উন্নয়নের স্বার্থে গ্রামবাঙলার অতীত নিদর্শন তুলে ধরে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে হবে

লেখক
প্রবীর সরকার

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন–‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপর/ একটি শিশির বিন্দু৷’

সত্যই কথাটা শুধু মর্মস্পর্শী নয়, বেদনারও৷ এই বাঙলার মানুষজন দিল্লী, কশ্মীর, মানালি, ব্যাঙ্গালোর, মুম্বাই ও পাহাড়–পর্বতে যায় কিন্তু এই বাঙলার জেলাগুলোতে যে কত সুন্দর দর্শনীয় স্থান আছে তার সংবাদ রাখে না৷ এই কথাগুলো আজ বলছি বিশেষ কারণে, কারণ পর্যটন বর্ত্তমানে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক৷ যদি পশ্চিম বাঙলার দক্ষিণবঙ্গে, পশ্চিমের বনাঞ্চলে ও উত্তরের আকাশছোঁয়া ঢ়েউ খেলানো জেলাগুলোর দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাওয়া যায় তা হলে এই হতভাগ্য সমস্যা সংকূল পশ্চিম বাঙলা যেমন আর্থিক দিক হতে লাভবান হবে তার সঙ্গে সঙ্গে বাঙলার মানুষজন বাঙলাকে চিনতে পারবে৷ তাতে এই মাটির প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণ আরো বাড়বে ও দৃঢ়তর হবে৷  প্রথমেই বলি এই খণ্ডিত, সমস্যা সংকূল পশ্চিমবাঙলার প্রাচীন ইতিকথার বহু নিদর্শন আজ মালদহ, মুর্শিদাবাদের মাটিতে পড়ে আছে৷ ভাবলে দুঃখ লাগে বন জঙ্গলে ঢ়েকে আছে প্রাচীন বাঙলার দর্শনীয় অনেক কিছুই৷ প্রথমে এই সব জেলার প্রশাসনকে ওই সব স্থানে যাতায়াতের রাস্তাঘাটগুলোর সংস্কার করতে হবে৷ যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে৷ থাকার ব্যবস্থা, নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে যাতে করে পর্য্যটকগণের কোন থাকা–খাওয়ার ও নিরাপত্তার বিঘ্ণ না ঘটে৷

উত্তর বাঙলার কোচবিহার, উত্তর–দক্ষিণ দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ির পাহাড়–পর্বতের ঢ়েউ খেলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাহাড়ী নদ–নদী তীরভূমি সহ আরো অনেক কিছুই বিশেষ বিশেষ ঋতুতে হাতছানি দিয়ে ডাকছে৷  যদি দু’চার দিনের জন্যে এই সব স্থানে যাওয়া যায় তাহলে এই বঞ্চিত হতভাগ্য পশ্চিম বাংলাকে দূরে ঠেলে দিয়ে  দূর দেশে যাওয়ার কথা মনে আসবে না৷ ঘর হবে আপন৷ বার বার ছুটে যেতে ইচ্ছে করবে৷ শুধু তাই নয়, দর্শনীয় স্থানগুলিতে মানুষের আনাগোনা হবে, স্থানীয় লোকের রুজি–রোজগার বাড়বে৷ সরকারেরও আয় বৃদ্ধি হবে৷ তবে ব্যবসাদার হাঙ্গরেরা যাতে থাবা বসাতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে৷ স্থানীয় পঞ্চায়েৎ, মিউনিসিপ্যালিটি ও থানার নজর যেন থাকে এই সব এলাকায়৷ সমবায় ভিত্তিতে থাকা ও খাওয়ার সুলভ মুল্যে যাতে ব্যবস্থা হয় সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে৷

