আনন্দমূর্ত্তিজীর চিন্তার আলোক

সংবাদদাতা
শশাঙ্কশেখর মৃধা
সময়

শ্রীমদ্ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন–
‘‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত৷
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম৷৷
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্৷
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে৷৷
অর্থাৎ যখন সংসারে ধর্মের অবনতি হয় ও অধর্মের প্রাদুর্ভাব ঘটে তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি৷ সাধু ব্যক্তিগণের পরিত্রাণের জন্যে ও দুষ্ক্র্মকারীগণকে বিনাশ করার জন্যে আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই৷
যুগে যুগে ধরাধামে অনেক মনীষীর আগমন ঘটেছে৷ এই মনীষীদের অবতার বলা হয়েছে৷ যেমন যীশু, গৌতম বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য, রামকৃষ্ণ, লোকনাথ, হজরথ মহম্মদ প্রমুখ৷ তাঁরা সমাজের অনাচার নিরসনের জন্যে শান্তির বাণী প্রচার করেছেন৷ অনেক পরে এসেছেন মনীষী শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তিনি তাঁর ‘প্রাউট’–এর মাধ্যমে হিংসাদগ্ধ পৃথিবীতে শান্তির বাণী প্রচার করেছেন৷
শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার (শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী) বলেছেন–‘মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থার৷’ তাই আনন্দমূর্ত্তিজীর তত্ত্বানুসারে সাধারণ মানুষের শোক, দুঃখ, ব্যথা–বেদনার কথা ভেবে নতুন সমাজ গঠনে তাঁর অনুগামীরা সচেষ্ট হয়ে কাজে রত হয়েছে৷
কিন্তু বাধা অনেক৷ গোলাপের ডাঁটায়ও কাঁটা থাকে৷ ভালোর পিছনে মন্দ ওৎ পেতে থাকে৷ আলোর পিছনে অন্ধকার৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ‘প্রাউট’ বা ধ্যানধারণা বাস্তবে রূপায়নের পিছনে অনেক বাধা৷ প্রাউট অনুসারীরা সেই বাধা পেয়েছেন৷ কিন্তু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আশীর্বাদে তাঁর সন্তানরা কিছুপা নন৷ যীশুকে রাজা হেরডের দলবল কাঁটার মুকুট পরিয়েছিল ক্রুশবিদ্ধ করে ছিল৷ চৈতন্যদেবকে ব্রাহ্মন্যবাদী পাণ্ডারা হত্যা করেছে৷ রামকৃষ্ণের পেছনে হঠকারীদের ষড়যন্ত্র সক্রিয় ছিল, বিবেকানন্দের বিরোধিতা করার লোকেরও অভাব ছিল না৷ আজ সমস্ত বাধা অতিক্রম করে ‘প্রাউট’ এগিয়ে চলেছে সুষ্ঠু সমাজ গঠনের লক্ষ্যে৷
প্রাউট দর্শন, দর্শন জগতের এক যুক্তিপূর্ণ ও অমূল্য অবদান শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ কিন্তু জনগণের মধ্যে তাঁর তত্ত্ব বোঝানো দরকার৷ প্রাউটের আদর্শ কত উচ্চ ও সংকীর্ণতা মুক্ত তা সমাজের মানুষকে বোঝাতে হবে৷ আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন ‘‘আমি আশীর্বাদ করি একদিন তোমরা সমগ্র বিশ্বকে এই উদার, সার্বভৌম, অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করে বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে৷’’ একদা তাঁর স্বপ্ণ সফল হবেই৷ সাধক মানুষের স্বপ্ণ বিফল হয় না৷ কেননা, তাঁর তত্ত্ব যে কল্যাণময় সর্বজনীন৷ আমরা বেদ থেকে অনুধাবন করেছি–‘আনন্দাদ্ধ্যের খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে৷’ প্রাউট দর্শনেও বেদের সেই ধারা নিহিত আছে৷ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ ধারাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে৷ তবেই যে কোন তত্ত্ব সার্থকতা লাভ করতে পারবে৷’’
