ধরা আর সরা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

দেশজ শব্দে ‘ট’ যথাযথভাবেই বজায় থাকে৷ আর ‘ড’ বা ‘ড়’ মৌলিক শব্দ হিসেবেই থেকে যায়৷ যেমন, আজ ভুলোর সঙ্গে ভোঁদার আড়ি হয়ে গেল৷ ওরা বলছে, ওরা আর একসঙ্গে মার্ৰেল খেলবে না, একটা পেয়ারাও আর কামড়াকামড়ি করে খাবে না৷ গোপনে কান পেতে শোনাকেও আড়িপাতা বলে৷ এটিও বাংলা দেশজ শব্দ৷ সেই যে একজন মহিলা আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার এক ৰন্ধুকে বলেছিল–তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় বলতে পারছি না৷ ৰন্ধু বলেছিল, তোমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তার একটু আভাস আমায় দাও৷ মহিলাটি বলেছিল, আহ্লাদের আতিশয্যে আমার এখন ধরাকে সরা মনে হচ্ছে৷ সেই সময়  হয়েছে কী, একজন চাষীর গোরু হারিয়ে গেছে৷ সে গোরু খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যে বাড়ির বারান্দায় বসেছে সেই বাড়িরই ঘরের ভেতর ওই মহিলাটি বলছে– আমি আনন্দের আতিশয্যে ধরাকে সরা মনে করছি৷ চাষী আড়ি পেতে কথাটা শুনে নিলে৷ এবার সেও আনন্দের আতিশয্যে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে থেকে ওই মহিলাটিকে গড় করে বললে–মা লক্ষ্মী, এই বিরাট ধরাটা যখন তোমার কাছে সরা হয়ে গেছে তখন দয়া করে বলে দাও, ওই সরার কোন্খানটিতে আমার গোরুটা রয়েছে৷ বইয়ের নামেই বিপত্তি ঔষধ রোগকে হত্যা করে৷ তাই হত্যাকারী অর্থে ‘থুর্ব’ ধাতু ড করে যে ‘থ’ শব্দ পাই তার একটি যোগরূঢ়ার্থ হচ্ছে ঔষধ৷ এই ঔষধ যে কেবল শারীরিক রোগের ঔষধ তাই নয়, মানসিক রোগের ঔষধও৷ মানসিক রোগের যতরকম ঔষধ আছে তার একটা নাম হচ্ছে মানুষের মনে রসচেতনা জাগিয়ে তার মনকে হালকা করে দিয়ে ব্যথাভার সরিয়ে দেওয়া–চিন্তাক্লিষ্টতা অপনয়ন করা৷ এজন্যে প্রাচীনকালে এক ধরনের মানুষ থাকতেন যাঁরা মানুষের মনকে নানান ভাবে হাসিতে খুশীতে ভরিয়ে রাখতেন৷ মন ভাবে–ভাবনায় আনন্দোচ্ছল হয়ে উপচে পড়ত৷ এই ধরনের মানুষেরা শিক্ষিত বা পণ্ডিত থেকে থাকুন বা না থাকুন এঁরা মানব মনস্তত্ত্বে অবশ্যই পণ্ডিত হতেন৷ এঁদেরই বলা হত বিদুষক৷ বিদুষকের ভাববাচক বিশেষ্য ত্ব্ব্দব্ধব্জ্ত্রন্তুব্ধ প্সব্ভুগ্গ ‘বৈদুষ্য’ শব্দটির সঙ্গে নিশ্চয়ই তোমরা ভালভাবেই পরিচিত৷ ‘‘বাক্ বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্র ব্যাখ্যান কৌশলম্৷ বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বৎ ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে’’৷ বিদুষকের বিদ্যেৰুদ্ধি থাক্ বা না থাক্ তাঁদের মনস্তত্ত্বের জ্ঞান থাকা দরকার, উপস্থিত ৰুদ্ধি ত্মন্দ্ব্ত্রস্তুম্ভ ভ্রন্ব্ধগ্গ থাকা তো চাই–ই৷ তোমরা অনেকেই নিশ্চয় মুর্শিদাবাদের শরৎচন্দ্র পণ্ডিত মহাশয়ের নাম শুনেছ৷ তাঁর মত উচ্চমানের বিদুষক খুব কমই জন্মেছেন৷ সাধারণের মধ্যে ‘দাদাঠাকুর’ নামে পরিচিত এই মানুষটি ‘বিদুষক’ নামে একটি পত্রিকাও ছাপাতেন৷ সেবার ৰহরমপুরে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে৷ উপস্থিতদের মধ্যে শরৎচন্দ্রপণ্ডিত মহাশয় তো আছেনই, আর ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি তখন প্রতিষ্ঠার তুঙ্গে৷ তাঁর লেখা ‘চরিত্রহীন’ পুস্তকটির তখন ‘খোলা থেকে নোলা’ গরমাগরম আলুর চপের মতই ৰাজারে ৰেজায়** কাটতি৷ শরৎ চাটুজ্জে নামকরা কথাশিল্পী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভাষণ ভাল দিতে পারতেন না.....মজলিসী গল্পগুজবে ছিলেন ওস্তাদ৷ সবাই তাঁকে ধরে বসল–‘‘আপনাকে এখানে কিছু বলতেই হবে৷’’ শরৎ চাটুজ্জে দু’এক মিনিট দায়সারা গোছের কিছু বলে বসে পড়লেন৷ আর বসার আগে বললেন–‘‘আমি আর এখানে ৰেশী কিছু বলব না–বলবেন বিদুষক শরৎচন্দ্র৷’’ শরৎচন্দ্র পণ্ডিত (দাদাঠাকুর) উঠে খানিকক্ষণ বললেন আর বসার আগে বললেন–আমি আর কতটুকু জানি, আমার চেয়ে ঢ়ের ৰেশী জানেন ওই ‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্র৷ (* কুলোকর্ণী,কুলোর সংস্কৃত ‘শূর্প’৷ শূর্পঞ্ছশূপ্পঞ্ছশূপ৷ উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলিতে কুলোকে ‘শূপ’ বলা হয়৷ যার নখ শূর্প অর্থাৎ কূলোর মত সে শূর্পণখা৷) (** এটি একটি খাঁটি ৰাঙলা শব্দ৷ ফার্সী ৰজহ্’–এর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই৷ ফার্সী ‘ৰজায়’ শব্দের সঙ্গেও এর কোনো সম্পর্ক নেই৷ শব্দটির অবস্থা কতকটা ৰাঙলা শব্দ ‘পিদীম’–এর মত৷ অনেকে ভাবেন এটি ৰোধ হয় সংস্কৃত ‘প্রদীপ’ থেকে এসেছে৷ না, তা নয়৷ এটি একটি খাঁটি ৰাঙলা শব্দ৷ স্থান বিশেষে ‘পিদ্দিম’ ও ‘পিদ্দুম’ রূপেও উচ্চারিত হয়৷)