বিশ্বেই ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে৷ একটি শিশুর সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে শরীর চর্চা, চরিত্র ঘটন, নৈতিক,শিক্ষা, আধ্যাত্মিক অনুশীলন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক এই যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ নব্য মানবতাবাদ ভিত্তিক এই যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ এর  ভিত্তিতে স্থাপন হচ্ছে অজস্র প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল যা আনন্দমার্গ স্কুল নামে পরিচিত৷

 

পাঠকদের অনেকেই হয়তো আনন্দমার্গ শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত আবার অনেকেই হয়তো এখনও পরিচিত হননি৷ তা যাই হোক এই কথা জোর দিয়েই বলা যায় এই নব্যমানবতাবাদ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা একটি আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থা৷ শিশু জীবনের ত্রিস্তরীয় বিকাশের একটি নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা৷ যা আগামী দিন মানব সমাজের সার্বিক কল্যাণে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে...৷