মালদহ

মালদহের অর্থ হ’ল, ‘জলের তলায় যে চক্র বা ঘূর্ণী তার বাংলা নাম ‘দহ’৷ তাই বাংলায় যেসব গ্রাম বা শহরের নামের সঙ্গে ‘দহ’ কথাটা যুক্ত রয়েছে সেই নাম শুনেই বুঝতে হবে ওই গ্রাম বা শহরের কাছাকাছি কোথাও বড় নদী আছে বা ছিল বা তাতে ঘুর্ণী বা ‘দহ’ আছে বা ছিল৷ মহানন্দা নদীতেও এইরকম ঘূর্ণী ছিল৷ অথর্ব বেদে পরানন্দা ও অপরানন্দা নামের দুটি নদীর উল্লেখ আছে৷ এই নদী দুটি কিষাণগঞ্জের কাছে মিলিত হয়ে নাম নিয়েছে মহানন্দা৷ মল্ল ক্ষত্রিয় রাজারা যখন ওই অঞ্চলটাকে দখল করেন তখন ওই অঞ্চলের নাম রাখা হ’ল মালদহ৷’

এই জেলার পিয়ানবাড়ি, দিঘি, বাসকোনা গুপ্ত বৃন্দাবন নামে খ্যাত৷ এই জেলা হ’ল গৌড় নামে খ্যাত৷ এটা মুসলমান আমলের কীর্তিতে স্মরণীয়৷ দখল দরওয়াজা ফিরোজমিনার বিখ্যাত৷ কদম রসুল এখানে সংরক্ষিত আছে হজরত মহম্মদের পদচিহ্ণ৷ চিকা মসজিদ, পাণ্ডুয়ায় অনেক কিছু দেখার আছে৷ মুশাফিরখানা, একলাখি মসজিদ, আদিনা মসজিদ সিকান্দর শা–এর তৈরী৷ গম্ভীরা মালদহের লোক উৎসব দেখার মত৷

মুর্শিদাবাদ ঐতিহাসিক জেলা

এখানকার মুর্শিদকুলি খাঁর তৈরী কাটরার মসজিদ দর্শনীয়৷ নিমকহারাম, দেউরি যেখানে সিরাজকে হত্যা করা হয়৷ হাজারদুয়ারি, খোসবাগ, আলিবর্দ্দী ও সিরাজের সমাধিক্ষেত্র৷ সীরাঝিল, মতিঝিল ও কিরীটকণায় কিরীটোশ্বরীর মন্দির দর্শনীয় স্থান৷ তাছাড়া ইংরেজ আমলে তৈরী বহরামপুর খুবই আকর্ষণীয় স্থান৷ এখানকার মহাবিদ্যালয় দর্শনীয়৷ রাঙ্গামাটিতে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ বিদ্যমান৷ জগৎশেঠের বাড়ি, সিরাজের তৈরী ত্রিপলিয়া তোরণ দর্শনীয় স্থান৷

কোচবিহার

কোচবিহার জেলা নতুন ইতিহাস নিয়েই বিদ্যমান৷ এই জেলার দর্শনীয় স্থান হ’ল কোচবিহারের রাজবাড়ি৷ দিনহাটার গোঁসাইমারিতে খেন রাজবংশের কীর্ত্তিকাহিনী দেখার মত৷ তুফানগঞ্জের রসিক বিলে পাখিরালয় দর্শনীয়৷ ভিক্টোরিয়া কলেজ ও শিক্ষাবিদ ব্রজেন্দ্র নাথ শীল মহাবিদ্যালয় দর্শনীয়৷ এই জেলায় বিভিন্ন এলাকায় শিবমন্দির আছে যার শিল্পকলা অত্যন্ত দর্শনীয়৷ মনে রাখা দরকার কোচবিহারের রাজার সঙ্গে ভারত সরকারের ১৯৫৯ সালে ১২ সেপ্ঢেম্বর চুক্তি হয়৷ এই চুক্তির বলে শাসনভার ভারত সরকারের হাতে আসে৷ ১৯৬০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা বলে ঘোষিত হয়৷ বানেশ্বরের শিবমন্দির বিখ্যাত৷ তাছাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষকে আকর্ষণ করে৷ রাজা জগদীপেন্দ্র নারায়ণ যিনি শেষ রাজা তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেন৷ তাই কোচবিহার ভারতের তথা পশ্চিমবাঙলার অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ বাংলা ভাষা শতকরা ৯৫  জনের ভাষা৷ এটা বাঙলার উপভাষা বিশেষ৷

