বাঙালী জাতির অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

লেখক
প্রফুল্ল কুমার মাহাত

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

‘‘অতীতে যাহার হয়েছে যাহার হয়েছে সূচনা, সে ঘটনা হবেই হবে৷ বিশ্বভুবন ভরিবে আবার, বাঙালীর গৌরবে৷’’ ‘‘বাঙলার সেই অতীত গৌরবময় ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে স্ব-মহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত পুনঃ জাগরিত করতে, সমগ্র বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে পথ দেখাতে, উন্নত মহান আদর্শের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে বিশেষ প্রয়াস প্রচেষ্টা প্রয়োজন৷ কারণ একাজ সহজ সাধ্য নয়৷ এজন্য দুর্দমনীয় অধ্যবসায়, ত্যাগ স্বীকার ও সংগ্রামী মানসিকতার প্রয়োজন৷ মহান দার্শনিক সমাজগুরু, সমাজ সংস্কারক, যুগ ত্রাতা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারও এই কথাই বলেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘দ্য টাস্ক ইস গ্লোরিয়াস, দ্য টাস্ক ইজ্‌ নোবেল৷ লিড দ্য লাইফ অফ এ ওয়ারিওয়র এ্যাণ্ড কনসাল্টটেন্টলি, ফাইট এগেনস ইভিলস, ইউ উইল বি ভিক্টোরিয়াস্‌! শো মাচ্‌ এ হেড্‌ মাচ্‌ এ হেড্‌’ ইতিহাস কখনো থেমে থাকে না৷ শাসকগোষ্ঠী রক্তচক্ষু দেখিয়ে মানুষের মুক্তির এষণাকে চিরদিন দাবিয়ে রাখতে পারে না৷ বাঙলা একদিন মোগল সাম্রাজ্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে৷ সংগ্রাম করেছিল৷ আজ আবার হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করার সময় আগত৷ বাঙলার খণ্ড বিখণ্ড রূপকে একত্রিত করে তুলতে হবে বাঙলার স্বার্থে, ভারতের স্বার্থে ও সমগ্র বিশ্বের মানব সমাজের স্বার্থে৷ তাই বলি এগিয়ে চলো বন্ধুরা পাপশক্তি হবে পরাভব, সরিবে দুর্নীতিরাজ৷

‘‘মানুষের জীবন হচ্ছে আদর্শের ধারাপ্রবাহ৷ তার সভ্যতা ও সংস্কৃতি ও সতত গতিশীল, তথা প্রগতিশীল৷ এটাই হচ্ছে প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম, এটাই হচ্ছে ইতিহাসের সাবলীল ধারাপ্রবাহ৷ এর দুর্বার গতিকে কেউ রোধ করতে পারেনি, পারেনা ও ভবিষ্যতেও পারবে না৷ ইতিহাসে তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে৷ ফ্রান্সের স্বৈরাচারী সর্র্বেধবংসীয় সম্রাট  ষোড়শ লুই, অষ্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিক, নাৎসীবাদী জার্র্মন অধিকারী হিটলার ফ্যাসিবাদী নেতা মুসোলিনী, ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ সাম্রাজ্যবাদের উদগাতা কালমার্কস, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের ধারক ও বাহক ব্রিটিশশক্তি প্রমুখ হটকারীর দল ইতিহাসের স্বতঃস্ফুর্ত, স্বাভাবিক সাবলীল গতিকে রোধ করতে পারেনি বা বিপরীত গতিতে প্রবাহিত করতে পারে নি৷ তাই ভারতের হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সকল ষড়যন্ত্র সব রকমের কলা কৌশল বাঙলার চিরন্তন শাশ্বত ঐতিহ্যকে লুপ্ত করতে পারবে না, বাঙালী জাতির সুকঠিন অস্তিত্বকে বিপন্ন বা বিলুপ্ত করতে পারবে না৷ বাঙলার সমুন্নত সভ্যতা সংস্কৃতিকে অবদমিত করে রাখতে পারবে না৷ তাই কবি কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলি--- মেঘ দেখে কেউ করিস নারে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে৷’ হারা শশীর, হারা হাসি, অন্ধকারেই আসে৷

