প্রভাতী

দানও নিলেন, দক্ষিণাও নিলেন

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

একটি প্রাচীন ৰাংলা গানে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি কোদাল অর্থে ব্যবহূত হয়েছিল৷ গানটি রচনা করেছিলেন সুবিখ্যাত পাঁচালী গায়ক দাশরথি রায়–সংক্ষেপে দাশু রায়৷ ৰাংলার এই জন্মসিদ্ধ প্রতিভা দাশু রায় কবিতায় কথা বলতে পারতেন......পারতেন গানেও কথা বলতে৷ সংস্কৃত শাস্ত্রেও ছিল তাঁর প্রচণ্ড দখল......আর প্রচণ্ড দখল ছিল যেমন ৰাংলায় তেমনি সংস্কৃতেও৷ তার সঙ্গে তিনি ছিলেন মজলিশী মেজাজের মানুষ৷ লোককে হাসাতে পারতেন দারুণ৷

সেই যে গল্প আছে না দাশু রায় একবার ৰর্দ্ধমান জেলার একটা প্রকাণ্ড মাঠ পার হচ্ছিলেন৷ সেকালে ৰর্দ্ধমান জেলার গ্রামগুলি ছিল খুব ৰড় ৰড় আর দূরে দূরে অবস্থিত৷ এখনও দেখবে, ৰাংলার ৰড় ৰড় গ্রামগুলির বেশীর ভাগই ৰর্দ্ধমান জেলায়৷ সেকালের সেই মাঠে রাত্তিরে তো বটেই, এমনকি দিনে দুপুরেও লেঠেলরা ওৎ পেতে বসে থাকত রাহাজানির উদ্দেশ্যে৷ একবার দাশু রায় ওই ধরনের একটা ৰড় মাঠ পার হচ্ছিলেন৷ সন্ধে তখন হৰ–হৰ৷ দাশু রায় যাচ্ছিলেন একটা ৰড় ৰট গাছের পাশ দিয়ে৷ হঠাৎ গাছের ওপর থেকে লাফিয়ে নেৰে পড়ল কয়েকজন লেঠেল৷ তারা দাশু রায়কে ৰললে–তোমার কাছে যা কিছু আছে সৰ দিয়ে দাও৷

দাশু রায় ৰললেন–আমি গরীব ব্রাহ্মণ......আমি দান–টান ৰুঝি না......আমি পরিগ্রহ ৰুঝি৷ তোমাদের সঙ্গে যা কিছু আছে তোমরাই সে সৰ আমাকে দাও৷

ডাকাতরা পড়ল মহা ফ্যাসাদে৷ ৰামুণ দান চাইছেন৷ না দিয়েই বা থাকে কি করে আবার এদিকে না কাড়লে ডাকাত হিসেবেই বা মান বাঁচে কী করে৷ তারা তখন দাশু রায়কে ৰললে–তোমাকে চিনেছি ঠাকুরমশায়, তুমি তো দাশু রায়৷ তা’ তুমি আমাদের একটা মজার কথা শোনাও৷ আমরা তাতে সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে ছেড়ে দোব৷

দাশু রায় ৰললেন–এ অবস্থায় কার ঠোঁটেই বা মজার কথা আসে ৰল তা গাছের নীচে তো দেখছি তোমরা তিনটি মূর্ত্তিমান দাঁড়িয়ে আছ৷ তোমাদের আত্মীয়–স্বজন জ্ঞাতি–কুটুম্ব আর ক’জন ওই গাছের ওপরে হুপ্ হুপ্ করছে ৰল তো

ডাকাতরা ৰুঝলে, দাশু রায় তাদের ৰাঁদর ৰলে গালি দিলেন৷ কিন্তু ৰলবার কিছুই ছিল না৷

দাশু রায় ৰললেন–কথা বেচে খাওয়াই আমার জীবিকা৷ আমার যে প্রাপ্য পূরণ তা দিয়ে দাও৷ ডাকাতরা তাদের যথাসর্বস্ব দাশু রায়কে পেণ্ণামী হিসেৰে দিয়ে দিলে৷