জলপাইগুড়ি

জলপাইগুড়ি প্রাকৃতিক দৃশ্যে সমৃদ্ধশালী৷ এখানকার জপ্পেশ মন্দির হিন্দু–মুসলমান শিল্প শৈলীর সমন্বয়ে ঘটিত৷ মহাকালের মন্দির, জলদাপাড়া, হাসিমারা, বকসা বাঘ সংরক্ষণ এলাকা দর্শনীয় স্থান৷ এগুলি অভয়ারণ্য নামে পরিচিত৷

উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর

উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা দু’টো বর্তমানে হয়েছে৷ কিন্তু এটা ছিল একটা জেলা৷ এই জেলা দু’টোর জমির সীমানা অত্যন্ত সংকীর্ণ৷ ভারত ও বাংলাদেশের মাঝখানে এই জেলা দু’টো যেন একটা ছোট মুরগীর গলাবিশেষ৷

উত্তর দিনাজপুরে মহানন্দার শাখানদী কুলীক৷ এই জেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কুলি অভয়ারণ্য৷ এটি একটি পাখিরালয় বিশেষ দর্শনীয় স্থান৷ পরিযায়ী পাখিরা ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত এই স্থানে থাকে৷ এরা সুদূর সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আসে৷

দক্ষিণ দিনাজপুরে রামগড় দর্শনীয় স্থান৷ তাছাড়া তপনদিঘি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্যে প্রসিদ্ধ৷ এছাড়া দুটো দিঘি আছে যেমন কালো দিঘি ও ধলোদিঘি বানগড় থেকে হাঁটা পথে যাওয়া যায়৷

যদি উত্তরের এই সব জেলায় যাওয়া যায় ও দক্ষিণের যোগসূত্র দৃঢ় হয় তাহলে ভবিষ্যতে মিলমিশটা গাঢ় হবে ও ভাব বিনিময়ের ফলে উত্তর বাঙলার সমস্যায় জনগণের মনে ধরা পড়বে৷ তাছাড়া বর্তমান সরকারের কর্তব্য হবে নোতুন নোতুন দর্শনীয় স্থান তৈরী করা যাতে দেশের জনগণ ভাববে যে সরকার জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করে দর্শকদের আকর্ষণ বাড়াচ্ছে৷

মোদ্দা কথা হ’ল কলকাতার আশপাশের আকর্ষণ বাড়াতে ইংরেজ আমলের পরবর্ত্তীকালে অনেক কিছু হয়েছে কিন্তু উত্তরের জেলাগুলিতে যে অতীত ইতিবৃত্তের করুণ কাহিনী লুকিয়ে থেকে অস্ফুট কান্না কাঁদছে সেটার সন্ধান করা ও তার সঠিক ইতিহাস তৈরী করা৷ খোঁজ করে জনসমাজে প্রচার করাটাই হ’ল বর্তমানের সরকারের দায়িত্ব৷

 

মানবিক মূল্যবোধ ও অন্তর্নিহিত ধর্মবোধ সমাজকে শোষণমুক্ত করতে পারবে৷

এইচ এন. মাহাত

মানুষের মানবিক মূল্যবোধ, মানব মনীষা ও অন্তর নিহিত ধর্মবোধকে কুসংস্কার, বুজরুকি ও ধর্মীয় মতবাদ এর গোঁড়ামি মুক্ত করতে হলে চাই শোষণমুক্ত ও অর্থনৈতিক সাবলম্বী সমাজ ব্যবস্থা৷