বাঙলা ও বাঙালী একদিন ছিল সমগ্র মানব সমাজের মুক্তির সোপান, তাকে আবার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে ও সেইসঙ্গে শোষণমুক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল বাঙালীস্থান করতেই বাঙালী জনগোষ্ঠীর সঞ্চাচালক ও প্রতিভূ ‘আমর বাঙালী’র জন্ম হয়েছে৷ আমরা বাঙালীর শোষণ বিরোধী আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িকতা বা প্রাদেশিকতা বলা যাবে না, কারণ এর ভিত্তি সংবিধানের বিশেষ ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত৷ বাঙালীস্তানের আন্দোলন আঞ্চলিকতাও নয় কারণ অন্য অঞ্চলের স্বার্থকে বিপন্ন করে এই আন্দোলন গড়ে ওঠেনি৷ এটা সমগ্র বাঙালী জনগোষ্ঠীর  নিজস্ব মাতৃভূমির দাবীতে আন্দোলন ও বাঙালী জাতি বলতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙলার সাহিত্য কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে যারা একাত্মতা অনুভব করে সে সব অধিবাসীকেই বুঝায়৷ এই অর্থে দু’শত বৎসর পূর্বে বাঙলায় মধ্যপ্রদেশ থেকে আগত সাঁওতাল ও আদিবাসী সম্প্রদায়ও বাঙালী৷ এককথায় বাঙলার সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনস্রোতে মিলে মিশে থাকা সবাই বাঙালী৷ মহান  সমাজ সংস্কারক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বাঙলার মতো ভারতের আরও ৪৪টি সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটনের কথা বলেছেন৷ প্রতিটি অঞ্চলের মধ্যে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি থাকবে৷ কোন প্রকার বিদ্বেষ বা বিরোধিতা থাকবে না৷ কোনও অঞ্চলের আর্থিক শোষণ ও অর্থের বহিঃস্রোত থাকবে না৷ শ্রী সরকার এইভাবে সমগ্র পৃথিবীকে দুশো অধিক ২৪৭টি সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিন্যস্ত করার কথা বলেছেন৷ তিনি বলেছেন--- আমাদের এই গৌড় দেশ কে  সামগ্রিকভাবে গৌড় দেশ অথবা পঞ্চগৌড় অথবা বাঙলা বা বাংলাদেশ যেকোন একটা নাম দেওয়া যেতে পারে৷ বাঙালীস্তান বলাও যেতে পারে কারণ যে অর্থে তামিলনাড়ু, রাজস্থান, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম, নামগুলি চলছে হুবুহু সেই অর্থে গৌড়দেশকে বাঙালীস্তান বললেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না৷  ওতে আঁৎকে ওঠার কী আছে? বরং এই নাম এই পরিচিতি বহন করবে যে দেশটা বাঙালীদের মাতৃভূমি৷ বিশ্বের এইসব সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে সকল প্রকার সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে আজ যুগের প্রয়োজনেই দেখা দিয়েছে নোতুন নেতৃত্ব, নোতুন সংঘটন, নোতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শের৷ সে আদর্শও আজ আমাদের হাতে, যার নাম ‘প্রাউট’৷ সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলাদলির উর্ধে উঠে  সব বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শ্রী শ্যামাপ্রসাদ বলেছিলেন---‘‘ আজ রাজনীতির চুলচেরা বিচার নয়, নয় দলাদলি, বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে, বাঙলার লক্ষ লক্ষ মৃত্যু পথ যাত্রী নরনারীকে৷ বাঁচাতে হবে বাঙালী কৃষ্টি সাহিত্য ঐতিহ্যকে৷ আমরা বিশ্বাস করি, এই বেদনাময় হলাহলের মুখ থেকে জেগে উঠবে বাঙলা৷ তার ক্ষতির ক্ষত দিয়ে নিঃসারিত হবে  মহাতেজ, জাগবে রাঙা প্রভাত৷’’ প্রভাত সঙ্গীতে বাঙলার পথ ধরে বিশ্বের অঙ্গনে বিশ্বৈকতাবাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে৷

বাঙলীর যত আশা, বাঙালীর প্রিয় ভাষা,

বিশ্বৈকতাবাদে ফিরে পাক প্রত্যাশা৷৷ (ক্রমশঃ)