পুঁজিবাদী শোষণ রুখতে প্রাউটিষ্টদের আহ্বান

লেখক
প্রভাত খাঁ

এই পৃথিবী গ্রহে ত্রিভুজাকৃতি ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব অপরিসীম৷ বিশ্বের বুকে ভারতের অধ্যাত্মবাদ মানুষের ঐশী চেতনার বিকাশের যেমন পথ নির্দেশনা দিচ্ছে ঠিক তার সাথে সাথে অমৃতের সন্তানদের ভূমা–সম্প্রীতির গভীর আগ্রহ জাগিয়ে ‘‘মহামিলনের সাগরতীরে’’ এই আগমনের আহ্বান জানাচ্ছে৷ এই মহা সত্যটি যদি ভারতবাসীগণ বিস্মৃত হয় তা হলে তার চেয়ে বেদনার ও দুঃখের আর কি থাকতে পারে৷ আজ ভারত সে কথা ভুলে গেছে বলেই জগৎ সভায় প্রতি পদে পদে অবহেলিত ও লাঞ্ছিত হয়ে কালাতিপাত করছে৷

যেদিন ভারতের মুনীঋিষিগণ সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে অমৃতের সন্তান হিসাবে অভিহিত করলেন তখন তো মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও জাতপাতের কোন প্রশ্ণই রইল না৷ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার কথা সেই জাতপাত ও নানান ভেদাভেদের কঠিন লৌহ শঙ্খলে আবদ্ধ হয়েই ভারতের অধিকাংশ জনগণ অজ্ঞানতার বদ্ধজলাশয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে ও কুসংস্কারের পঙ্কিলতায় আটকা পড়ে আছে৷ সেই কারণেই দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সার্থক বিকাশে অক্ষম হয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে৷ তারা লোভের বশবর্ত্তী হয়ে আর্থিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর শোষণ চালিয়ে কুসংস্কার ও বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রগতির পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে৷ ভারত অধ্যাত্ম বাণীর বার্ত্তাবহগণ বার বার এসেছেন ও এদেশের জনগণকে ও মানব সমাজকে সচেতন করে গেছেন– সেই মহাজীবনের চরম লক্ষ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন৷

বিংশশতাব্দীতে সমস্যা সংকূল যুদ্ধবিধস্ত পৃথিবীর বুকে এলেন মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী (শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)৷ তিনি বার বার সেই ত্রয়ীর বিকাশের কথা বলে গেছেন–দৈহিক মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা৷ তিনি নির্দেশ দিয়ে গেছেন যেন কোনটাকে অবহেলা না করা হয়৷ তিনি দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেছেন – মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ মানুষ মানুষ ভাই ভাই৷ সেই মানব সমাজকে অতীতে একসূত্রে বাঁধতে ভারতের অধ্যাত্মপুরুষরা যে ‘‘সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবোমনাংসি জানতাম’’ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে একসঙ্গে চলতে ও একই ভাবনায় ভাবিত হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে যান, সেই মন্ত্রেকে সমনে এনে তিনি কুসংস্কার মুক্ত হয়ে চলার নির্দেশনা দিয়ে গেলেন৷ তিনি তাঁর প্রদত্ত প্রাউট দর্শন (প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব) দিয়ে জাগতিক ক্ষেত্রে মানুষের সমাজ যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করে যান৷

শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বিজ্ঞান ভিত্তিক যুগোপযোগী সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন করেন৷ এই সমাজে সকল নরনারী জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বৈকতা ও মানবতাবোধে ঊদ্বুদ্ধ হয়ে অধ্যাত্ম বিজ্ঞানকে জীবনের ধ্রুবতারা রূপে স্বীকার করলো ও সেই বিশ্ব স্রষ্টা পরমপিতাকে মান্যতা দিলে তারা এক সর্বাঙ্গ সুন্দর মানুষের বাসভূমি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে৷ মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব৷ সেই মানুষকে অবশ্যই আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে জানতে হবে৷ কারণ নিজেকে জানাই জ্ঞান৷ মানুষ হলো ঈশ্বরের সার্থক প্রতিভূ৷

বর্ত্তমানে ভোগ সর্বস্ব মানুষ অহংকার, অজ্ঞানতার পঙ্কে পতিত হয়ে মূল্যবান মানব জীবনকে অধঃপতনের পথে নিয়ে চলেছে৷ এই আত্মকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী একদল মানুষ নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে ছল বল কৌশলে পৃথিবীর কোটি কোটি নিরীহ হতভাগ্য মানুষকে বিভিন্ন ইজম ও তত্ত্বের মোহজালে আবদ্ধ ও পঙ্গু করে চরম ভাবে শোষণ ও বঞ্চনা করে পৃথিবী সকল সম্পদ আত্মসাৎ করে চলেছে৷ প্রাচীন কাল থেকে সেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সেই মুষ্টিমেয় ধান্দাবাজ মানুষ রাজাকে ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসাবে প্রচার করে গরিব সকল প্রজাদের রক্ত মোক্ষণ করেছে৷ এই শোষণে ঘৃতাহুতি দিয়েছে সমাজের পরগাছা স্বরূপ পুরোহিত, মোল্লা, যাজকরা৷ বিভিন্ন ধর্মমতের সেবক তারা নানা কুসংস্কার, মিথ্যা কর্মফলের দোহাই দিয়ে সকল গরিব মানুষদের সুষ্টুভাবে বেঁচে থাকার সকল সুযোগ হতে বঞ্চিত করে সব কিছু কুক্ষিগত করে এক ভয়ংকর শোষণ–ব্যবস্থা কায়েম করেছে৷

বর্ত্তমানে অতীতের রাজতন্ত্রের বা বাদশাহীতন্ত্রের পরিবর্ত্তে গোষ্ঠী ও দলতন্ত্রের জন্ম হয়েছে যারা সেই অতীতের জাত, পাত, ভেদাভেদকে মূলধন করে সমাজকে শোষণ করছে৷ এরা ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ‘ভ্যাম্পায়ার’ বিশেষ৷ ঠিক তার পাশাপাশি ভ্রষ্টাচারী একদল অতিবিপ্লবী জড়বাদী বুদ্ধিজীবীদের দেখা গেল তারা ‘কমিউনে’ বিশ্বসী কমিউনিষ্ট হয়ে বিশ্বের শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের আহ্বান দিয়ে হিংসাশ্রয়ী, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে কমিউনিষ্ট শাসনের নামে মারাত্মক শোষণ আনলো৷ পরে সেই সব দেশের হতভাগ্য শ্রমিক, কর্ষকগণ চরম ভাবে অবহেলিত হয়ে রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাদের উৎখাত করলো৷ আজ দেখা গেল সেই পুঁজিবাদী ও জড়বাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতারা নিছক শাসন ব্যবস্থা কায়েম রাখতে নিজেদের লোভ ও শোষণকে বাঁচাতে একই নৌকায় এসে হাজির হয়েছে৷

তাই তো প্রাউটিষ্টরা সারা পৃথিবীতে প্রতিটি সমাজে সার্বিক শোষণ মুক্তির আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে৷ প্রাউটিষ্টরা আহ্বান জানাচ্ছে–  বিশ্বের নীতিবাদীরা এক হও৷ বাঁচ আর অপরকে বাঁচতে দাও৷ সমবায়ের মাধ্যমে প্রতিটি ব্লকে কৃষি ভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াও৷ এর মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোল৷ স্বার্থান্বেষীরা বাধা দেবে যে বাধা খড়কুটার মতো ভেসে যাবে যদি শোষিত মানুষরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়৷