বেহায়া শাসক

সংবাদদাতা
মননোজ দেব
সময়

কুলাল শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘কুলালের একটি অর্থ হচ্ছে শিল্পগত বা ভাবগত বা আদর্শগত ব্যাপারে যার বৈদগ্দ্যিক স্বাতন্ত্র রয়েছে ও যিনি তদনুযায়ী পরিকল্পনা করে এগিয়ে চলেছেন৷ এই ধরণের স্বাতন্ত্র্য বা পরিকল্পনা মুখরতায় ভীত হয়ে অনেকেই---বিশেষ করে বিরুদ্ধবাদী মতবাদের বাহকেরা অনেক সময় অযথা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন ও কুলালের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন৷’’

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধী-সুভাষের মধ্যে এই কুলালত্বগত বিরোধ ছিল৷ সুভাষচন্দ্রের কৌলালিক ভূমিকা সেই সময়ের দেশনেতারা মেনে নিতে পারেননি৷ ওই সব নেতৃবর্গের সমাজচেতনা, বৈপ্লবিক চেতনার অভাব তো ছিলই, সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক চেতনারও অভাব ছিল৷ গান্ধী যদিও স্বাধীনতার জন্যে একটা জনজাগরণ আনতে পেরেছিলেন তবু তার মধ্যে এই সব গুণের অভাবগুলো ছিল৷ তাই তিনি স্বাধীনতার দাবীতে উদ্বুদ্ধ জাগ্রত জনতাকে সংগ্রামের পথে বেশীদূর নিয়ে যেতে পারেননি৷ আসলে দেশনেতারা চেয়েছিলেন গায়ে আঁচটিও না লাগিয়ে যে কোনভাবে স্বাধীনতার নামে ক্ষমতা হস্তগত করে নেওয়া৷ এ যেন ‘‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’’৷

ব্যতিক্রমী ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু৷ সুভাষচন্দ্রের কুলালত্ব ভিন্নধর্মী৷ তিনি ছিলেন আপোষহীন সংগ্রামী৷ যে কোনও উপায়ে স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য৷ তাঁর স্বাধীনতা লাভের উদগ্র বাসনা, তাঁর বৈদগ্দ, স্বতন্ত্র চিন্তাধারা, জনগণকে যেভাবে আলোড়িত করেছিল, স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল কুলালত্বহীন নেতাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি৷ আবার তাঁরা সুভাষচন্দ্রের কৌলালিক ভূমিকাকেও মেনে নিতে পারেননি৷ তাই সেদিন তাঁরা সব রকম নৈতিকতা ও সততা বিসর্জন দিয়ে সুভাষ বিরোধিতায় নেমেছিলেন, যা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ও তৎকালীন রাজনীতির এক কদর্য ইতিহাস৷ পরবর্তী ইতিহাস রহস্যাবৃত৷ সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগ, জাপান গিয়ে রাসবিহারী বসুর হাত থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম---যা ভারতবর্ষে স্বাধীনতা অর্জনের পথ করে দিয়েছিল৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কোনও অহিংসা পূজারীর অবদান নয়৷ সুভাষ আতঙ্কে আতঙ্কিত ব্রিটিশ দেশ ছেড়ে চলে যায় কুলালত্বহীন সুবিধাবাদী দেশনেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে৷ কিন্তু সুভাষচন্দ্রের শেষ পরিণতি আজও অজ্ঞাত৷ প্রচার আছে ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগষ্ট তাইহোকুতে এক বিমান দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান৷ কিন্তু দেশবাসী আজও সেকথা বিশ্বাস করে না৷ সরকারও একাধিক তদন্ত কমিশন বসিয়ে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েও সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে প্রকৃত সত্য আজও উদ্ঘাটিত করতে পারেনি৷ বরং তাইওয়ান সরকারের স্বীকারোক্তি ও ভারত সরকার গঠিত মুখার্জী কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগষ্ট তাইহোকু বিমান বন্দরে কোনও বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি৷

ভারত সরকার নেতাজীর মৃত্যু রহস্যের প্রকৃত সত্য জনগণের সামনে প্রকাশ করতে না পারলেও সুভাষচন্দ্রকে মৃত প্রমাণ করতে সবরকম লজ্জা-শরম ত্যাগ করে আদাজল খেয়ে লেগে আছে৷ অথচ কেন্দ্রের হেফাজতে থাকা সুভাষচন্দ্র সংক্রান্ত গোপন নথি প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছে না কোনও সরকারই৷ নরসীমা রাও সরকার সুভাষচন্দ্রকে মরণোত্তর ভারতরত্ন দিতে চেয়েছিলেন৷ তখনও জনমতের চাপে পড়ে লজ্জা-শরম ত্যাগ করে পিছিয়ে গিয়েছিলেন৷ বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ---কেন্দ্রীয় সরকারের হেফাজতে থাকা সুভাষচন্দ্র সম্পর্কিত সব গোপন নথি প্রকাশ্যে আনবেন৷ কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে হঠাৎ করে ১৮ই আগষ্ট সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু দিবস পালন করে বসলেন৷ কেন্দ্রীয় সরকারের ‘প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো’র মাধ্যমে তা প্রচারও করে দিলেন৷ আবারও যথারীতি জনমতের চাপে পড়ে নির্লজ্জের মত একদিন পরেই তা প্রত্যাহার করলেন৷

কেন বারবার দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে এই ধরণের নির্লজ্জ অবিবেচকের মত আচরণ করছেন বোধবুদ্ধি সব হারিয়ে৷ দুই বিপরীত মেরুর দল এই একটি বিষয়ে সবসময় এক মেরুতেই অবস্থান করে৷ কারণ আর কিছুই নয়, সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগ ও মৃত্যু রহস্যের পেছনে যে কলঙ্কিত ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে সেই কলঙ্কিত ইতিহাসের নায়করা এই দু’টি দলেরই সেদিনের নেতা ছিলেন৷ তিনি কেউ লৌহমানব হোন বা অহিংসার পূজারী৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের কলঙ্কিত ইতিহাসের কালি এদের সবার মুখেই লেগে আছে৷ সে ইতিহাস আজকের প্রজন্মের সামনে যাতে না আসে তাই সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে নক্কারজনক রাজনীতিতে কংগ্রেস বিজেপি এক মঞ্চে৷ 

সুভাষচন্দ্রের উদগ্র দেশপ্রেম, বৈদগ্দ ও কুলাল চেতনা আত্মম্ভরি কুলালত্বহীন সেদিনের দেশনেতাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি৷ দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে দূরে সরিয়ে সুভাষ বিরোধিতাই তাদের প্রধান হয়ে গিয়েছিল৷ সেই নক্কারজনক ইতিহাস আজও তাড়া করে বেড়াচ্ছে সেই সব ক্ষমতালোলুপ দেশনেতাদের উত্তরপুরুষদেরও৷ যদি সেই ইতিহাস কোনদিন সামনে আসে তাহলে মুখ লুকোবার জায়গা পাবে না আজকের অনেক দেশবরেণ্য নেতা৷