*      *      *

সেই দাশু রায় একৰার চুঁচড়োয় এসেছেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সভায় পাঁচালী গাইতে৷ চুঁচড়ো তখন সংস্কৃত পণ্ডিতদের কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল (আর যে সকল স্থান সেকালের রাঢ়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল তারা হ’ল ভাণ্ডারহাটি, ত্রিবেণী, দশঘরা, বাঁশৰেড়ে, জনাই, পেঁড়ো–বসন্তপুর, মাকড়দা, বালী, তমলুক, কাঁথি, মেদিনীপুর, সবঙ্গ, চন্দ্রকোণা, বিষ্ণুপুর, ইন্দাশ (বাঁকুড়া), সিমলাপাল, সোণামুখী, ৰর্দ্ধমান, কালনা, পূর্বস্থলী, কাটোয়া, কেতুগ্রাম, ইন্দাশ (বীরভূম), শিউরী, মলুটী, সর্পলেহনা, কঙ্কালীতলা, কুন্তলা, করীধ্যা (বীরভূম) প্রভৃতি স্থান৷ সেখানে রাঢ়ের বিভিন্ন স্থান থেকে ৰড় ৰড় পণ্ডিতরা এসেছেন....হচ্ছে দাশু রায়ের পাঁচালী গান৷ তিনি তাঁর গানের এক জায়গায় কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ব্যবহার করলেন (গানের প্রথম লাইনটি ছিল ‘দোষ কারোর নয় গো মা’)৷ পণ্ডিতেরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন৷

তাঁরা ৰললেন–এ কী কথা দাশু রায়ের মত পণ্ডিত মানুষ ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ভুল অর্থে ব্যবহার করলেন পাঁচালী গান হওয়ার পরে পণ্ডিতদের সভা বসল৷

তাঁরা বললেন–যদিও ‘কোদণ্ড’ শব্দটি কোদাল অর্থে চলে না কিন্তু দাশু রায়ের মত প্রখ্যাত পণ্ডিত ও প্রতিভাধর মানুষের সম্মান রক্ষার জন্যে আমাদের উচিত কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটিকে মেনে নেওয়া৷ সংস্কৃতে এমন আর্ষ প্রয়োগের ঘটনা অজস্র রয়েছে৷ সুতরাং আরেকটি আর্ষ প্রয়োগ ৰাড়লই বা তাই তখন থেকে ‘কোদাল’ অর্থেও ‘কোদণ্ড’ শব্দটি চলে আসছে৷

এই লব্ধপ্রতিষ্ঠ দাশু রায় ছিলেন বর্ধমান জেলার পূর্বস্থলীর নিকটবর্ত্তী চুপী গ্রামের সন্তান৷ কবি সত্যেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরাও এই চুপী গ্রামের অধিবাসী ছিলেন৷ এখন তোমরাই বিচার বিবেচনা করে আমাকে জানাও তোমরা চুঁচড়োর পণ্ডিত সমাজের এই বার্ত্তিক মানতে রাজী আছো কি না অর্থাৎ কোদাল অর্থে ‘কোদণ্ড’ শব্দটি ব্যবহার করবে কি না৷ কোদালের নিজস্ব সংস্কৃত হচ্ছে ‘কুদ্দালিক’৷

 

পরমাশ্রয়

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

তোমায় স্মরেছি  গহন গভীরে

নিস্তব্ধ রজনীতে,

পেয়েছি তোমায় নির্জন কাননে

এই না ধরণীতে৷

শৈত্যপ্রবাহে মাধুরী ছড়ায়ে

চলেছিলে তুমি পথ

রাঙিয়ে জীবন তুলিয়া রণন...

করেছিলে একমত৷

নিত্যদিনের কাজের মাঝেই

ডেকে যাই তোমারে

তুমিও সদাই ঘিরিয়া রয়েছো

বাজিয়ে বীণা তারে৷

তোমার পরশে হরষিত চিত

তোমারই কথা বলে,

নয়ন মুদিয়া ধরিতে গেলেই

যাও কোথা তুমি  চলে?

