মানুষ, প্রকৃতি ও ঔষধ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

খাদ্যের মাধ্যমে ঃ যে সকল ঔষধ অতিরিক্ত তিক্ত বা বিস্বাদ (সুজির মোহনভোগের সঙ্গে বিস্বাদ ঔষধ মিশিয়ে দিয়ে মোগল যুগে হেকিমরা তৈরী করতেন সুমধুর ‘হল্বা’, বাংলায় যাকে ভুল করে ‘হালুয়া’ উচ্চারণ করা হয়) সম্ভব ক্ষেত্রে সেগুলিকে রন্ধন করে ভাত বা অন্য কোন প্রধান খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে মানুষ ঔষধ সেবনের এক নবতর পদ্ধতি আবিষ্কার করল৷ এই ভাবে ঔষধীয় গুণসম্পন্ন নিম্বপত্র (নিমপাতা), উৎসিকা (উচ্ছে), পটোল লতা (পলতা), গন্ধিকা (গাঁদাল) প্রভৃতি ঔষধকে মানুষ প্রধান খাদ্যের সঙ্গে, যেমন বাংলায় ভাতের সঙ্গে খেয়ে ঔষধের গুণ আহরণ করতে লাগল৷

তিথিগত বিচার ঃ সূর্যালোক যেমন নিজেই ঔষধ, চন্দ্রালোক তেমনি ওই ধরনের ঔষধ নয়৷ বরং জ্যোৎস্নালোক অনেক সময় মনকে অন্য ভাবে ভাসিয়ে দেয়৷ তবে জ্যোৎস্নালোকের তারতম্য অনুযায়ী অর্থাৎ বিভিন্ন পক্ষে বিভিন্ন তিথিগত ভেদে ঔষধীয় গাছগাছড়ায় গুণের পরিবর্তন ঘটে৷ তাই তিথিগত ভাবে ঔষধ–উত্তোলন, ঔষধ–প্রস্তুত ও ঔষধ–সেবনের বিধি আছে৷ দিনের ক্ষেলায় বিভিন্ন সময়ে ঔষধীয় গুণ পরিবর্তিত হয় আর সেটা বুঝেই মানুষকে সেটা ব্যবহার করতে হয় বা করলে ভাল হয়৷ এই যে ঔষধীয় গাছগাছড়া যাতে তিথিভেদে বা গ্রহভেদে গুণগত তারতম্য ঘটে এই সমস্ত গাছগাছড়াকে অর্থাৎ ভেষজকে এক কথায় ‘কুল্যা’ বলা হয়৷

জান্তব বস্তুর ব্যবহার ঃ প্রাচীনকাল থেকে মানুষ যে কেবল ঔষধার্থে উদ্ভিজ্জ বস্তুকেই ব্যবহার করেছে তা–ই নয়, বিভিন্ন জন্তু–সংজাত ঔষধীয় গুণসম্পন্ন বস্তুও ভালভাবেই ব্যবহূত হত৷ সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদে, বৈদ্যক চিকিৎসায় ও হেকিমী (ইউনানি) চিকিৎসায় বিভিন্ন পশুপক্ষীর যকৃৎ, তিতির পাখীর ক্ষসা (চর্বি) প্রভৃতি জান্তব বস্তু ভালভাবেই ব্যবহূত হত৷ আয়ুর্বেদের ছাগলাদ্য ঘৃত, ধনেশাদি তেলের কথা কে না জানে

এ্যালোপ্যাথি–হোমিওপ্যাথ্ জীবহত্যা করে’ ওষুধ প্রস্তুত–নীতি ঃ এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় বিভিন্ন জন্তুর যকৃৎ, অগ্ণ্যাশয় প্রভৃতি থেকে ওষুধ তৈরী হত৷ অত্যাধুনিক কালে ‘ইনসুলিন’–এর ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যবহারও রয়েছে৷ কড্ মৎস্যের লিবারের তেল (কড্ লিবার অয়েল), হাঙ্গরের তেল (শার্ক অয়েল) ভালভাবেই চলে৷ কেবল যে গলাধঃকরণের ঔষধেই চলে তা নয়, সূচিকা–ভরণেও ব্যবহূত হয়৷ হোমিওপ্যাথিতে ন্যাজা, সিনা, এপিস প্রভৃতি ঔষধগুলি ষোল আনাই জান্তব৷ মানুষকে বাঁচাবার জন্যে কোন জীবকে হত্যা করা খুব একটা ভাল কাজ না হলেও গত্যন্তর না থাকলে তা করা যেতে পারে–এ নীতি সবাই মানে৷ তবে জীব হত্যা করে’ ঔষধ প্রস্তুত করার সময় যতদূর সম্ভব মানুষের জাতশত্রুর মধ্য থেকেই তা’ করা উচিত৷ যারা মানুষের জাতশত্রু নয়–জাতমিত্র, তাদের হত্যা না করলেই যেন ভাল হয়৷

ঔষধে ধাতু–ধাতু ঃ ঔষধার্থে বিভিন্ন প্রকারের ধাতু ও অ–ধাতু প্পন্দ্বব্ধ্ত্রপ্তব্দ স্তু প্সু–প্পন্দ্বব্ধ্ত্রপ্তব্ প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহূত হয়ে এসেছে৷ বিশেষ করে সোণা, রূপো, রাং বা টিন (বঙ্গ), পারা (পারদ–প্পন্দ্বব্জন্তুব্ভব্জম্) প্রভৃতির ঔষধার্থে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহার রয়েছে৷ আয়ুর্বেদের সুপ্রসিদ্ধ ঔষধ মকরধ্বজ তো মার্কিউরিক সালফাইড অর্থাৎ পারা ও গন্ধকের সমবায়ে তৈরী৷ ক্যালসিয়াম–সংজাত ওষুধের সংখ্যা হোমিওপ্যাথি, এ্যালোপ্যাথি, হেকিমী, আয়ুর্বেদ–কোনটাতেই কম নয়৷ যে শঙ্খ–সংজাত ওষুধ দিয়ে প্রাচীনকাল থেকে মাতামাতি করা হয়েছে সে ঔষধগুলি আসলে ক্যালসিয়াম–ফসফেট, ক্যালসিয়াম–কার্বোনে ও ক্যালসিয়াম–হাইড্রো– ছাড়া আর কিছুই নয়৷

