স্বপ্ণে মোড়া নির্বাচন

লেখক
মিহির কুমার দত্ত

সারাদেশ জুড়ে শুরু হয়ে গেল উৎসব৷ বোট বোট উৎসব৷ সারা বৎসর ধরেই নানান উৎসবে মেতে থাকে মানুষ৷ কিন্তু এই বোট উৎসব আসে নিয়ম করে পাঁচবৎসর পর পর৷ যদিও ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত বা রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার তৈরী করার জন্যে প্রায়ই মানুষ বোট নিয়ে ভাবে অথবা বোটে সরাসরি নিজ ভূমিকা পালন করে৷ এই ২০১৯ সালে ভারতবর্ষের সংসদীয় রাজনীতির ১৭তম বোট অনুষ্ঠিত হতে চলেছে৷

স্বপ্ণ দিয়ে মোড়া

যতো দ্রুত সম্ভব ১৫০কোটি জনসংখ্যাকে ছঁুয়ে ফেলতে চাওয়া ভারতীয় জনসুনামী এখন ১৩০ কোটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেও ৯০ কোটি বোটার তৈরী করে ফেলেছে৷ বোটের জন্যে নির্দিষ্ট দিনে লাইনে দাঁড়িয়ে গর্বের সঙ্গে নিজের বোটাধিকার প্রয়োগ করবে যতদূর সম্ভব ৮০ থেকে ৮৪ শতাংশ মানুষ৷  তারা প্রত্যেকেই চোখ বুজে ই.ভি.এম মেশিনের বোতাম টিপবেন তাদের পছন্দের দল কিংবা প্রার্থীকে শাসন ক্ষমতায় বসানোর জন্যে৷ বোতম টেপার আগে বুকের মধ্যে টগ্বগ্ করে ফুটবে একরাশ স্বপ্ণ৷ তার সন্তানের দুধে ভাতে বেঁচে থাকার স্বপ্ণ৷ তাঁর মা কিংবা বাবার অসুস্থ শরীরে প্রয়োজনের ওষুধটা পাওয়ার স্বপ্ণ৷ বিবাহযোগ্যা অসহায় মেয়েটির একটা গতি হয়ে যাওয়ার স্বপ্ণ৷ হঠাৎ করে চাকরী হারিয়ে বেকার হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো স্বামীর একটা সম্মানজনক কাজের স্বপ্ণ৷ শিক্ষাগত যোগ্যতা মানে পৌঁছেও কেবলমাত্র ঘুষের টাকা দিতে না পেরে চাকরী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় পাগল পাগল অবস্থায় দিশাহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া যুবক ছেলেটার সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ণ৷ এই একরাশ স্বপ্ণই কারো কারো ক্ষেত্রে ফলাফল ঘোষণার দিনে মুখে হাসি ফোটাবে আবার কাউকে করবে হতাশ৷

এই হাসিমাখা মুখ কিংবা হতাশায় ভেঙে যাওয়া মুখগুলি আসলে একই পয়সার এপিঠ আর ওপিঠ৷ ফলাফলের সাময়িক প্রভাবে তাদের মুখে হাসি ও হতাশা ফুটলেও আসলে কিছুদিনের মধ্যেই তারা প্রত্যেকেই চরম হতাশ হয়ে আফসোষ করবে, মাথার চুল ছিঁড়বে৷ অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করবে কিংবা মুখ ফুটে বলবে যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ৷ আসলে বোটারের জন্যে বোট নয়৷ বোট হয় রাষ্ট্র ক্ষমতার দখলদারীর জন্যে সাধারণ বোটারের সঙ্গে দায়িত্বের সঙ্গে ধোঁকাদারী করার জন্যেই৷ বিত্ত-বৈভবকে নিজ কুক্ষিগত করার জন্যে৷ এখানে বোটার নামক চলমান মানুষগুলি আসলে নেতা-মন্ত্রীদের দাবার বোর্ডে ঘুরে বেড়ানো বোড়ের মতো৷ সবার আগে তাঁদেরই বোর্ড থেকে তুলে নেওয়া হয়৷ সবার আগে মৃত্যু মুখে পড়ে তারাই৷ স্বপ্ণে মোড়া সে মৃত্যু৷

বোট ফর ইণ্ডিয়া

পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতবর্ষে বোটাধিকার প্রয়োগ করাটা সাধারণ নাগরিকদের আশু কর্তব্য ও তার মাধ্যমে বোটার একজন সুনাগরিক বা দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে পরিচিতি পান৷ বোটের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আসলে বোট করানোর পিছনের কারণতো উহ্যই থাকে৷ বোটারকে নির্দিষ্ট দিনে বোট কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে বোট দান করানোটাই দেশের নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ৷ তার পরবর্তী ঘটনাক্রম নিয়ে তার মাথা ব্যাথার কোন কারণ নেই৷

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের মাটিতে যতবার বোট হয়েছে, ততবার দেশের শাসন ব্যবস্থা সচল রাখতে মন্ত্রিসভা ঘটন করা হয়েছে , যতবার মানুষের দু’চোখ স্বপ্ণ দেখেছে সুন্দর ভারতবর্ষের, ততবারই সাধারণ মানুষ চরম হতাশার শিকার হয়েছে৷ ততবারই ভারতবর্ষের মানুষের সমৃদ্ধ চেতনাকে তিলে তিলে ধবংস করা হয়েছে৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বোটের মাধ্যমে যতবার দেশে নোতুন নোতুন সরকার কিংবা মন্ত্রিসভা ঘটন করা হয়েছে প্রায় প্রত্যেক বারই সেই সরকার কিংবা মন্ত্রীরা দেশে ও বিদেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের পলিটিকাল ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করে গেছে, তাদের প্রত্যক্ষ মদতে একচেটিয়া পুঁজি মালিকরা দিনে দিনে আর্থিক দিক দিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে৷ তাদের মুনাফা ক্রমশঃ আকাশ ছঁুয়ে ফেলেছে৷ অন্যদিকে সাধারণ মানুষের দুর্দশা চরম আকার ধারণ করেছে৷