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন–‘বটবৃক্ষের সম্ভাবনা ক্ষুদ্র বটবীজের মধ্যেই নিহিত থাকে৷ সেইরূপ প্রতি মানুষের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে৷ তাকে জাগাতে হবে৷ আর যিনি জাগাবেন তিনি হবেন সৎপুরুষ৷ যুগে যুগে সৎপুরুষরা তাঁদের সদ্ভাবনায় মানুষকে উজ্জীবিত করে গেছেন৷ অর্থাৎ জড় থেকে চৈতন্যমুখী করেছেন৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ধারণায় এই চৈতন্য ন্তুপ্সুব্দন্তুন্প্সব্ভব্ ‘পরম বন্ধনমুক্ত সত্তা’ বিশ্বকবির ছন্দে ‘আমরা চেতনার রঙে পান্না হ’ল সবুজ৷ চুনি উঠল রাঙা হয়ে৷’ আর বিজ্ঞানবিদ ক্লিফোর্ড–এর ‘Consciousness is the reality which produces in our minds preceptions of the motions of the brain.’৷ তাই মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে৷ এটাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী উদ্দেশ্য৷
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর প্রাউটের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয় চেয়েছেন৷ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের দৃষ্টিতে – ‘Religion without science is blind. Science without religion is lame.’ আসলে বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম নয়, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান নয়৷ দুটিই হাত ধরাধরি করে চলবে৷ তাই সংস্কারমুক্ত হতে হবে৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের প্রচারিত সত্য রবীন্দ্র কবিতায়ও উক্ত হয়েছে–
‘প্রতিমা দিয়ে কি পূজিব তোমারে
এ বিশ্ব নিখিল তোমারই প্রতিমা৷’
আনন্দমূর্ত্তিজীও গাইলেন–
‘তোমারে কি নামে ডাকিব গো,
কিবা হবে তব অর্চনা
লোকাতীত তুমি সবার উপরে
সকল সত্তা তোমার ভিতরে
কোন উপাচারে পূজিব তোমারে,
কোন মন্দিরে করিব স্থাপনা’৷৷
আগে চিত্তশুদ্ধি চাই৷ তবেই মঙ্গলের জন্য কাজ করা যাবে৷ ‘চিত্ত রবে পরিপূর্ণ, অপ্রমত্ত গম্ভীর’৷ মানুষের সৎ ভাবনার পেছনে একটা নীতি বা আদর্শ থাকে৷ আদর্শবিহীন মানুষের মনুষত্বের ঘাটতি পড়ে৷ আদর্শবাদে স্থির লক্ষ্য রেখে চলার উপদেশ আমরা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী কাছ থেকে পেয়েছি৷ ‘নীতিবাদ কোন ভাববাদীর স্বপ্ণবিলাস নয়৷ কোন জড়বাদীর প্রয়োজনপূর্তির ব্যবস্থামাত্রও নয়৷ নীতিবাদ এমনই একটা জিনিস যা লোকায়ত বস্তুভাবকে লোকোত্তর প্রজ্ঞাভাবে মিশিয়ে দেবার সকল সম্ভাবনা নিয়েই মানুষের সামনে হাজির হয়ে থাকে৷’ এই উপদেশানুসারে বলা যায় নীতিবাদ বা আদর্শকে ধরে কাজে অগ্রসর হতে হবে৷ আর লক্ষ্য স্থির করার জন্যে সৎগুরুর নির্দেশ পালন ও সদ্গ্রন্থ পাঠ একান্ত আবশ্যক৷
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বাস্তব জীবনে চলার পথে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন আধ্যাত্মিক সাধনাকে৷ জীবনকে সত্য ও সুন্দরে ভূষিত করতে হলে দরকার হবে আধ্যাত্মিক সাধনা৷ ‘Morality is the base, Sadhana is the means and life divine is the goal.’ স্বামী বিবেকানন্দও ‘Arise, awake and stop not till the goal is reached’ ৷ জীবনে চলার পথ বিপদসঙ্কুল৷ তাই স্বামীজী ‘Face the brutes, Face the nature face the ignorance and illusion. Never fly.’
