বাঙালীর অস্তিত্বের সংকট

লেখক
আচার্য অমৃতবোধানন্দ অবধূত

সম্প্রতি ফেব্রুয়ারী বিধানসভা নির্বাচনে ত্রিপুরায় বিজেপি ও আই.পি.এফ.টি জোট কম্যুনিষ্টদের পরাস্ত করে ক্ষমতায় আসে৷  আই.পি.এফ.টি আসল দাবী রাজ্য ভাগ করে পৃথক তিপ্রাল্যাণ্ড গড়া৷ রাজ্য বিধানসভায় ৬০টি আসনের মধ্যে ৪৪টা আসন নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসে৷ তার আগের নির্বাচনে বিজেপির কোন আসন ছিল না৷ তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল মাত্র ১.৫ শতাংশ৷ দীর্ঘ কম্যুনিষ্ট শাসন ও শোষন রাজ্যবাসী দমবন্ধকরা অবস্থা থেকে বাঁচতে সর্ব ভারতীয় শক্তি স্বরূপ বিজেপিকে শুধু অবলম্বন হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন৷ রাজ্যবাসীর সমস্যার   সার্বিক সমাধানের  লক্ষ্য তাদের কাছে তখন গৌণ ছিল৷ রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পূর্বশর্ত অনুসারে আই.পি.এফ.টি,-র পক্ষ থেকে বিজেপির ওপর তাদের রাজ্য ভাগের দাবীসহ, অন্যান্য দাবী আদায়ের জন্য পরোক্ষ চাপ অবশ্যই রয়েছে৷ রাজ্যের পশ্চাৎপট আলোচনা করলে রাজ্যটা যে আদি বাঙালীস্তানের(বাঙালীদের নিজস্ব বাসভূমির) অংশ ও এই রাজ্যের মঙ্গোলিয়ান গোষ্ঠীভূক্ত উপজাতিরা যে বহিরাগত, তার প্রমাণ স্বরূপ অকাট্য নির্দশন সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে ৷ কি ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক বা ভৌগোলিক , সকল দিক দিয়েই ৷ রাজ্যটির ভৌগোলিক অবস্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে তিন দিকেই রয়েছে বাঙলা, একদিকে মিজোরাম৷ বাঙলার পেটের ভিতরেই তার অবস্থান৷ রাজ্যের বাঙালি ও উপজাতিদের সংখ্যার অনুপাত যথাক্রমে ৭০ শতাংশ ও ৩০ শতাংশ৷ ১৯৭৮ ইং বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাজ্যে জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে সার্বিক উন্নয়নের পথে না গিয়ে, রাজ্যটাকে কম্যুনিষ্ট মুক্তাঞ্চল গড়ার দূরভিসন্ধি নিয়ে তাদের প্রশাসনিক শক্তিকে পাহাড়ি-বাঙালী বিদ্বেষ সৃষ্টির কাজেই নিয়োগ করেছিল৷ সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ১৯৮০ সালের জুন মাসে বিজয় রাঙ্খল-এর নেতৃত্বে উপজাতি উগ্রপন্থী সংগঠন, ঘাতক টি.এন.ভি-কে দিয়ে ‘মান্দাই’ এ বাঙালী গণহত্যা সংঘটিত করে৷ তাতে হাজার হাজার বাঙালী নৃশংসভাবে খুনহন, কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধবংস হয়, কয়েক লক্ষ বাঙালী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন৷ পরে তাহা রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে৷ জন্ম নেয় স্থায়ী বিদ্বেষ৷ যার ব্লুপ্রিন্ট তৈরী করেছিলেন তৎকালীন কম্যুনিষ্ট মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী৷ এইভাবেই রাজ্যে অযৌক্তিকভাবে ষষ্ঠ তপশীল মোতাবেক জেলাপরিষদ লাগু করার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়৷ এদিকে তখন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারও বসে নেই৷ রাজ্যে তাদের উপজাতি ভিত্তিক দল, তথা তাদের জোটসঙ্গী টি.