মানবসমাজ আজ নানাভাবে পিছিয়ে পড়েছে মানসিক, আর্থিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বেড়াজালে৷ উন্নত সমাজ গড়তে  হলে চাই যুব সম্প্রদায়ের মানবিক বিকাশের পথগুলো উন্মুক্ত রাখা৷ এরজন্য সকলের জন্য চাই নৈতিকতার ও আক্ষরিক সুশিক্ষার পরিবেশ ও সকল নব প্রজন্মের শিক্ষান্তে কর্মসংস্থানের উপযুক্ত আর্থিক পরিকল্পনা প্রয়োজন৷ এর দ্বারা যুব সম্প্রদায়ের বৌদ্ধিক উৎকর্ষ যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি তাদের কর্মক্ষমতার পূর্ণ উপযোগ সমাজ পাবে৷ মানব সমাজকে সমৃদ্ধ করবে ও নোতুন আদর্শের আলোকে ও মানবিক মূল্যবোধে দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করবে৷

বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ও ব্যষ্টি পুঁজিবাদী শাসন ও শোষন ব্যবস্থায় হাজারো সমস্যায় নব প্রজন্ম আজ দিশাহারা ও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে৷ এই ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে একটি বাস্তব সম্মত প্রয়োগ ভৌমিক দর্শনের প্রয়োজন৷

সেই দর্শনের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক পারিকাঠামোয়--- সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন যার নাম৷

‘‘প্রাউট’’ (প্রগতিশীল উপযোগী তত্ত্ব)৷ সমাজের বুদ্ধিজীবি, ছাত্র ছাত্রা শ্রমজীবী কর্ষক, সৃজনশীল সহ সকল শ্রেণীর মনুষ যদি এই নোতুন আদর্শকে সাদরে গ্রহণ করতে পারে তবেই সামাজিক অর্থনৈতিক শোষণমুক্ত ও ধর্মীয় মতবাদের গোঁড়ামি, কুসংস্কার বুজরুকি অপশাসন মুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে৷ মানব সমাজে একটি আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে৷ প্রাউট দর্শনে কৃষি ও শিল্পের মাধ্যমে নীতিবাদী মানুষদের নেতৃত্বে সমবায়ের দ্বারা তখনই যথার্থ অর্থনৈতিক মূল্যায়ণের  মাধ্যমে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র  প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব পর৷ তেমনি মেধা ও কর্মদক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান ও আর্থিক দিক থেকে বঞ্চিত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটিয়ে মানুষের বৌদ্ধিক চেতনার বিকাশ ঘটানো যেতে পারে৷ এছাড়া মানব সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব নয়৷ এক্ষেত্রে প্রাউট বিশ্বাস করে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের নামে কোনো প্রকারের প্রতিবন্ধকতা তৈরী না করে প্রথম পদক্ষেপ স্থানীয়  ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়েছে এমন মানুষকে অগ্রাধিকার দিতে হবে৷ এর ফলে কিছু পাইয়ে দেবার নীতিতে  দলদাস তৈরী করার মানসিকতা কমে যাবে৷ প্রাউট দর্শনে বলা হয়েছে স্থানীয় ভাষায় শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ইংরাজী ভাষা বাদ্ধতামূলক হলে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন হবে ও একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব অনন্তকাল ধরে বিরাজমান হয়ে থাকবে৷

পরবর্তী পদক্ষেপে স্থানীয় ভাষাগুলো কাছাকাছি চলে আসবে ও বিশ্বভাষার পটভূমিকা তৈরী হবে৷ মানব মনীষা কখনো চাপিয়ে দেওয়া কোনো ভাষা বা সংস্কৃতিকে দীর্ঘদিন মেনে না  নিয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে বাধ্য হয়৷

এগিয়ে আসুন প্রাউটকে জানুন, আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে নোতুন পৃথিবী গড়ার বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা শুরু করতে নব চেতনার আলোকে নিজেকে মিলিয়ে দিন৷ তবেই সম্ভব শোষণ মুক্ত মানব সমাজ৷