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বাধার সঙ্গে সংগ্রাম করে লক্ষ্যে পৌছনোর কথা বলেছেন৷ বিশ্বের কোন কোন মনীষী বিশ্বরাষ্ট্রের স্বপ্ণ দেখেছেন৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর ‘নব্যমানবতাবাদ’–এ সেই স্বপ্ণই দেখেছেন৷ তাঁর দৃষ্টি বিশাল ও সম্প্রসারিত৷ তাঁর ব্যাপক দৃষ্টিকোণ–‘বিশ্বস্রষ্টা বা পরমপুরুষ আমার পিতা, পরমা প্রকৃতি আমার মাতা আর ত্রিভূবন আমার স্বদেশ৷’ এই বাণী থেকে তাঁর নব্যমানবতাবাদের ব্যাপকতা উপলব্ধি করা যায়৷ প্লেটো বলে গেছেন ‘Man is the master of all.’ এই বক্তব্য প্রাউট–এর ক্ষেত্রে সমত্ব বহন করে৷ তিনি শুধু মানুষ নয়–জীবজন্তুর কথাও ভেবেছেন ‘সৃষ্টির বুকে মানুষ জাতিই কি সব কিছু না, তা হতে পারে না৷ এই বিশ্বেটা কেবল মানুষকে নিয়েই নয়, অন্যান্য অনেক প্রাণী–জীবজন্তু, বৃক্ষলতা–এরাও তো রয়েছে৷ এদেরও বাঁচার অধিকার আছে৷’ স্বামীজির ভাবনা ও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বক্তব্যের মধ্যে সাদৃশ্য–
‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি
কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর৷
জীবে প্রেম করে সেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর৷৷’
সাধক পুরুষ মানবতাবাদী রামকৃষ্ণও বলে গেলেন ‘যত্র জীব তত্র শিব’৷ মহান পুরুষদের ভাবধারার মধ্যে মিল থাকে৷ গৌতম বুদ্ধও তীরবিদ্ধ হাঁসটাকে বাঁচিয়েছিলেন৷ মানুষ, জীবজন্তু, বৃক্ষলতা সবকিছুকে বাঁচানোই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নব্যমানবতাবাদ •Neo-humanism—৷ অর্থাৎ ‘সর্বজনহিতায় সর্বজন সুখায়৷’ সর্বজনের কল্যাণে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের দর্শন যথেষ্ট সার্থকতায় মণ্ডিত৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী ‘নোতুন পৃথিবী’ গড়তে চেয়েছিলেন৷ সে জন্যে তাঁর তত্ত্ব নব্যমানবতাবাদ৷
সাধ্য অনুসারে কাজ করে যাওয়ার নির্দেশ তাঁর৷ যেমন রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, প্রদীপ বলছে–‘আমার যেটুকু সাধ্য করিবো তা আমি৷’
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, আঞ্চলিক উন্নয়নের পথ ধরে সমগ্র দেশের উন্নয়ন, আর দেশের উন্নয়নের পথ ধরে বিশ্ব উন্নয়নের পতাকা ওড়াতে হবে৷ মানবসত্তাকে সংকোচন, অবদমনে বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে৷ ‘ড্ডপ্সন্তুন্প্তন্দ্ব ম্ভন্দ্বব্দ–প্প্ত্রু ভ্রন্ব্ধড় ব্দপ্ত্ত্র্লন্দ্ব প্পন্দ্বুব্ধ্ত্রপ্তন্ব্ধম্.’–হলে চলবে না৷
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অনুভবে ‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য’– Human society is a singular entity.’ জাতপাত কখনো নয়৷ তিনি বলেন, সম–সমাজতত্ত্বের ভাব নিয়ে অর্থাৎ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে৷ তাঁর মানব প্রেম, জীবপ্রেমের তত্ত্ব যদি মানুষ মেনে চলে তাহলে বিশ্বশান্তি হবেই হবে৷