না চাহিতে তুমি আসিয়া দাঁড়াও

মুচ্‌কি হাসি হেসে,

অপার তোমার লীলা মাধুরী

যাও সবে ভালবেসে৷

হাসিতে তোমার মোহন বাঁশী

নাচায় জীবন মন,

জানিগো জানি বিশ্বজগতে

তুমিই পরমধন৷

অতৃপ্ত বাসনা মানেনা বাঁধন

তোমাতেই পাবে লয়

রয়েছো ঘেরিয়া সদাই আমায়

তুমিই পরমাশ্রয়!

 

আমার মণিমাণিক্য

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

একসঙ্গে লেখাপড়া

একসঙ্গে খেলা,

একসঙ্গে সুকলে যাওয়া

যেন মিলন মেলা৷

একসঙ্গে ফুল কুড়ানো

নীল আকাশে চাওয়া,

একসঙ্গে পরাণ ভরে

আনন্দে গান গাওয়া৷

একসঙ্গে নৃত্য করি

একসঙ্গে হাসি,

সুখ-দুঃখে সবাই মোরা

থাকি পাশাপাশি

একসঙ্গে ভাগ করে নিই

সুখ-দুঃখের কথা,

পৃথক হয়ে সুখের খোঁজ

সময় নষ্ট বৃথা৷

ভরে আছে হৃদয় জুড়ে

হর্ষ সারা বর্ষ৷

বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে

আমরা হলাম আদর্শ৷

 

বিসুকটের টিনে কী ছিল

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কুলাল+ ঠক্‌ করে ‘কৌলালক’ শব্দটি পাচ্ছি৷ শব্দটির  অর্থ হল চীনে মাটির  বাসনপত্র ও চীনে মাটির অন্যান্য পণ্য যেমন ফুলদানি, পিকদানি, সুর্র্মদানি প্রভৃতি৷

সে আজ অনেকদিন হয়ে গেল৷ বাংলা সাহিত্যে কেদার বাঁড়ুজ্যে মশায় তখন সুপ্রতিষ্ঠিত৷  শুধু উঠতি সাহিত্যিকেরাই নয়, প্রতিষ্ঠিত  সাহিত্যিকেরাও  কেউ কেউ তাকে ‘দাদামশায়’ কেউবা ‘দাদু’ বলে ডাকতেন৷ তাঁর প্রতিভা বেশী ফুটে উঠেছিল হাস্যরসের গল্পে৷  তবে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাকেও  তিনি  ছোননি  এমন কথা বলা চলে না ৷  এহেন কেদার বাঁড়ুজ্যে  মশায় একবার নাকি  চীনে গেছলেন৷ তিনি যখন চীনে যান তখন তার মুড়িভাজার খোলা কোচি, পিটুলি গোলা, হলুদবাটা,  শিল-নোড়া, ডেঁয়ো ঢাকনা, নারকোল  মালা, রঙীন  ক্ষুরি রঙবেরঙের চ্যাঁচারিতে তৈরী বাঁশের কুলো তো ছিলই,  আর ছিল একটি সুদৃশ্য বিসুকটের টিন-ভর্ত্তি কি যেন একটা জিনিস৷ বাংলার নামীনামী-উঠতি বাড়তি-পড়তি সাহিত্যিকেরা দলে দলে জাহাজ ঘাটায়  এসেছিলেন তাঁকে  দিায়- অভিনন্দন  জানাতে৷ বাঁড়ুজ্যে মশায় সবাইকার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বললেন, শ্রিম্ভালাপ করলেন৷ হঠাৎ একটি উঠতি বয়সের ছোকরা সাহিত্যিক বিসুকটের টিনটা দেখিয়ে বললেন---দাদু বিসুকটতো চীনে অনেক পাওয়া যায়...সস্তা মচমচে ও মুখরোচকও৷ অমন মুখরোচক বিষুকট এদেশে পাওয়াই যায় না৷ আমি তো  নিশ্চয় বলব চীনের বিসুকটের মতো মুখরোচক  জিনিস পৃথিবীতে নেই৷

