রাষ্ট্রভাষার যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তা

লেখক
খগেনচন্দ্র দাস

বিশ্বজোড়া মানুষের ব্যবহৃত ভাসার সংখ্যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে৷ সঠিক সংখ্যা নিয়ে প্রচুর মতভেদ রয়েছে৷ তবে একথা সর্বজন স্বীকৃত যে প্রতিদিন কিছু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ও গড়ে চল্লিশ শতাংশ ভাষাই ধবংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ বিশেষ করে সেইসব ভাষা যেগুলোতে কথা বলা মানুষের সংখ্যা হাজারেরও কম৷ এই যে একেকটি ভাষা হয়ে যাচ্ছে তার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে৷ তবে একথা  অনস্বীকার্য যে একটা  ভাষার স্বাভাবিকভাবেও বিলুপ্তি ঘটতে পারে আবার অস্বাভাবিক মৃত্যু ও হতে পারে৷ কতকটা মানুষ ও অন্যান্য জীবের মতো৷ অস্বাভাবিক মৃত্যু মানুষ বা ভাষা যারই হোক না কেন সেই মৃত্যুর জন্য কেউ না কেউ কোনো না কোনোভাবে দায়ী৷ সে দায় কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, পৃথিবীর কোনো পুলিশ, আইন তাকে ধরতে পারুক বা না পারুক৷ আত্মহত্যা বলে কোন কিছু হয় না হতে পারে না,  সে ভাষা বা মানুষ যাই হোক না কেন৷

প্রত্যেকটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব, গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে পতাকা,  সঙ্গীত, কবি-সাহিত্যিক, ভাষা, ফুল, পশু-পাখি এমনকি খেলাকেও স্বীকৃতি দেয় ও এসবই শ্লাঘার বিষয়৷ এসব সাধারণত প্রাজ্ঞজনেরাই ঠিক করেন কিন্তু আমাদের জন্য জাতীয় পতাকা, পশু, পাখী, ফুল, সঙ্গীত (যা নিয়ে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি) এসব তো বেছে দিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা নির্বাচনে এসেই আটকে গেলেন৷ শুধু আটকে যাওয়া নয় একেবারে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়লেন৷

১৯৪৯ সনের ১৩ সেপ্ঢেম্বর তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রাষ্ট্রভাষার ভাগ্য নির্ধারণ করতে সংযুক্ত অধিবেশন বসেছিল৷ ভারতীয় সংসদে অসাধারণ মেধা সম্পন্ন সাংসদের অভাব যেমন কোন দিনই ছিল না তেমনি তার পাশাপাশি অশিক্ষিত (আক্ষরিক অর্থে নয়) অযোগ্য সাংসদের ও খামতি ছিল না৷ সেই সভার বিস্তৃত বিবরণ এখন অন্তরর্জালে সহজেই উপলব্ধ৷ সেই সভার দুজন সাংসদের বক্তব্য থেকে দুটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি৷ আর.ভি.ধোলোকের মারাঠী মানুষ ইনিয়ে বিনিয়ে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা বলে গ্রহণ করার জন্য দাবি জানালেন৷ অপরদিকে শশীকান্ত মৈত্র সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার পক্ষে যুক্তি দেখালেন৷ তিনি সংস্কৃতকে বিশ্বের প্রাচীনতম, অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও সমস্ত ভাষার জননী স্বরূপা বলে উল্লেখ করলেন৷’ অর্থাৎ কোনো আধুনিক ভারতীয় ভাষাই সংস্কৃত ভাষার ঋণ অস্বীকার করতে পারে না৷ হিন্দি তো নয়ই৷ আমরা ভাষা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ কিন্তু শশীকান্ত মৈত্র-র মতো বহু প্রাজ্ঞজনকে সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে অনুরূপ মত প্রকাশ করতে দেখেছি৷ কিন্তু না, সেদিন মৈত্র মহাশয়ের মত পণ্ডিত ও দূরদর্শীর কথা বিজ্ঞ! সাংসদরা গ্রহণ করেন নি৷ সেদিনের সবজান্তা রাজনীতিওয়ালারা হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মুকুট পরাতে না পারলেও অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অর্থাৎ কাজকর্মের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিয়েছে৷

