শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের দৃষ্টিতে দূর্গোৎসব

লেখক
আচার্য ব্রজেশ্বরানন্দ অবধূত

অনেকের ধারণা দূর্গাপূজা খুব পুরোনো পূজা, কিন্তু তা মোটেই নয়, মুসলমান যুগেই এর প্রচলন হয় অর্থাৎ একেবারেই পুরোনো নয়৷ বর্তমানে শরৎকালে বাঙালী হিন্দুরা যে দূর্গাপূজা করেন তার ভিত্তি হচ্ছে কৃত্তিবাস ঠাকুরের বাংলা রামায়ণ৷ কৃত্তিবাসী বাংলা রামায়ণে আছে যে  রামচন্দ্র শরৎকালে দূর্গাপূজা করেছিলেন ১০৮টা কমল দিয়ে৷ কিন্তু বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণে এ কাহিনী নেই৷ তুলসী দাসের রামচরিত মানসেও এসব কথা নেই৷ রামচন্দ্র যদি  দূর্গাপূজা করতেন তাহলে তা অবশ্যই বাল্মীকি রামায়ণে থাকত৷

তাহলে প্রশ্ণ জাগে কৃত্তিবাস ঠাকুর এ কাহিনী পেলেন কোথায়? আসলে বাংলায় প্রথম দূর্গা পূজা করেছিলেন রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ রায়৷ কংস নারায়ণ নারায়ণের প্রচুর টাকা ছিল৷ তিনি পণ্ডিতদের  বললেন---আমার এত টাকা আছে, আমিও রাজসূয় যজ্ঞ করবো৷ তখন পণ্ডিতেরা বললেন---দেখ, কলিকালে তো রাজসূয় যজ্ঞের বিধি নেই৷ তা’ তুমি মার্কণ্ডেয় পুরাণে যে দূর্গা পূজার উল্লেখ আছে, খুব টাকা খরচ করে তা-ই করো৷ কংস নারায়ণ তখন সেকালের সাত লাখ টাকা খরচ করে দূর্গাপূজা করলেন৷ তা দেখে  পরের বছর  রাজা জগদবল্লভ মতান্তরে জগৎ নারায়ণ সাড়ে আট লাখ টাকা  খরচ করে রেষারেষি করে দূর্গা পূজা করলেন৷ তার পরে জমিদারে জমিদারে রেষারেষি, প্রতিযোগিতা লেগে গেল৷ জমিদারের ঘরের পূজা হয়ে দাঁড়াল দূর্গা পূজা৷ আসলে উদ্দেশ্য ছিল কার কত টাকা তাই দেখানো৷ প্রচুর লোক খাইয়ে দেব, প্রচুর সাজগোজ করাব৷ প্রতিযোগিতা চললো জমিদারে জমিদারে৷ ছোট হোক, বড় হোক, মেজো হোক -সব জমিদারই দূর্গা পূজা শুরু করলেন৷ এখন যেমন কলিকাতার ক্লাবগুলোতে দূর্গাপূজা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে৷ এ হচ্ছে পাঠান যুগের কথা৷

সেই সময় হুগলী জেলার বলাগড় থানার গুপ্তিপাড়ার বারজন বন্ধু ভাবলেন যে আমরা এককভাবে না হয় পারব না, কিন্তু বারজনে মিলে তো পূজার আয়োজন করতে পারি৷ উর্দু ভাষায় বন্ধুকে বলে ‘ইয়ার’৷ তাই বার জন ইয়ারে মিলে  যে দূর্গা পূজা করলেন সেটা হলো  ‘বারইয়ারী’পূজা--- বারোয়ারী পূজা৷ কিন্তু বারোয়ারী পূজায় যেহেতু ‘অন্তজ’ লোকেদের অঞ্জলি দেবার অধিকার থাকে না, সেই জন্যে  আধুনিক কালে বারোয়ারী পূজা বিবর্তিত হয়ে হ’ল সার্বজনীন দূর্গা পূজা৷ এতে সবাইকার সমান অধিকার থাকে৷ বর্তমানে এই সার্বজনীন দূর্গাপূজা হয়ে দাঁড়িয়েছে সার্বজনীন দূর্গোৎসব৷ এই দূর্গাপূজা পাঠান যুগের গোড়ার দিকে শুরু হয়৷ তখন বাংলার নবাব ছিলেন হুসেন শাহ৷ হুসেন শাহ বিদ্যোৎসাহী ছিলেন৷ বাংলা সাহিত্যে যাতে ভাল ভাল বই লিখিত হয়, সংস্কৃত ভাষায় ভাল ভাল বইগুলো যাতে বাংলায় অনুদিত হয় সেই জন্যে তাঁর চেষ্টার  ত্রুটি ছিল না৷

