হিন্দীর আগ্রাসন দেশের সংহতি বিপন্ন করবে

লেখক
মনোজ দেব

কিছুদিন আগে দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এক ভাষা, এক দেশের কথা বলেছিলেন৷ দক্ষিণ ভারত সহ অহিন্দীভাষী রাজ্যগুলোতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন একটা পরিকল্পনার কথা বলেন তখন সেটা তাঁর সরকারের পরিকল্পনা বলেই ধরে নেওয়া যায়৷ প্রতিবাদের চাপে পড়ে পরিকল্পনা থেকে সরে আসার কথা বললেও রাজ্যগুলির ওপর হিন্দী চাপাবার প্রয়াস জারি আছে৷

এখানে প্রথমে একটা কথা বলি, হিন্দী কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রভাষা নয়৷ জনস্বার্থ বিষয়ক মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪শে জানুয়ারী, ২০১০ সাল, গুজরাট হাইকোর্ট স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, হিন্দী আমাদের দেশের রাষ্ট্রভাষা নয়৷ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলও বলেছেন  সংবিধানের অষ্টম অনুসূচীতে তালিকাভুক্ত ২২টি ভাষাই সমমর্যাদা সম্পন্ন৷ কাউকেই এককভাবে রাষ্ট্রভাষার সম্মান দেওয়া হয়নি, কেবল সংযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসেবে ইংরেজী ও হিন্দীকে রাখা হয়েছে৷

কিন্তু উগ্র হিন্দী প্রেমীরা বার বার হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করে সমস্ত রাজ্যের ওপর হিন্দীকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ও দেশের সব সুক্লে হিন্দীকে আবশ্যিক করবার চেষ্টাও হয়েছিল৷ এখনও অঘোষিতভাবে হিন্দীকে অন্যান্য রাজ্যের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ও অন্যান্য ভাষাগুলিকে টুঁটি টিপে হত্যা করবার চেষ্টা চলছে৷

মাঝে ‘আমরা বাঙালী’র আন্দোলনের ফলে দেখেছিলাম, পশ্চিম বাংলায় রেলের টিকিটে বাঙ্লাও লেখা হ’ত৷ এখন আবার তা বন্ধ হয়ে গেছে৷ এখনও পুরুলিয়ার অনেক ষ্টেশনে দেখেছি, হিন্দীতে ঘোষণা করা  হচ্ছে৷ বাঙলায় কদাচিৎ কখনও কখনও ঘোষণা করা হয়৷ এইভাবে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ঘোষণাপত্র (সারকুলার) হিন্দীতে ও ইংরেজীতে হয় বাংলাতে নয়৷

জেলা অফিস বা ব্লক থেকে গ্রামে গ্রামে অনেক চিঠি পাঠানো হয়, তাও দেখি বাংলাতে নয়, হিন্দী বা ইংরেজীতে৷ এ কেন হবে? ফলে প্রাপক সরকারী চিঠির অর্থ ঠিকমত বুঝতেই পারে না৷ এর ফলে তাদের অনেক অসুবিধা হয়৷ শুধু তাই নয়, এর ফলে জনসাধারণের মনে হীনম্মন্যতা বোধ জাগে৷ বাংলায় সমস্ত সরকারী কাজকর্ম বাংলায় করা বাধ্যতামূলক৷ কোর্টের কাজকর্ম ও দলিলপত্রও বাংলাতে করা বাধ্যতামূলক৷ এখানে, অনেকে প্রশ্ণ তুলবেন, এটা তো রাজ্য সরকারের ব্যাপার৷ আমাদের কথা, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার বাঙলায় বাংলাভাষাকে অবহেলা যে করবে, তারই আমরা প্রতিবাদ করবো৷ রাজ্যসরকারও যদি কেন্দ্রের হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ না বোঝে, তাঁদের ষড়যন্ত্রের শিকার বা শরিক হয়, তারও প্রতিবাদ করাটাই সঙ্গত৷ দেশবাসীর মনে যাতে হীনম্মন্যতা বোধ না জাগে – ‘আমরা তো ইংরেজী বা হিন্দীভাষা জানি না, আমরা তো অশিক্ষিত’ – এ ধরণের ভাবনা না জাগে তা দেখতে হবে বৈ কি৷ হীনম্মন্যতা বোধ থেকে মন দুর্বল হয়ে যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তোলবার সামর্থ্য হারিয়ে যায়৷ এটা যেকোনো জাতির পক্ষে ক্ষতিকর৷ তাছাড়া, অন্ততঃ নিজের রাজ্যে নিজেদের মাতৃভাষা কেন যথার্থ মর্যাদা পাবে না – কেন সমস্ত সরকারী–বেসরকারী কাজকর্ম মাতৃভাষায় হবে না? জনগণের মধ্যে এ চেতনা জাগা উচিত৷ এবার সংসদে শপথ নেওয়ার সময় দেখলুম, পশ্চিম বাঙ্লার সাংসদরা বেশির ভাগই বাংলায় শপথ বাক্য পাঠ করেননি৷ কেন এটা হবে? পশ্চিম বাঙ্লার বাঙালীদের প্রতিনিধি বাংলাতে কেন শপথ নেবেন না?