দেশের শাসন ক্ষমতায় বসে মন্ত্রী- আমলা-সান্ত্রীরা যে নীতি নিয়ে চলেছে, তাতে পরিষ্কার হয়ে গেছে ভারতবর্ষ দুটো ভাগে বিভক্ত৷ একটা আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র ভারতবাসী৷ আরেকটা আর্থিক সচ্ছলতার চকচকে ধনী ভারতবাসী৷ মন্ত্রীরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে দেশের বেশীরভাগ মানুষকে দারিদ্র্যের অন্ধকারে ফেলে রেখে আর তাদের প্রতি দয়া দেখাতে দরিদ্রদের দিকে দুটো অনুদান ছঁুড়ে দেওয়াটা তাদের একমাত্র কাজ বলে মনে করে ও সেই দরিদ্র ভারতবাসীকে লোভ দেখিয়ে তাদের বোট লুট করে গদীতে বসে পুঁজির মালিকদের সেবা করে যাওয়াটাই তাদের জীবনের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান বলে মনে করে৷

এরাই ক্রমে দরিদ্র সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে শুধুমাত্র পুঁজিমালিকদের সেবা করতে করতে সাধারণ মানুষের, বঞ্চিত মানুষের কাছে ঘৃণার ও ধিক্কারের পাত্রে পরিণত হয়ে যায়৷ তখন দেশের পুঁজিপতিদের তাঁবেদার মিডিয়া কোম্পানি ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলি দেশের মানুষের কাছে বিকল্প নেতা---বিকল্প মন্ত্রী কিংবা বিকল্প সরকারের স্বপ্ণ দেখায়৷ প্রচারের মধ্যে দিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে বোঝায় যে ধিকৃত নেতা বা মন্ত্রীর পরিবর্তে আবার সাধারণ মানুষের উচিত বোট দিয়ে নোতুন নেতা বা মন্ত্রিসভা ঘটন করা৷ তারজন্যে পুঁজিপতিদের তাঁবেদারী করে চলা মিডিয়া তাদের প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে মানুষকে বোঝায় জনগণই বোট দিয়ে তাদের মনের মতো নেতা তৈরী করে৷ তারাই তাদের মনের মতো সরকার ঘটন করে৷ জনগণের হাতেই সব ক্ষমতা৷ আসলে সাধারণ মানুষের হাতে কোন ক্ষমতাই নেই৷ সকল ক্ষমতাই পুঁজিপতিদের হাতে ধরে রাখা থাকে৷ তারাই ঠিক করে দেশে নির্বাচনের পর কারা সরকার ঘটন করবে কারা মন্ত্রী হবে৷ তারপর দেশ শাসন করা নীতি-নির্র্ধরণ করা থেকে শুরু করে পুঁজির সেবা করা সবটাই৷

বোট পরবর্তী সময়ে সকল ঘি-মাখন- মালাই চেটেপুটে খায়, পুঁজিপতিরা ও তাদের সাহায্য কারীরা আর গরীব সাধারণ মানুষের জন্যে পরে থাকে অনুদান নামক ভিক্ষাটুকু৷

এই অনুদান নামক ভিক্ষা ও শোষণে জর্জরিত শ্রমিক থেকে কর্ষক, নারী ও পুরুষ, হিন্দু থেকে মুসলমান সকলেই ক্ষোভে ফঁুটছে৷ এরকম ক্ষোভ-বিক্ষোভ যাতে কোনভাবেই সংঘটিত রূপ না পায়৷ তা যেন কোনো ভাবেই গণ আন্দোলনের আকার না পায়৷ তাঁকে যেকোনোও ভাবেই হোক শেষ পর্যন্ত যেন বোটের বাক্সে এনে ফেলা যায়, তার জন্যই প্রচার কৌশল৷ তারজন্যেই মাথা ব্যাথাহীন নির্বাচন কমিশন নামক অমৃত ভাণ্ড৷

আর এসব কিছু মিলিয়ে মিশিয়ে যা দাঁড়ায় তা হলো, যা খুশি হয়ে যাক৷ পেটে ভাত জুটুক বা না জুটুক৷ স্বপ্ণ সফল হোক কিংবা বিফলে যাক, কুছ পরোয়া নেই৷ কিন্তু নির্বাচন নামক মহাযজ্ঞে সামিল হতে হবে সকলকে৷ বোট দানের মাধ্যমে আত্মাহুতি দিতে হবে সকলকে৷ শোষণের বিশ্বস্ত শ্রমিককে ক্ষমতায় বসাতে হবে৷ জন্মসূত্রে শোষণে জর্জরিত হওয়ার ক্ষমতা পাওয়া সাধারণ মানুষকে তাদের নিজ মুখে বলাতে হবে---

বোট ফর ইণ্ডিয়া, বোট ফর ইণ্ডিয়া

নোতুন ভারত গড়ার জন্যে বোট দাও,

নোতুন ভারত গড়ার জন্যে বোট দাও৷