বাঁড়ুজ্যে মশায় বললেন--- চীনের  বিষুকটের  চেয়েও  মুখরোচক জিনিস আছে আর তাতে তোমাদের ঠোঁট-জিব বেশ তড়বড় করে নড়র্ে৷

কোন একজন সাহিত্যিক ললেন--- হ্যাঁ, বিষুকটের  চেয়েও  মুখরোচক হচ্ছে এদেশের ডালমুট৷

বাঁড়ুজ্যে মশায় বললেন--- হল না, হল না, একটু ত্রুটি রয় গেল৷

সাহিত্যিকেরা ললেন--- ডালমুটের চেয়েও  মুখরোচক হল নুনে-ঝালে  আঃ-উঃ করানো চানাচুর৷

বাঁড়ুজ্যে মশায় ললেন  হল না, হল না৷

সাহিতিকেরা বাঁড়ুজ্যে মশাইকে ললেন তবে আপনিই বলুন  সবচেয়ে মুখরোচক  জিনিস কী৷

বাঁড়ুজ্যে মশাই ললেন---সবচেয়ে মুখরোচক হচ্ছে পরনিন্দা, পরচর্র্চ আর প্রকাশ্যে যার খাই-পরি আড়ালে  তার শ্রাদ্ধ করি...‘‘যার শিল যার নোড়া / তারই ভাঙ্গি দাঁতের গোড়া... যার খাই যার পরি  তারই নিন্দাবাদ’’ ---হেমচন্দ্র৷  এই পরনিন্দা , পরচর্চা অথবা প্রকাশ্যে যার খাই -পরি আড়ালে তার নিন্দা করি--- এই তিনটি জিনিস মিশিয়ে যে ভোজ্যটি তৈরী হয় সেটিই সবচেয়ে বেশী মুখরোচক৷

তখন উঠতি বয়সের তরুণ সাহিত্যিক বললেন--- তবে ওই বিস্কুটের টিনে কী নিয়ে যাচ্ছেন?

কেদার বাঁড়ুজ্যে ললেন---টিনটা খুলেই দেখো না!

তরুণ সাহিত্যিক টিনটি  খুললেন৷ দেখলেন-নির্ভেজাল  বাংলার মাটি--- যে মাটি আমরা আশে পাশে পথে ঘাটে আকছার  হামেশাই দেখে থাকি৷ সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস  করলেন--- এ ষে মাটি! মাটি নিয়ে  কি কেউ যাত্রা করে! মাটি নিয়ে কি কেউ ভিন্‌ দেশে যায়!

বাঁড়ুজ্যে মশায় ললেন---চীনে গিয়ে তো আমাকে শৌচালয়ে যেতে হবে৷ আমাকে তো হাতে মাটি করতে হবে৷

সাহিত্যিকরা বললেন---হাতে মাটি করবার জন্যে মাটি তো  সে দেশেই রয়েছে৷

বাঁড়ুজ্যে মশায়  ললেন--- ওখানেই  তো ভুল করলে৷ এটা যে তোমাদের  ঠিকেয় ভুল৷ তোমরা দেশটার নামই ভুলে গেলে৷ ওদেশে হাতে-মাটি করবার মাটি কী করে পাব! দেশটা যে চীন দেশ৷ ওখানকার সই যে চীনে মাটি৷

সাহিত্যিকেরা তাঁদের ঠিকেয় ভুল মেনে নিলেন৷

 

সততার সাধক

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নাম তোমরা সকলেই শুনেছো--- তাইনা? তিনি একটি পত্রিকা পরিচালনা করতেন৷ পত্রিকাটির নাম ‘নারায়ণ’৷ তাতে লিখতেন তৎকালীন বড় বড় নামজাদা লেখকরা৷ একবার এক খ্যাতনাম উপন্যাসিকও সেই পত্রিকায় কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ লিখলেন৷ প্রবন্ধগুলোর বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক৷ যেমন ‘শিক্ষার বিরোধ’, ‘মহাত্মাজী’ ইত্যাদি৷

