আলু চাষীদের সমস্যা সমাধান কোন্ পথে

লেখক
আচার্য তন্ময়ানন্দ অবধূত

এ বছর আলুর ফলন ভালই হয়েছিল৷ আলুর ফলন দেখে আলু চাষীরা প্রথমে উৎসাহিত হয়েছিলেন কিন্তু আলুর ঠিকমত দাম না পাওয়ায় আলু চাষীদের মনে হতাশা দেখা দেয়৷ কারণ আড়াই টাকা তিন টাকা কিলো দরে আলু বেচে আলুর উৎপাদন খরচই উঠবে না৷ তাই অনেকে মাঠ থেকে আলু তোলেন নি অনেকে মাঠে আলু তুলে মাঠেই ডাঁই করে ফেলে রেখেছেন৷ এমন অবস্থায় অকাল বর্ষণের ফলে, আলু পচতে শুরু করেছে মাটি যত শুকোবে পচন ততই বাড়বে৷ এ অবস্থায় আলু চাষীদের মাথায় হাত কী করে মহাজনের কাছ থেকে বা ব্যাঙ্ক থেকে ধার করা টাকা শোধ করবেন---তা নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে৷ অনেকে হতাশায় মানসিক অবসাদে ভুগছেন, কেউ কেউ এর মধ্যে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন৷
কিন্তু দুঃখের বিষয় পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়৷ আমাদের এই ধরনের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কথা ভাবতে হবে৷ প্রাউট–প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার এর স্থায়ী সমাধান দিয়েছেন তাঁর ‘‘কৃষিকথা’’ বই খনিতে৷ তিনি বলেছেন শুধু আলু চাষ না করে একই সময়ে মিশ্র চাষের মাধ্যমে আমরা আরো কয়েকটি শস্য উৎপাদন করতে পারি৷ যেমন আলুর সারির মাঝে মাঝে ফুলকপির চাষ করা যেতে পারে এতে আলু চাষের কোন ক্ষতি হবে না৷ কারণ আলু চাষ হয় মাটির নীচে আর ফুলকপি হবে মাটির ওপরে৷ এছাড়া আলুর আগেই ফুলকপি হয়ে যাবে৷ খেয়াল রাখতে হবে ফুলকপি তোলার সময় শিকড় সমেত টেনে না তুলে শুধু ফুলককিটাকে কেটে নিতে হবে৷ নচেৎ আলু গাছের ক্ষতি হবে৷ আলু চাষের এক মাস পরে জল সেচের জন্যে আলুর দুটো সারির মাঝখানে যে নালা তৈরী হয় সে নালার ওপর শীতের লঙ্কা, বেগুন ইত্যাদি চাষ করাও যেতে পারে৷ এছাড়া আলের জমিতে ক্ষুদ্র প্রজাতির কালো জিরে চাষও করা যাবে৷ এই ধরনের মিশ্রচাষের ফলে মোটামুটি একই সময়ে একই জমিতে চারটি ফসল পেতে পারে৷ চাষিদের হাতে অতিরিক্ত তিনটি ফসলের টাকা এসে যাবে৷ যা চাষীর আর্থিক মানের উন্নতি ঘটবে৷
এবার আলু নিয়েই আলোচনা করি৷ পশ্চিমবঙ্গে যে সব ব্লকে আলু চাষ বেশী হয় সেই সব এলাকায় সরকার সমবায়ের মাধ্যমে আলু কেন্দ্রিক শিল্প গড়তে পারে৷ একদিকে যেমন ব্লকে ব্লকে শিল্প হওয়ার ফলে আলুর বাজার দর সব সময় বেশী থাকবে, চাষীরা অধিক টাকা পাবে, অন্য দিকে এই সব ব্লকে শিল্প হওয়ার ফলে স্থানীয় বেকার ছেলে–মেয়েদের কর্মের সংস্থান হবে৷ পশ্চিমবঙ্গের বেকার সমস্যা দূরীকরণ হবে৷ এখন প্রশ্ণ, আলুকে কেন্দ্র করে কী কী শিল্প গড়া যেতে পারে (১) আলুর চিপস্– এর চাহিদা ভারতবর্ষ তথা ভারতবর্ষের বাহিরে প্রচুর রয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে এই ধরণের শিল্প স্থানীয় মানুষের পুঁজির বিনিয়োগের মাধ্যমে সমবায় পদ্ধতিতে গড়া হলে পুঁজির বিনিয়োগকারীরা যেমন সমবায় থেকে লভ্যাংশ পাবে একই ভাবে স্থানীয় মানুষের নতুন কর্মের সংস্থান হবে৷ স্থানীয় কাঁচামাল, সুলভ শ্রমিক ও স্থানীয় বাজার থাকলে উৎপাদন খরচ কম হবে অর্থাৎ বর্ত্তমান বাজারে আলুর চীপস্ অনেক সস্তাদামে পাওয়া যাবে৷ ফলে সাধারণ মানুষ বেশী পরিমানে এই চীপস্ কিনতে পারবে৷ দ্বিতীয়তঃ আলু থেকে ভালো ্যলকোহল তৈরী হতে পারে যা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় ঔষধের কারখানা তৈরী করা যাবে৷ তৃতীয়তঃ যে সব আলু হিমঘরে রাখার জায়গা হবে না সেই সমস্ত অতিরিক্ত আলু শুকিয়ে ও গুঁড়ো করে টিনজাত বা প্যাকেট জাত করলে মানুষ সারা বছর ধরে সস্তায় আলুর গুঁড়ো থেকে বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য সহজে তৈরী করতে পারবে৷ এই ধরনের আলুর গুঁড়ো অনেক বেশী বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারবে৷ তাই সরকারকে ও রাজনীতিবিদদের অবিলম্বে এই ধরণের শিল্প গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে৷ সরকার তখনি উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয় যখন সচেতন সাধারণ মানুষ সম্মিলিত ভাবে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করবে৷
চাষীকে চড়া দামে আলুর বীজ কিনতে হয়, যা পঞ্জাব থেকে আসে৷ এ রাজ্যের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা কেন্দ্রগুলিতে আলু–বীজ তৈরী করতে হবে৷ তাহলে ভিন্ন রাজ্য থেকে অতিরিক্ত দামে আলু বীজ কিনতে চাষীরা বাধ্য হবে না৷
কৃষি সম্পর্কে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনার অভাবও চাষীদের দুর্গতির কারণ৷ রাজ্যের প্রয়োজনের কথা ভেবে কী পরিমাণ আলু চাষ করতে হবে, সেই পরিকল্পনা তৈরী করে চাষীদের প্রশিক্ষিত করতে হবে৷ আলু ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার ডালের ও সর্ষে সূর্যমুখী প্রভৃতি তৈলবীজের চাষের দিকে চাষীদের উদ্ভুদ্ধ করতে হবে ও প্রয়োজনীয় সুযোগ–সুবিধা দিতে হবে৷ এ রাজ্যকে অন্য রাজ্য থেকে প্রচুর পরিমাণ ডাল ও ভোজ্য তেল আমদানি করতে হয়, এ ব্যাপারে রাজ্যকে স্বয়ংভর করে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া উচিত৷ রাজ্যের প্রয়োজন বুঝে আলুর উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত করলে আলু চাষীরা মার খাবে না৷