লোকালয়ে বাঘ!

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূত

দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদিজী বর্তমানকালে তাঁর প্রায় প্রতিটি বত্তৃণতাতেই দেশের আত্মনির্ভরতার শ্লোগান দিয়ে তাঁর সরকারের অবদান সম্পর্কে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে চলেছেন৷ এদিকে  প্রায়  তিন সপ্তাহ দেশজুড়ে কর্ষক আন্দোলন চলছে৷ এই শীতের  ঠাণ্ডায় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দিল্লির প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করে অবস্থান করছে পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কর্ষক সম্প্রদায়৷ তাদের দাবী, সরকার তিন কৃষি আইন পাশ করিয়ে  লোকালয়ে  বাঘ ছেড়ে দিয়েছেন৷ আম্বানি আদানি প্রভৃতি বৃহৎ পুঁজিপতিদের কৃষিক্ষেত্রে অবাধ লুন্ঠন করার ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছেন৷ তাই এই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে কর্ষক সম্প্রদায়কে বাঁচাতে হবে৷

মোদিজী যে, স্বনির্ভরতার শ্লোগান দিচ্ছেন, এই স্বনির্ভরতার  মানে কী? কার বা কাদের  স্বনির্ভরতা? দেশের তো!  দেশ মানে  কী বোঝায়? দেশ বলতে তো বোঝায় মুখ্যতঃ দেশের জনগণ! স্বনির্ভরতা তো পাহাড় পর্বত নদীকে দেওয়ার প্রশ্ণ উঠে না৷ মানুষকেই স্বনির্ভরতা দান করতে হবে৷ আর দেশের মানুষ মানে কী? দেশের মানুষ মানে কি মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিগোষ্ঠী? এদের অর্থবল বর্তমানে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা সিংহাসনে আরোহন থেকে  অবস্থান সহ বিভিন্ন পর্যায় মুখ্যভূমিকা পালন করছে বলেই কি এরাই দেশের জনসাধারণের প্রতিভূ? তা, কখনই হতে পারে না৷ আজ প্রায় এক বছর ধরে লকডাউন থাকাকালীন যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে চুরমার  সেইসব গরিব জনসাধারণই দেশের প্রতিভূ৷ দেশের জনসাধারণের যেখানে ওষ্ঠাগত প্রাণ সে সময় যাদের লাভের অঙ্ক বিপুল হারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে৷ ধনবৃদ্ধির নিরিখে তাদেরই জনসাধারণের প্রতিভূ মানতে হবে নাকি? এ কেমন দেশের প্রতিনিধির কথা!

লকডাউনের সময় পুঁজিপতিরা বোধকরি বুঝেছে, দেশের কল-কারখানার ওপর ভরসা করে তাদের ‘কুবেরের অর্থ ভাণ্ডার’ পূর্ণ করে রাখা যাবে না, কৃষিক্ষেত্র চাই৷ কৃষির ওপর একচেটিয়া আধিপত্য না হলে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে  পড়বে৷ তাই কি তারা  সরকারকে  চাপ দিয়েছেন৷ কৃষিক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসায়ের ছাড়পত্র তাদের দিতে হবে৷ কেন্দ্রীয়  সরকারের তিন কৃষি আইন পাশ করার মূল কারণ কি তাই? তাই তো মনে হয়৷

না হলে স্বনির্ভরতা’র নাম করে  দেশের ৬৫ শতাংশ কর্ষক সম্প্রদায়ের ‘স্বনির্ভরতা’র কথা ভুলে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি গোষ্ঠীর স্বনির্ভরতার কথা  ভাবতে গেলেন কেন?

চাল, ডাল, তেল, আলু প্রভৃতির  মজুত করার অবাধ ছাড়পত্র  যে কৃষি আইনের মাধ্যমে  পুঁজিপতিদের দেওয়া হয়েছে, এবার পুঁজিপতিরা তাদের বিপুল অর্থবলের সাহায্যে এইসব পুঁজি করে মজুতদারী চালাবে৷ এজন্যে তারা বড় বড় হিমঘর বানানো শুরুও করে দিয়েছেন৷ এইভাবে মজুতদারী  চললে দেশে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি হবে ও নিত্য জিনিসপত্রের দাম  হুহু করে  বাড়বে৷ যেমন সাম্প্রতিক কালে আলুর ক্ষেত্রে  হয়েছে? এইভাবে বিপুল মূল্যবৃদ্ধিই তো পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের  বিপুল পুঁজিবৃদ্ধির কৌশল! এটা কি সরকার তথা তাদের  বেতনভুক্ত অর্থনীতিবিদরা বোঝেন না? না সব বুঝেই খুব সচেতনভাবেই এ সব  করা হচ্ছে? তার কারণ কি  নগদ অর্থের সরবরাহ?

