যম নিয়ম---যোগের প্রথম পাঠ

লেখক
বিভাংশু মাইতি

সাম্প্রতিক কালে ‘যোগে’র প্রতি মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে৷ গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর সর্বত্র৷ আনন্দের কথা৷ তবে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যোগের নিখাদ মর্মকথা এখনও আমরা ঠিকবাবে আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি৷ যোগ বলতে আমরা সাধারণতঃ এখন যা বুঝি তা কিন্তু কিছু আসন-প্রাণায়াম বা শারীরিক ব্যায়ামেই সীমাবদ্ধ৷ এমন কি কেউ কেউ এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে তো কেবল প্রকাম্পিত কপালভাতি ও কুঞ্চিত নাসিকা প্রক্ষালনেই নামিয়ে এনেছেন৷

যোগ একটি সর্বোৎকৃষ্ট জীবন শৈলী৷ অতি উচ্চ কোটির দিনচর্যা৷ এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷ সুস্থ-শরীর ও শুচি-শুদ্ধ মন নিয়ে ভরপুর আত্মিক আনন্দে বেঁচে থাকতে হলে যোগের জুড়ি নেই৷ তবে সেক্ষেত্রে যোগ সম্বন্ধে অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণা থাকা যেমন  জরুরী তেমনি তদনুসারে জীবন-পথটাও বেঁধে ফেলা দরকার বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ে৷

শরীর, মন ও আত্মা এই ত্রিভুবন জুড়ে মানুষের আস্তিত্বিক দ্যোতনা৷ এই ত্রিদিশার ছন্দোবদ্ধ সুষম বিকাশে নিহিত আছে মানব জীবনের সার্থকতা৷ এর মধ্যে কোনটাই উপেক্ষার নয়, অবহেলার নয়৷ অথচ পৃথিবীর সর্বত্র আজ সর্বগ্রাসী ভোগবাদের উদ্যাম আস্ফালন৷ দেহসুখের নগ্ণোল্লাস৷ আত্মসুখতত্ত্বে লিপ্ত মানুষের সূক্ষ্ম মনন বা আত্মার সাধনার অবকাশ কোথায়৷ মূঢ় মানুষ তাই এখন যোগেও ভোগ খোঁজে৷

মানুষকে মননশীল বা মনপ্রধান বলা হলেও নিজের শরীরের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ, মমতাসিক্ত আসক্তি৷ তাই সে আজ যোগকেও শরীর চর্চার এক অব্যর্থ উপাদান হিসেবেই দেখতে চায়৷ যোগের মাধ্যমে ভোগেন্দ্রিয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চায়৷ নীরোগ স্বাস্থ্যলাভ, আকর্ষণীয় অঙ্গসৌষ্ঠব, কমনীয় দেহ-দীপ্তি এসব তো যোগের গোড়ার কথা৷ তবে মনে রাখা দরকার আসন-প্রাণায়াম-কপালভাতি নয়, যম-নিয়মই যোগের প্রথম পাঠ৷ অথচ এই শব্দবন্ধের সঙ্গে আজকালকার  তথাকথিত যোগ শিক্ষক বা শিক্ষার্থী ওয়াকিবহাল আছেন কিনা তা ভাববার বিষয়৷

যম-নিয়ম কী? যম ও নিয়ম হ’ল অষ্টাঙ্গ যোগের প্রারম্ভিক অঙ্গদ্বয়৷ মানবীয় মূল্যবোধের ওপর আধারিত চিরশাশ্বত নীতিনিচয়৷ এই মৌলিক নীতিধর্মের কঠিন শিলার ওপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে যোগসাধনার সুবিশাল সৌধ৷ যম-নিয়ম মানুষের দেহ-মন শুচিশুদ্ধ করে আত্মসাধনার পথ আলোকোজ্জ্বল করে তোলে৷ সমাজে প্রেম-প্রীতি-মৈত্রীর স্নিগ্দ সৌরভ ছড়িয়ে দেয়৷