তাঁর অনুরোধেই কবি কৃত্তিবাস ঠাকুর বাংলা ভাষায় রামায়ণ লিখলেন৷ বাঙলায় সে সময়ে জমিদার বাড়ীতে দূর্গা পূজা শুরু হয়ে গেছে৷ এই দূর্গা পূজাটাকে অধিকতর মহিমা দেবার জন্যে তিনি তাঁর বাংলা ভাষায় লেখা রামায়ণে রাম কর্তৃক  দূর্গা পূজার কথা উল্লেখ করেছিলেন৷ তাই রাম যে দূর্গা পূজা করেছেন বলা হয় তার সূত্র হ’ল বাংলায় রচিত কৃত্তিবাসের রামায়ণ৷

মার্কণ্ডেয় পুরাণের সংক্ষিপ্ত নাম চণ্ডী, এতে দেবী দূর্গার  কথা রয়েছে৷ রাজা সুরথ দূর্গা পূজা করেছিলেন তার উল্লেখ আছে৷ কিন্তু রাম যে দূর্গা পূজা করেছিলেন সে কথা নেই৷ পুরাণ মানে যার ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, কিন্তু শিক্ষাগত মূল্য অবশ্যই রয়েছে৷ এখানে আছে, দেবী দশ হাতে প্রহরণ ধারণ করে মহিষাসুররূপী অশুভ শক্তিকে, পাপশক্তিকে সংগ্রামে পরাজিত করে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে এনেছেন৷ এখানে দেবী দূর্গা হলেন সমস্ত শুভশক্তির প্রতীক আত্মিক শক্তির প্রতীক৷ অসুরের অত্যাচারে, পাপীদের অত্যাচারে, অশুভ শক্তির অত্যাচারে যখন মানবতা ভূলুন্ঠিত নিষ্পেষিত, পর্যুদস্ত তখন সমস্ত দেবতারা অর্থাৎ সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা , সমস্ত  নিপীড়িত নির্যাতীতেরা সংঘবদ্ধ হলেন, তাদের আকুল আবেদনে আবির্ভূতা হলেন আদ্যাশক্তি দেবী দূর্গা৷তিনি সমস্ত শুভশক্তি সম্পন্ন মানুষের শক্তিকে একত্রিত করে আসুরী শক্তিকে সংগ্রামে পরাজিত করলেন৷

আজ একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আসুরী শক্তি আবার জেগে উঠেছে, পাপশক্তির অভ্রংলেহী আস্ফালনে চারিদিক কেঁপে উঠেছে৷ মানবতা আজ নির্যাতীত, ভূলুন্ঠিত৷ তাই আজ দরকার সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের একতা বদ্ধ হয়ে আসুরী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা৷ নিপীড়িত, ভুলুন্ঠিত মানবতাকে রক্ষা করা৷ আর তা করতে পারলেই আমাদের দূর্গোৎসব সার্থক হবে৷ সমাজে ফিরে আসবে শান্তি৷ দূর্গোৎসব তাই আসুরী শক্তির বিরুদ্ধে, অশুভ শক্তির  বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হোক৷

এখন এই সংগ্রাম কি শুধু বাইরের আসুরী শক্তির বিরুদ্ধে? না, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে  এই আসুরী শক্তি রয়েছে৷ প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে রয়েছে ষড়রিপু আর অষ্টপাশ৷ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এই ছয়টা হ’ল রিপু আর ঘৃণা, শঙ্কা ভয়, লজ্জা. জুগুপ্সা, কুল, শীল, মান এই আটটা হ’ল পাশ৷ মানুষ এই ষড়রিপু আর অষ্টপাশের  বশীভূত হয়ে ছুটে চলে জাগতিক ভোগের দিকে৷ এই বৃত্তিকে চরিতার্থ করতেই সে অন্যের প্রাণরস নির্মমভাবে শোষণ করে, অন্যের ওপর অত্যাচার করে তাইতো সমাজে এত হানাহানি,এত রক্তপাত৷

এখন মানুষকে এর থেকে বাঁচতে তার আত্মিক শক্তির জাগরণ ঘটাতে হবে৷ মনের সমস্ত শুভবৃত্তিকে বিকশিত করতে হবে৷ তার বহির্মুখী বৃত্তি অর্থাৎ ষড়রিপু ও অষ্টপাশের  উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে৷ তাই মানুষকে বহির্জগতে অশুভ শক্তির  বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাথে সাথে তার অন্তর্জগতের  বহির্মুখী বৃত্তির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করে চলতে হবে৷ এই বহির্মুখী অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হোক দূর্গোৎসব৷