বাঙলা ও মনিপুরের আত্মিক সম্পর্ক

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

তাই, এ মর্মেই আমার  এ লেখাটির অবতারণা৷ পদ্মা আমার স্পষ্ট বক্তব্য যে, সুবিধা রাজনীতিক, কায়েমী স্বার্থবাদী ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক কিছু সংখ্যক ‘ধান্দাবাজ’ আর হতাশায় বিভ্রান্ত তথা পথভ্রষ্ট এক শ্রেণীর নাগরিকরাই বাঙালী বিদ্বেষকে তাদের ওই নোংরা খেলার মূলধন করে এবার রাজনৈতিক ময়দানে নেমেছে আসর করতে৷ গরম আর কিন্তু বুঝতেই পারছেন না যে, ভ্রাতৃঘাতী এসব প্ররোচনামূলক নির্বুদ্ধিতার অন্তিম পরিণতি হবে অতি ভয়ংকর তার যথেষ্ট বেদনাদায়কও বটে৷ যারা এই বাঙালী হেনস্থার খেলায় মেতে উঠেছেন তারা কিন্তু বুঝতেই পারছেন না,  বাঙালী মণি পুরী এই সেন্টিমেন্টাল ভ্রাতৃ-কলহের আসল ফায়দাটুকু লুটেপুটে নেবারই ধান্দা করে চলেছে কায়েমী স্বার্থখোর তথা হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীভুক্ত শোষকরা আর তাদের বশংবদ তাঁবেদার আর পোষা মগজহীন দালালরা৷ অবশ্য ওইসব লোকেরা নিজের অজ্ঞতা বা অতি সীমিত বাস্তবজ্ঞানের অভাবজনিত কারণেই এই আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠেছেন৷ নতুবা তাদের স্থির মস্তিষ্কে এটুকু অন্ততঃ ভাবা উচিত ছিল যে, মানবসমাজ একটিমাত্র জনগোষ্ঠী দিয়ে কোথাও গড়ে উঠেনি বা সেটা সম্ভবও নয়৷ অন্ততঃ ভারতীয় সংস্কৃতিতে ও সভ্যতায় এমনটা চলতে পারেই না৷ কেননা,বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য’ এটাই হচ্ছে আবহমান কাল থেকে ভারতের মর্মবাণী৷

দ্বিতীয়তঃ আমার স্পষ্ট বক্তব্য যে, বাঙালী জনগোষ্ঠী আর মণিপুরী জনগোষ্ঠী সুদীর্ঘকাল ধরেই একে অন্যের পরিপূরক, তথা সহকারী---উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক আত্মিক তথা নৈকট্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে---বৈরিতাপূর্ণ নয়৷ এর সপক্ষেই নীচে কিছু যুক্তিপূর্ণ আলোচনা বুদ্ধিমান, বিবেকবান ও বিচারশীল পাঠকশীল পাঠকবর্গের উদ্দেশ্যেই তুলে ধরছিঃ---

ভারতের পূর্ব প্রত্যন্তে অবস্থিত মণিপুর রাজ্যের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন৷ এখানকার মানুষ বর্মী ভারতীয় গোষ্ঠীভুক্ত৷ এদেশ সভ্যতা ও  সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যমণ্ডিত৷ চারিদিকে পর্বতবেষ্টিত একটি সুরম্য সমতল ভূমি নিয়ে হল এই মণিপুর রাজ্যটি৷ প্রাচীনকালে চারপাশের পর্বতের মাঝখানে ছিল অতি বৃহদাকারের এক হ্রদ--- লোগতাক হ্রদ৷ পরে ধীরে ধীরে ক্ষয়িত পর্বতমালা থেকে নুড়ি,পাথর, পলিতে এই হ্রদ ভরাট হয়ে গিয়েই সমতলভূমির সৃষ্টি হয়েছে৷ উল্লেখ্য যে,উক্ত লোগতাক হ্রদ থেকেই আমাদের সকলেরই প্রিয় মেঘনা নদীটির উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেক বছর আগে এক বইতে পড়েছিলাম বলে মনে পড়ছে৷ পদ্মা মেঘনা গঙ্গ যমুনা ভাগিরথী করতোয়া তিস্তা মহানন্দা ব্রহ্মপুত্র সুরমা--- এরাই কিন্তু সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত আর বর্তমান বাঙলাদেশ সহ সমগ্র বাঙলারই গর্বের প্রিয় নদীসমূহ ও প্রাণরস জুগিয়ে চলেছে৷

মহাভারতেও এই মণিপুরের উল্লেখ রয়েছে৷ মণিপুরের রাজনন্দিনী চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে ত্রিপুরাধিপতি কর্তৃক, ‘কবি ভাস্কর’ বলে খেতাবপ্রাপ্ত ভারত গৌরব তথা এশিয়ার গর্ব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ‘‘চিত্রাঙ্গদা’’ নামের গীতিনাট্য রচনা করেছেন৷