এই সিলমোহর লাগিয়ে বলা হলো আগামী পনেরো বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সন পর্যন্ত ইংরেজি থাকবে হিন্দি দোসর বা সহযোগী হিসেবে৷ কার্যত ইংরেজি নয় হিন্দিই থাকলো ইংরেজির দোসর হয়ে৷ পঞ্চান্ন বছরে গঙ্গা যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে কিন্তু হিন্দি আজও ইংরেজিকে বাদ দিয়ে চলতে শেখেনি কবে পারবে, আদৌ কোন দিন পারবে কি না কেউ জানি না৷

২০১১ সনের এমনিই পরিহাস যে পঁচাত্তর শতাংশ মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো পঁচিশ শতাংশের হিন্দিকে৷ এরই নাম কি গণতন্ত্র? সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ‘রাজভাষা’ ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’ ‘যোগাযোগের ভাষা’ এইসব শব্দজালে জড়িয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই একশ্রেণীর নেতা নেত্রী কার্যত হিন্দিকেই পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রভাষার গৌরব পাইয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করে চলেছেন৷ তবে হ্যাঁ একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে বলিউড ও হিন্দি, টেলিভিশন চ্যানেল যার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে হিন্দিতে অনূদিত দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা, এদের মিলিত প্রচেষ্টায় হিন্দি, ছেলেমেয়েদের প্রেম নিবেদন ও মস্তানদের কাঁচা খিস্তির ভাষা হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ অবশ্য ইংরেজি যেভাবে হিন্দি ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে তাতে সব ভারতীয়  ভাষার সঙ্গে  হিন্দির ও নাভিশ্বাস উঠতে খুব বেশি দেরি নাই৷ কথায় বলে, তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে৷ না, কোনো সুদূর গোকুলে নয় হিন্দি ও সমস্ত আঞ্চলিক ভাষাকে বধের জন্য চোখের সামনেই সগর্বে বেড়ে উঠছে ইংরেজি৷ এর গতিরোধ করার ক্ষমতা কারও নেই, উচিত ও নয়, প্রয়োজন ও নেই৷ মুক্ত বাজার অর্থনীতির মতো ভাষার ও মুক্ত  ওসুস্থ প্রতিযোগিতায় চলুক  না৷ যদিও ভাষা সংরক্ষণে সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব আছে৷ কিন্তু  একটা ভাষা সমৃদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হলে ক্ষতি কি?

অসংখ্য চালবাজী, জালিয়াতি, বাকচাতুরীর মধ্যে আসল রাষ্ট্রভাষার কথাটাই নেতারা গুলিয়ে ফেলছেন না তো? রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজনটা কী? আদৌ রাষ্ট্রভাষার কোনো প্রয়োজন আছে কি? রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজন কি সেই নির্দিষ্ট ভাষাটির স্বার্থে না রাষ্ট্রের স্বার্থে? আমাদের মত অক্ষম, অর্বাচিনদের ধারণা, সম্পূর্ণ উদার, অরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রয়োজনটা রাষ্ট্রের, ভাষার নয়৷ অবশ্য সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখলে (প্রচলিত রাজনীতিওয়ালারা রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি এভাবেই দেখতে অভ্যস্ত) রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজন রাজনীতির জন্য৷

কারণ অন্যান্য প্রতীকগুলো যেমন সম্মানের রাষ্ট্রভাষা ও তেমনি৷ রাষ্ট্রের ঐক্য সংহতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা একটা অদৃশ্য অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ ঠিক যেমন সংসারে মা বাবা, পূর্বপুরুষ অনুপস্থিত থেকেও ছায়ার মতো আমাদের আগলে রাখেন৷ তাঁদের অস্তিত্ব আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে  পারি না বরং প্রতিমুহূর্তে অনুভূত হয়৷ ঠিক তেমনি একটা রাষ্ট্রভাসা রাষ্ট্রকে, সেখানে বাস করা মানুষদের ছায়ার মতো আগলে রাখে, একটা অদৃশ্য বন্ধনে তাদের বেঁধে রাখে৷ তার ঋণ কোনো নাগরিক অস্বীকার করতে পারেন না৷