ইউ.জে. এস-এর আবদারে ক্ষমতা দলের স্বার্থে ৪৯ তম সংবিধান সংশোধন করে অযৌক্তিকভাবে ষষ্ঠ তপশীল অনুসারে এ.ডি.সি. বিল কে আইনে রূপদান করেন৷ এখানে ৭০ ভাগ বাঙালী সহ অন্যান্যদের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৩০ভাগ ভূমি, আর ৩০ভাগ উপজাতিদের জন্য বরাদ্দ ৭০ ভাগ ভূমি৷ বর্তমানে ত্রিপুরায় অসমের ধাচে এন.আর.সি চালুর পরিকল্পনা চলছে৷ যেমন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় এলে এন.আর.সি চালু করার হুমকি দিচ্ছেন৷ বিজেপি শ্যামাপ্রসাদের হাতে গড়া দল হলেও তারা যখন বাংলার বাহিরে অবশিষ্ট ভারতে প্রচারে যান তখন দীনদয়াল উপাধ্যায়ের নামেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন৷ ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে ও অসমে বাঙালী হয়ে এন.আর.সি দাবী করা, আর কালিদাসের মত যে ডালে বসে আছে সে ডালের গোড়া কাটা যে একই জিনিস, তা এই হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের দালালরা বুঝে উঠতে পারছেন না৷ ঠিকই একইভাবে ৮০-র দশকে ত্রিপুরায় বাঙালী কংগ্রেস-কম্যুনিষ্টরা ‘এ.ডি.সি দিতে হবে’ বলে বর্র্ষর ব্যাঙের ছাতার মত গলা ফুলিয়ে আত্মঘাতী শ্লোগান দিয়েছিল৷ পরবর্তীকালে দৈবদুর্বিপাকে তৎকালীন কম্যুনিষ্ট মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী সিপি.আই .এম দল কর্তৃক বহিঃষৃকত হন ও তখন রাজ্যের শান্তি ফিরাতে এ.ডি.সি ভেঙ্গে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন৷ বিজেপি এর দার্জিলিং নীতিও বাংলা ও বাঙালীর স্বার্থ বিরোধী৷ বিজেপি-র সমর্থনপুষ্ট সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং, আর দার্জিলিং এর পলাতক নেতা বিমল গুরুং একই ভাষায় কথা বলেন৷ যা বাঙালী স্বার্থের পরিপন্থী৷ তাই বাঙালীর প্রতি বিজেপি এর এই গোপন শত্রুতা আর গোপন থাকছে না ৷ তাই ইংরেজ থেকে শুরু করে বর্তমান সংকীর্ণমনা রাজ্যনীতিকরা তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরনে বাংলা ও বাঙালীর স্বার্থকেই যূপকাষ্ঠে চড়িয়েছেন৷ বঙ্গ, বিহার ও ওড়িশ্যা থেকে অসম নামক প্রদেশকে ১৮৭৪ সালে ইংরেজরা শাসন কাজের সুবিধার অজুহাতে আলাদা করেছিল৷ ঐ সময় কাছাড়, গোয়ালপাড়া ও শ্রীহট্টের মত বিশাল বাংলার অঞ্চলকে যুক্ত  করা হয়েছিল অসমের সঙ্গে ৷ বড়লাট তখন বলছিলেন, আসামিদের মধ্যে থেকেও বাঙালী জাতিসত্তা, ভাষা , সংসৃকতি অক্ষম থাকবে৷

তা আর হল কোথায়?

সেই পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে অগণিত বাঙালীদের এন.আর.সি-এর নামে বিজেপি অনেক এম.পি প্রফেসারদের নাম বাদ দিচ্ছে, অথচ মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি পরেশ বড়ুয়ার নাম রয়েছে৷ যারা বাঙালীদের কোণঠাসা করতে চাইছে , তাদেরকে বাঙালীরা নিজভূমিতে আহ্বান করবে কী?