সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রের কারণে অতীতের সুবিশাল বাঙলা খণ্ড খণ্ড হওয়ার পর বর্তমানে এর যে সামান্য অংশটুকু বুকে ধরে আজকের এই পশ্চিমবঙ্গ পথ চলছে, এই পশ্চিমবঙ্গের বুকেও ছুরিকাঘাত করার অপপ্রচেষ্টা বিভিন্ন সময়ে আমরা প্রত্যক্ষ করছি৷ আজও তা চলছে৷ পশ্চিমবঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ দার্জিলিং৷ বাঙালী তথা নৃতাত্ত্বিক বিচারে বাঙালীদেরই কোচ গোষ্ঠীভুক্ত লেপচা ও ভুটিয়ারা এই দার্জিলিংয়ের আদি বাসিন্দা৷
পরবর্তীকালে নেপাল থেকে আগত নেপালীরা জীবিকার সন্ধানে এই দার্জিলিংয়ে বসবাস শুরু করে৷ ১৮৭২–এর জনগণনার রিপোর্টেও দেখা যায় এদের সংখ্যা নগন্য হওয়ায় এদের নাম রেকর্ডভুক্তই করা হয়নি৷ পরবর্তীকালে দলে দলে নেপালীরা দার্জিলিংয়ে এসে আদি বাসিন্দাদেরই হটিয়ে দিতে থাকে৷ ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে দার্জিলিংয়ে কমিউনিষ্ট নেতা রতনলাল ব্রাহ্মণ নেপালীদের সমর্থন আদায়ের কৌশলে দার্জিলিংয়ে ‘গোর্খাল্যাণ্ডে’র দাবী তোলে৷ পরবর্তীকালে কম্যুনিষ্টরা পার্লামেণ্ঢে এই মর্মে বিল উঠিয়েছিল৷ পরে ধাপে ধাপে কম্যুনিষ্টদের সমর্থন পেয়ে এদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা তীব্র হয়ে ওঠে ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে দার্জিলিংকে পৃথক করার ষড়যন্ত্রে এরা মেতে ওঠে৷ ১৯৭৭ সালে সি.পি.এম পশ্চিমবাঙলায় ক্ষমতায় আসে৷ ১৯৮৮ সালে ২২শে আগষ্ট গোর্খানেতা সুবাস ঘিসিংয়ের সঙ্গে গোর্খা পার্বত্য পরিষদ তৈরীর চুক্তি করে৷ কেন্দ্রকেও এই চুক্তিতে অংশীদার করা হয়৷ এইভাবে দার্জিলিংয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ পরবর্তীকালে সুবাস ঘিসিংকে হটিয়ে তারই শিষ্য বিমল গুরুং, রোশন গিরিরা গোর্খা মুক্তিমোর্চা তৈরী করে খোলাখুলিভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যাণ্ডের দাবী করে৷ কখনও কখনও তারা স্বাধীন গোখাল্যাণ্ড রাষ্ট্রেরও দাবী তুলতে থাকে৷ তাদের দাবীর কাছে মাথা নত করে ২০১০ সালে ১৭ই আগষ্ট এ রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রণ্ঢ সরকার গোর্খামুক্তি মোর্চার সঙ্গে কেন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে ‘গোর্খাল্যাণ্ড রিজিও্যাল অথরিটি’ গড়তে সম্মত হয়৷ অর্থাৎ ‘গোর্খা’র সঙ্গে ‘ল্যাণ্ড’ কথাটিও যুক্ত করে’ পশ্চিমবঙ্গের বুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবীকে আরও বেশী করে মদত দেয়৷
তারপর তো এ রাজ্যের রাজনীতিতে পরিবর্তন দেখা দেয়৷ পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি আন্দোলনে রত ও চরম অশান্তি সৃষ্টিকারী বিমল গুরুংদের গোর্খা মুক্তি মোর্চাকে শান্ত করতে নোতুন মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত গত ১৮ই জুলাই রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থন নিয়ে বিমল গুরুংদের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সই করে ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোর্খাদের ‘গোর্খাল্যাণ্ড টেরিটোরিয়্যাল এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন’ (জিটিএ) উপহার দেয়৷ এইভাবে এদের হাতে ‘সেমি–ষ্টেটে’র মতই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়৷
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, বিমল গুরুংরা এই জিটিএ নিয়ে খুশী থাকবে, আর পৃথক গোর্খাল্যাণ্ডের দাবী ওঠাবে না৷ বিমল গুরুংরা তখন সামনাসামনি কোনও কথা না বললেও পরে বিভিন্ন স্থানে পরিষ্কার বলে বেড়ালেন, এখন কান টেনে নিয়েছি–এবার মাথা টানবো অর্থাৎ ‘গোর্খাল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন’ (জিটিএ) নিয়েছি, এবার পৃথক গোর্খাল্যাণ্ড রাজ্য বানিয়ে ছাড়ব৷ কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আবার বিমল গুরুং–রোশন গিরিরা স্বমূর্ত্তি ধরলেন৷ আবার পৃথক গোর্খাল্যাণ্ড রাজ্যের দাবীতে পাহাড়ে অশান্তির দাবানল জ্বালিয়ে দিল৷ সরকারী অফিস, রেল ষ্টেশন ও থানার ওপরে আক্রমণ চালালো৷ অনির্দিষ্ট কাল ধর্মঘটের ফলে দার্জিলিংয়ের জনজীবন স্তব্ধ করে দিল৷ তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুকৌশলে বিমল গুরুংকে জিটিএ–র প্রধান পদ থেকে সরিয়ে বিনয় তামাংকে বসালেন৷ এইভাবে আপাততঃ দার্জিলিংকে শান্ত করা হলেও ভেতরে ভেতরে আগুন জ্বলছেই৷ ..... পরিস্থিতি এমনই যে, আবার যে কোনও সময়ে পৃথক রাজ্যের দাবীতে দার্জিলিংয়ে আগুন জ্বলবে৷
বিমল গুরুংরা বা জিটিএ–র নতুন নেতৃত্ব বিনয় তামাংরা কেউই বলছেন না যে, বাঙলা তারা ভাগ হতে আর দেবেন না৷ কেবল সুযোগের অপেক্ষায়৷ আসলে অবৈধ ভাবে জি.টি.এ. তৈরী করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে সেমি–ষ্টেটের মতই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে৷
তারা এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে পৃথক রাজ্য তৈরীর দিকে যে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেই তাতে কোনও সন্দেহ নেই৷ আসলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাবীকে মেনে নিয়ে জিটিএ তৈরী করাটাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মস্ত বড় ভুল হয়েছে৷ এই জিটিএ–কে বাতিল করে দিয়ে দার্জিলিংকে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার সমান মর্যাদা দিতে হবে ও কঠোর হস্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে হবে৷
- Log in to post comments