কৃষি আইনে যে চুক্তি চাষের কথা বলা হয়েছে, তাতে তো নিরীহ ছাগশিশুকে  বাঘের সামনে ফেলে দেওয়ার সামিল৷  এইভাবে কি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীকে স্বনির্ভরতা দান করা যায়? তাদের স্বনির্ভরতা দান করতে গেলে বাঘের হামলা থেকে তাদের  সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷ তা না করে এই যে চুক্তিচাষের আইন প্রণয়ন এতো সেই ব্রিটিশ আমলের সাহেবদের নীলচাষ ও জনসাধারণের ওপর সাহেবদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়৷ মোদিজীরা কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে চান?

চাষীরা যাতে তাদের ফসলের লাভজনক মূল্য পায়, প্রাকৃতিক বিপর্যযে বিপর্যস্ত অন্নদাতা কৃষক সম্প্রদায় যাতে প্রয়োজনমত ক্ষতিপূরণ পায়, যাতে তাদের তথা তাদের পরিবারের লোকদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও যথার্থ শিক্ষালাভের গ্যারান্টী দেওয়া যায়, যাতে তারা ‘স্বাধীনতা’র প্রকৃত স্বাদ পেতে পারে--- তার জন্যে তাদের সবরকমের  সুরক্ষার জন্যে যথাযথ ব্যবস্থাই তো প্রকৃত দেশের  স্বনির্ভরতা  অর্জনের ব্যবস্থা!

সমস্ত শিল্পজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণের সময় কাঁচামালের খরচ, শ্রমিকের মজুরী, পরিবহন খরচ, ক্ষয়ক্ষতি, লাভের  অংক, কারখানা সম্প্রসারণের  খরচ--- এসব হিসেব করে তারপর তার মূল্য নির্ধারণ করা যায়৷ কর্ষকের ফসলের ক্ষেত্রে কিন্তু এসব কিছুই হিসেব কষা হয় না৷ সরকারকে  এটা দেখতে হবে,  না হলে কর্ষকদের দুরবস্থা ঘুচবে না৷  ঋণের ভারে  জর্জরিত হয়ে প্রতি বছর  হাজার হাজার কর্ষক আত্মহত্যা করছে, তবুও কি সরকারের চোখ খুলবে না? তাই তো ‘প্রাউট দর্শনে’ বলা হয়েছে৷ কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিতে হবে৷

কেবল ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না৷ অধিকাংশ হতদরিদ্র-চাষী এই সুবিধা পাচ্ছে না৷ ভূমিহীন কৃষিমজুরদের অবস্থা তো আরও সঙ্গীন৷

এই কারণে কৃষিতে সমবায় প্রথা আনতে হবে৷ সেদিকে সরকারের  দৃষ্টি নেই৷ সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে কর্ষক ও কৃষি মজুরদের স্বাধীন সত্তা ফিরিয়ে দিতে হবে৷ তা  না করে উল্টোপথে তিন কৃষি আইন পাশ  করে’ গরীব কর্ষক ও কৃষিমজুরদের পুঁজিপতিদের অধীনস্থ প্রজা বা তাদের ক্রীতদাস করে তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে৷

তাই মোদিজীদের চৈতন্যদয় হোক, দেশের মেরুদণ্ড কর্ষক সমাজের যথার্থ উন্নতির কথা ভাবুন৷ সুদীর্ঘকালের অবহেলিত বঞ্চিত কর্ষকদের  সমাজ আজ জেগে উঠেছে, শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে৷

কেন্দ্রীয় সরকার আর আগুন নিয়ে খেলবেন না৷ কারণ তার পরিণতি  ভাল হবে না৷