সংস্কৃতের পরিবর্তে পরোক্ষভাবে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার যে আত্মঘাতী অপপ্রয়াস ভারতীয় নেতৃবৃন্দের  একাংশ স্বাধীনতার পর থেকে আসছেন এই অবিমৃষ্যকারীতার ফল সম্পর্কে তাঁরা আদৌ সচেতন কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে৷

স্বাধীনতার পর যে সমস্ত পণ্ডিত একদিন সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে স্বাধীন ভারত ঐক্যবদ্ধ  থাকতে পারবে  না (অমর্ত্য সেন-এর তর্কপ্রিয় বাঙালি দ্রষ্টব্য) নেতাদের এই ভোটসর্বস্ব বালখিল্য রাজনৈতিক বুদ্ধি সেই তাদের সন্দেহকেই  বাস্তবায়িত করবে না তো?

আমরা অত্যন্ত সাধারণ নাগরিক হিসেবে বর্তমানের শাসক দলের রাজনৈতিক শক্তি ও সদিচ্ছার প্রতি আস্থা রেখে আবেদন করছি, অবিলম্বে সংস্কৃতকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিন৷ সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিলে দক্ষিণভারত সহকোনো ভাষাগোষ্ঠীরই আপত্তি হবে বলে মনে হয় না৷ হিন্দি সহ সমস্ত আঞ্চলিক ভাষাকে সমদৃষ্টিতে বিচার করে  জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাষাগুলির উন্নয়নে অর্থ বন্টনের ব্যবস্থা করন এর মধ্যেই নিহত রয়েছে ভারতের ঐক্য সংহতি সুদৃঢ় করার চাবি৷

এখনও সব শেষ হয়ে যায় নি৷ মাতৃস্বরূপা সমৃদ্ধশালিনী, সকলের শ্রদ্ধেয় সংস্কৃতকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে বিগত সাত দশকের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আপনারাই করুন৷ রাজকোষের টাকা  খরচ করে অহিন্দিভাষীদের হিন্দি শেখানোর  প্রলোভনের অভিনয় অবিলম্বে বন্ধ হোক৷ সেই সঙ্গে হিন্দির মতো অর্বাচীন একটি ভাষার গায়ে ধ্রুবদী ভাষার তকমা পরাবার চেষ্টাও বন্ধ করুন ৷ কারণ হিন্দির চেয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন, প্রাচীনত্বের দাবি রাখা সমৃদ্ধ আঞ্চলিক ভাষা আরও আছে৷ হিন্দির সঙ্গে তাদেরকেও ধ্রুপদীর স্বীকৃতি দিতে হবে৷ তাছাড়া ইংরেজির মত সমৃদ্ধ, বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃত ভাষাও কিন্তু ধ্রুপদী নয়, আর ছেলে মানুষের মত কারও সেরকম দাবি করাও উচিত নয়৷ কী হবে ধ্রুপদীর তকমা লাগিয়ে আম গাছে আপেল গাছের ছাল লাগিয়ে দিলেই কি আম গাছে আপেল ধরবে? আর তাছাড়া ধ্রুপদী ভাষা হওয়ার কোনো শর্তই কি হিন্দি ভাষা পূরণ করতে পারবে? তার চেয়ে ও বড় কথা হিন্দিরে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা দিতে হলে ধ্রুপদী ভাষার মৌলিক সংজ্ঞাটাই যে পাল্টাতে হবে!

সবশেষে, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার আকর্ষণ দুর্নিবার, অমোঘ, সে ভাষা সে ভূমি যতই অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন৷ এ দুটোর অপমান, অবজ্ঞা, অবহেলা মানুষ দীর্ঘ দিন সয় না৷ ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে৷ একটা সময়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠবেই৷ এসব নিয়ে রাজনীতি একেবারেই আগুন নিয়ে খেলার মত৷ সে আগুনে শুধু মানুষ নয় রাজনীতির সমস্ত রঙিন আশাও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে৷