ভারতে ইংরেজ রাজত্বের গোড়ার দিক পর্যন্ত মণিপুর ছিল স্বশাসিত রাজ্য৷ রাজধানী ইমফলও সুপ্রাচীন শহর৷ রাজা টিকেন্দ্রজিতের পতনের পর ইংরেজরা মণিপুরের একটি উর্বর এলাকা ‘‘কোবে উপতক্যা’’ তাদের শাসনভুক্ত করে নিয়েছিল আর বাকী এলাকা রাজাকে ফিরিয়ে দেয়৷ এরপর থেকে মণিপুর হয়ে গেছল---ব্রিটিশ ভারতের দেশীয় রাজ্য৷

এককালে বার্র্মকে (বর্তমান মায়ানমার) ব্রিটিশ ভারত বলেই গণ্য করা হত৷  কোবে উপতক্যাও এর অন্তর্ভূক্ত ছিল৷ পরে বার্র্ম ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও কোবে কিন্তু বার্র্মতেই থেকে যায়৷ ভারতের স্বাধীনোত্তর কালে ‘কোলে’ বাদেই মণিপুর ভারত-ডোমিনিয়নের অন্তর্ভূক্ত হয়৷

পুরাকালে মণিপুরীরা ছিলেন থেরবাদী বৌদ্ধ৷ পরে তারা শ্রীচৈতন্যদেবের দীক্ষা পেয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধবর্ম গ্রহণ করেন৷ মণিপুরীরা বৈষ্ণবধর্মে খুবই অণুপ্রাণিত আর রাধাকৃষ্ণের পরমভক্ত৷  রাঢ়ের বর্ধমান জেলার অধিবাসী কৃষ্ণদাস ‘কবিরাজের রচিত’---‘শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত’-কে মণিপুরীরা খুবই শ্রদ্ধা করেন আর তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান হচ্ছে নবদ্বীপ৷

মণিপুরী ভাষা হচ্ছে ভারতবর্মী বর্গীয় ভাষা৷ তাদের মধে  মুখ্য ভাষা হচ্ছে দু’টি ঃ--- (১) বিষেণ পুরীয়া (যাকে আমরা ত্রিপুরায় ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ বলে থাকি৷ (২) অপরটি হচ্ছে মৈতেই মণিপুরী৷ ইমফল উপতক্যার কথ্যভাষা হচ্ছে মৈতেই ভাষা৷ উভয় ভাষাতেই সংস্কৃত শব্দ রয়েছে, তবে বিষেন পুরীয়াতে সংস্কৃত তথা বাংলা শব্দের সংখ্যা যথেষ্ট৷ উভয় ভাষাগোষ্ঠীরই হরফ বাংলা হরফ৷ বিষেণ পুরীয়া মণিপুরীরা বেশী সংখ্যায় বাস করেন--- বর্তমান বাংলাদেশের সীলেট ত্রিপুরা, কাছাড়, মিজোরাম আর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে৷

মণিপুরী সমাজব্যবস্থায় স্ত্রী-স্বাধীনতা রয়েছে৷ দৈনন্দিন জীবনে অধিকাংশ কাজেই মেয়েরা পুরোভাগে থাকেন৷ মনিপুরীমাত্রেই নাচে-গানে ও আমোদ-আহ্লাদে ভরপূর থাকেন৷ মণিপুরী রাসনৃত্য পৃথিবী বিখ্যাত৷ ত্রিপুরায় এসে রাসনৃত্য দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এতই মুগ্দ হয়েছিলেন যে তিনি পরবর্তীকালে মণিপুরী নৃত্যগুরুদের শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে তাঁর রবীন্দ্র নৃত্যকলায়  মণিপুরী ঘরানার নৃত্যশৈলী অন্তর্ভুক্ত করে নেন৷ মণিপুরীদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তাদের মধ্যে জাতভেদ নেই--- তারা সবাই ক্ষত্রিয় বলে দাবী রাখেন৷

মনিপুর অঞ্চলে ইংরেজরা তাদের অবধি শাসন শোষন আর বানিজ্য কায়েম রাখার জন্যই ১৮৭৩ সালে ‘‘ইনার লাইন ব্যবস্থা চালু করেছিল৷ কিন্তু, বর্তমানে স্বাধীনভারতে উক্ত আই.এল.পি চালু কেন করা হল ও কোনস্বার্থে, তা কিন্তু বড় প্রশ্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷  এছাড়াও মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে সেই মনিপুরই আজ বাঙালী-বিদ্বেষে উন্মত্ত প্রায় যে মনিপুর---(১) শ্রীচৈতন্যদেবের পরমভক্ত (২) মণিপুরী নৃত্যকলাকে যেক্ষেত্রে বিশ্বকবি চিরস্মরণীয় করে গেছেন (৩) ১৯৪৩ সালে সেই  রাজ্যের মৈরাঙে স্বয় নেতাজীই নিজহাতে স্বাধীনভারতের প্রতীকী পতাকা উড়িয়েছিলেন সেই মনিপুরের সঙ্গে বাঙলার আত্মিক সম্পর্ক৷ কিন্তু আজ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের শিকার হয়ে সেই মনিপুরের কিছু মানুষ অকারণ বাঙালী বিদ্বেষে মেতে উঠেছে৷