হোমিওপ্যাথি ও বিষ চিকিৎসা ঃ ‘‘শমঃ শমং শময়তি’’ ঙ্মব্দন্প্পন্প্তন্ত্র ব্দন্প্পন্প্তন্ত্ব্ব্ভব্দ ন্তুব্ভব্জ্ত্রুব্ধব্ভন্দ্ব্ নীতির সারবত্তা মানুষ বুঝেছে মহাভারতীয় কাল থেকেই কিন্তু সেটা বৈজ্ঞানিক স্তরে সুষ্ঠুভাবে নিয়ে এলেন মহাত্মা হ্যানিম্যান তাঁর হোমিওপ্যাথি রীতির মাধ্যমে৷ এই ‘‘শমঃ শমং শময়তি’’ নীতির সারবত্তা মহাভারতের যুগে মানুষ উপলব্ধি করেছিল সর্পবিষজর্জরিত ভীমের বিষ চিকিৎসার মাধ্যমে৷ আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় বিশেষ করে সর্প–বিষ, বৃশ্চিক–বিষ, মাকড়সার বিষ, ব্দন্তুপ্সব্জহ্মন্প্সুক্ হ্মপ্সন্ব্দপ্সুগ্গ, ক্ষরোটা (ক্ষোলতা) বিষ নিয়ে গবেষণা বেশ কিছুটা এগিয়েছিল৷ এতে বিশেষ অগ্রণী ছিলেন কেরলের কোচিন রাজপরিবারের লোকেরা৷ কেউ কেউ এক কালে বৈয়ষ্টিক স্তরেও এই বিষ–চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন৷ মদীয় মাতামহ স্বর্গীয় ডঃ ইউ, এম, বসু (এ্যালোপ্যাথ) বৃশ্চিক–বিষের ঔষধীয় প্রয়োগ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন৷ কিন্তু তাঁর গবেষণা–লব্ধ ফলাফল যথোপযুক্ত ভাবে নথিক্ষদ্ধ হবার পূর্বেই তাঁর মৃত্যু হয়৷ এ চিকিৎসায় এ্যালোপ্যাথি–বিজ্ঞান খুব বেশী এগিয়েছে বলে মনে হয় না৷ তবে এগিয়ে যাবার সুযোগ রয়েছে অফুরন্ত৷

সূচিকাভরণ ঃ যে ক্ষেত্রে গলাধঃকরণের দ্বারা বা অন্যভাবে ঔষধকে উদরসাৎ করে ফল পেতে অসুবিধা আছে বা করলেও ফলপ্রাপ্তি হয় না বা ফলপ্রাপ্তি বিলম্বিত হয় সে সব ক্ষেত্রে আজকাল সূচিকা প্রয়োগের দ্বারা শরীরে ঔষধ প্রবেশ করাবার বিধি ব্যাপক ভাবে প্রবর্ত্তিত হয়েছে৷ সূচিকা প্রয়োগের দ্বারা যদি বস্তু শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয় তাকে বলা হয় সূচিকাভরণ৷ প্রাচীনকালে আয়ুর্বেদেও সূচিকাভরণের ব্যবস্থা অল্প মাত্রায় ছিল কিন্তু সে কালে এই বিদ্যা যে উন্নতি লাভ করতে পারেনি তার প্রধান কারণ ছিল, সে কালে মানুষের মধ্যে নানান ধরনের কু–সংস্কারের প্রভাব ছিল৷ তারা সূচিকাভরণের দ্বারা বাইরের বস্তুকে শরীরে নিতে চাইত না৷ আর তাই বিদ্যাটাও অনাদৃতই থেকে গেছল৷ আজকাল দুরারোগ্য ও দুশ্চিকিৎস্য ব্যাধিতে বা জীবন–সংশয়ের রোগেতে এই সূচিকাভরণের দ্বারা রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে৷ আর আনন্দের কথা এই যে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, আধুনিক আয়ুর্বেদাচার্যরা ও হোমিওপ্যাথরা সূচিকা–প্রয়োগ ব্যবস্থাকে মেনেই নিয়েছেন ও নিজেরাও ব্যবহার করছেন৷

চূর্ণ ঃ যে সকল ঔষধকে শুকনো অবস্থায় রাখতে হয় কিন্তু ক্ষটিকার ব্ধ্ত্রত্ব্প্তন্দ্বব্ধগ্গ রূপ দেওয়া একটু অসুবিধাজনক, তাদের গুঁড়ো অবস্থায় রক্ষা করা হত৷ এই গুঁড়ো অবস্থায় রাখা ঔষধকে আয়ুর্বেদে ‘চূর্ণ’ বলা হয়–যেমন, লবণ–ভাস্ক্র চূর্ণ, গাম্ভারী মূল চূর্ণ, গুড়ুচী শর্করা চূর্ণ৷

(শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারেব ‘দ্রব্যগুণে রোগারোগ্য’ থেকে গৃহীত)