যোগ মানে তো ভোগপ্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া নয়৷ যোগ মানে ইন্দ্রিয়ের অপমৃত্যু বা অবরোধও নয়৷ ইন্দ্রিয়সমূহকে সুনিয়ন্ত্রিত করে জীবনকে পরমলক্ষ্যের পথে নিয়ে যাওয়ার বৈবহারিক বিজ্ঞান হ’ল যোগ৷ আর ইন্দ্রিয়সমূহকে বশে রাখতে গেলে যম-নিয়ম পালন করতেই হবে৷ অক্ষরে অক্ষরে৷ যম-নিয়ম ব্যতিরেকে যোগানুশীলন অসম্ভব৷ যম-নিয়মই যোগের প্রাথমিক চর্যাচর্য---অবশ্যপালনীয় বিধিনিষেধ৷

একথা কে অস্বীকার করবে যে আজকের সমাজের সর্ববিধ সমস্যার মূল কারণ হ’ল নৈতিক অবক্ষয়৷ ঘর-বাহির, সুকল-কলেজ, দেশ-বিদেশ সর্বত্র চোখে পড়ে নৈতিকতার ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব, মানবতার কঙ্কালসার চেহারা৷ এখন আমাদের অসত্যে বুক কাঁপে না, অন্যায়-অত্যাচার-নিপীড়নে সংশয় জাগে না৷ এখন আমরা চরম অসহিষ্ণু, পুর্ণমাত্রায় অসংযমী৷ হিংস্র৷ কথায় কথায় গালাগালি, মারামারি তো করিই আবার পিটিয়ে পিটিয়ে লাশ ফেলে দিতেও দ্বিধা করি না৷ এ ছাড়া জগৎ জুড়ে অশিক্ষা-কুশিক্ষা, চরম দারিদ্র্য, ধর্মমতের মিথ্যা আস্ফালন, যুদ্ধাতঙ্ক---এসবও রয়েছে৷ ধরণীর এই সমস্যাজর্জর নগ্ণরুপের পেছনে রয়েছে নীতিপাঠের অভাব---যম-নিয়মের অননুশীলন৷ এখন আমরা পদে পদে বাকচাতুর্য দেখাই, মিথ্যার আশ্রয় নিই-ই, ছল-চাতুরী করে বাঁকা পথে চলি৷ অসত্য-অন্যায়-অধর্মই এখন আমাদের স্বভাবধর্ম৷ মনের জগতে আমরা যে আজ চরম দেউলিয়া, মানবতার যে আজ এমন দৈন্যদশা এর কারণ কী? কারণ হ’ল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে আমরা আকাশছোঁয়া উন্নতি প্রযুক্তির জগতে আমরা আকাশছেঁয়া উন্নতি করলেও মনের জগতে এখনও অনেক অনেক পেছিয়ে৷

ভোগবাদের চরম প্রভাবে অর্থই এখন সমাজের নিয়ন্ত্রকবিন্দু৷ অর্থকেই পরমার্থজ্ঞানে পূজা করি আমরা৷ সেইজন্যে ছেলেদের ক্যারিয়র তৈরীতে যতটা নিষ্ঠাসহ সময় ও অর্থ ব্যয় করি তার একাংশও তাকে মানুষ তৈরীর জন্যে খরচ করি না৷ নীতি-শিক্ষা তো এখন উপহাসের বিষয়, তাই সারা জীবনের তপস্যা শেষে শিশুটি এক অর্থোপার্জনকারী যন্ত্রতে পরিণত হলেও আদর্শ মানুষ হতে পারে না৷ সারাজীবন মানসিক ক্লেশ ভোগ করে৷ আর লক্ষ্যে ব্যর্থ হলে তো কথাই নেই, পরিবারের গুরুজনদের গঞ্জনা-জ্বালায় কালাতিপাত করতে করতে একদিন সে আত্মহত্যাকেই আলিঙ্গন করে বসে৷ এক অস্ফুট কুঁড়ি অকালেই ঝরে পড়ে৷