বাংলাদেশ তৈরী হবার পর মুজিবর রহমন বাংলাদেশে সমস্ত কাজকর্ম, এমনকি ডাকটিকিট, টেলিগ্রাফ – সবকিছুই বাংলাতে করে ফেলেছিলেন৷ রাষ্ট্রসংঘেও বাংলাতে ভাষণ দিয়ে বাংলার মর্যাদা বাড়িয়েছেন, অথচ আমাদের বাঙালী সাংসদরা সংসদে বাংলার কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন৷ এটা বাঙালী জাতির পক্ষে অপমানজনক৷

পশ্চিম বাংলার পাশে ঝাড়খণ্ড৷ এ রাজ্যের ৬৫ শতাংশ বাঙালী৷ কিন্তু এ রাজ্যের ওপর জোর করে’ হিন্দীকে প্রধান রাজভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ এখানে বাংলায় কোন সরকারী কাজকর্মই হয় না৷ আগে অনেক বাংলা–মাধ্যমের স্কুল ছিল৷ এখন সেগুলিকে বদলে হিন্দী মাধ্যম করে দেওয়া হয়েছে৷ ঝাড়খণ্ডে কোনো মানুষের মাতৃভাষা হিন্দী নয়৷ অধিকাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা, কিছু লোকের মাতৃভাষা নাগপুরিয়া, কিছু লোকের সাঁওতালী ও অন্যান্য৷ হিন্দী এল কোত্থেকে? অথচ হিন্দীকে প্রধান রাজভাষা করে দেওয়া হয়েছে কেন? এটা হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ ছাড়া আর কি

অসমে, বিহারে ও ওড়িষ্যার সঙ্গেও বেশ কিছু বাঙালাভাষী এলাকাকে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ওখানকার স্থানীয় বাঙালীরা মাতৃভাষা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত৷ এ অন্যায়

এইভাবে এক ভাষাভাষী মানুষ অন্য ভাষাভাষীর মানুষকে শোষণ অবদমন করবে – এটা মোটেই সমীচীন নয়৷ এভাবে দেশের সংহতি ও শান্তি আসে না৷ বরং এতে কেন্দ্র নিজেই বিদ্রোহের বীজ বপন করছে৷ পার্শ্ববর্তী  রাষ্ট্র থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার৷ জোর করে একের ভাষা অন্যের ওপর চাপানোর পরিণতি কি হতে পারে তাই কেন্দ্রকে এ ব্যাপারে সচেতন ও সাবধান করে দিচ্ছি৷ শোষণ–বদমন নয় – সমমর্যাদা ও ন্যায়–নীতির মাধ্যমেই শান্তি ও সংহতি আনা যায়৷