বিজ্ঞানীরা বলছেন, আজ মানুষ ছোট-বড় যত ধরণের রোগে ভোগে তার অধিকাংশই সাইকো-সোমেটিক, অর্থাৎ মানসসঞ্জাত৷ শরীর ভালো না থাকলে যেন মন ভালো থাকে না, তেমনি মন্দ মনও মন্দ স্বাস্থ্যের কারণ৷ হু-র (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) মতে, ‘‘স্বাস্থ্য মানে কেবল রোগ-জরা না থাাই বোঝায় না শাারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সর্ববিধ সুস্থতা বোঝায়৷’’ যোগ মানেও কেবল শারীরিক সুস্থতাবিধান নয়, মানসিক-সামাজিক-সাংসৃকতিক সুস্থতা তো বোঝায়ই তদ্তিরিক্ত যোগ মানে মূলতঃ আত্মিক প্রগতি বোঝায়৷ আর শরীর-মন-আত্মা এই নিজ ত্রিজগতে ভারসাম্য বা সুসন্তুলন বজায় রাখার জন্যে যম-নিয়ম পালন করা যে অবশ্যই দরকার একথা অনস্বীকার্য৷

তাহলে যম-নিয়ম থেকে মানুষ আজ এত দূরে কেন? যমের পাঁচটি উপাঙ্গ---অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ আর নিয়মের পাঁচটি উপাঙ্গ--- শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর প্রণিধান৷ এইসব শ্বাশ্বত নীতিগুলি মেনে চলা তো সহজ কথা নয়---এ এক এক কঠিন তপস্যা৷ আপাতসুখের প্রত্যাশী মানুষ তাই এই সব নৈতিকতার পথে তুলেও পা মাড়তে চান না৷ এছাড়া বিষয়গুলি যথার্থভাবে শিশুমানসে না গণমানসে ছড়িয়ে দেওয়ার কোন সুষ্ঠু উদ্যোগও নেই৷ সমাজের সারা দেহে যখন অনৈতিকতার বিষ ছড়ানো তখন নীতিবাদের শিক্ষা দেবে কে? তাছাড়া আজকাল তথাকথিত যোগশিক্ষা যোগকে তো এক অর্থকরী লাভদায়ক ব্যবসা হিসেবে দেখেন৷  যম-নিয়মের প্রচার করে তাঁরা সেই ব্যবসার মুনাফা কম করতে চান না৷ দু’দশটা আসন শিখলেই কি আর যোগশিক্ষক হওয়া যায়! যোগ একটি বিজ্ঞান, একে বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই শিখতে ও শেখাতে হবে৷ আর এই বিজ্ঞানের প্রথম কথাই হ’ল যম-নিয়ম৷

জগৎপূজ্য যোগীশ্বর শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী অনেক আগেই যোগের এই সার কথাটা উপলব্ধি করেছিলেন৷ তাই আজীবন তিনি যম-নিয়মের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন৷ মিলিত সাধনার শেষে তাঁর শিষ্যরা সমবেত কণ্ঠে যে চরম নির্দেশ পাঠ করেন তাতে স্পষ্ট বলেছেন, যম-নিয়ম ব্যতিরেকে সাধনা হয়না৷ তাই যম-নিয়ম মানাও পরমপুরুষেরই নির্দেশ৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি প্রবর্ত্তিত তথা আবিশ্ব প্রচারিত যোগসাধনার ক্রমধারার যম-নিয়ম প্রথম পাঠ, তারপর বাকী সব৷ এছাড়া আনন্দমার্গ সুকলের পাঠক্রমেও তিনি যম-নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করে গেছেন৷

গণমানস আজ বিধবস্ত, বিপর্যস্ত, মানবতা আজ বিপন্ন, বিশীর্ণ৷ এই ধবংসোন্মুখ মানব সভ্যতাকে বাঁচাতে গেলে দরকার যম-নিয়মের কঠোর অনুশীলন৷ যম-নিযমের তপশ্চর্যার নিবিড় নিষ্ঠাতেই নিহিত আছে ছোট,-বড় সব সমস্যার --- নীতিবাদী নেতৃত্বের অব্যর্থ অভ্যুদয়---এক সমুজ্জ্বল সমাজের স্বর্ণদ্যুতি৷