‘নারায়ণ’-পত্রিকায় যারা লিখতেন দেশবন্ধু তাদের প্রত্যেককেই টাকা দিতেন৷ কিন্তু উপন্যাসিককে টাকা দিতে গিয়ে তিনি মহামুশকিলে পড়লেন৷ অতো উঁচুদরের একজন উপন্যাসিককে অতোগুলো শক্তিশালী লেখার জন্য ঠিক কত টাকা দেওয়া উচিত তা তিনি স্থির করতে পারলেন না৷ কিছুদিন ভেবেচিন্তে অবশেষে তিনি এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন৷ টাকার ঘরটা শূন্য রেখে গোটা চেকটাই পাঠিয়ে দিলেন উপন্যাসিকের কাছে৷ উপন্যাসিক এবার ইচ্ছেমতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে নিতে পারেন৷

চেকখানি হাতে পেয়ে যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হলেন উপন্যাসিক৷ কত সরল মনে, মানুষের প্রতি কতখানি বিশ্বাস নিয়ে দেশবন্ধু এ কাজ করেছেন তা ভেবে তিনি সত্যিই মুগ্দ হলেন৷ পরমুহূর্তে আবার ভাবলেন, এটাই তো স্বাভাবিক, মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করবে না তো কি  পশুকে  করবে?

যাই হোক, নির্দিষ্ট দিনে চেকে টাকার ঘরে ন্যায্য সংখ্যা বসিয়ে ব্যাঙ্কে গেলেন৷ চেক ভাঙাবার সময় দেখা হলো এক বন্ধুর সাথে৷ বন্ধু সব শুনে জিজ্ঞেস করলেন, তা চেকে তুমি কত লিখেছো?

উপন্যাসিক বললেন, একশ টাকা৷

‘মাত্র! ঠোঁট বেঁকিয়ে বন্ধুটি বললেন, তুমি দেখছি নিতান্তই বেকুব৷ আরে দেশবন্ধুর কি টাকার অভাব? কম করে পাঁচশ’ লেখা উচিত ছিল৷’

উপন্যাসিক এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন৷ বললেন, ‘দেখো, পাঁচশ’ লিখলে চিত্তবাবুর থলির ওয়েট বিশেষ কিছুই কমতোনা জানি এবং তার চিত্তেও এতটুকু আঁচড় পড়তোনা, কিন্তু তাতে করে আমার চিত্তে যে কালি পড়তো তা মুছবার উপায় তুমি আমায় বাৎলে দিতে পারো?

বন্ধুটি নীরব৷ লজ্জায় মাথা হেঁট৷ কিছুক্ষণ পরে আমতা আমতা করে অন্য প্রসঙ্গ তুলে পালিয়ে গেলেন৷

বলতো কে এই উপন্যাসিকটি? উপন্যাসিকই হলেন আমাদের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁর জীবনী পড়ে তাঁর যে জিনিসটি দেখে আমি মুগ্দ হয়েছি তা হলো তাঁর সততার সাধনা৷ তোমরা কি পারবেনা এইরকম সততার পরিচয় দিতে?

 

১৪ই সেপ্ঢেম্বর প্রভাত সঙ্গীত দিবস উপলক্ষ্যে এবারের প্রভাতীর কবিতার কলমে প্রভাত সঙ্গীত

লেখক
প্রভাত রঞ্জন সরকার

বন্ধু হে, নিয়ে চলো

আলোর ওই ঝর্ণাধারার পানে৷৷

আঁধারের ব্যথা আর সয় না প্রাণে৷৷

ঘুমের ঘোর ভাঙানোর গানে গানে৷৷

২.

এ গান আমার আলোর ঝর্ণাধারা৷

উপল-পথে দিনে রাতে বয়ে যাই---

বয়ে যাই বাঁধনহারা৷৷

এ পথ আমার বন্ধুর কন্টকভরা৷

উৎস হতে প্রাণের স্রোতে ভেঙ্গে যাই-

ভেঙ্গে যাই পাষাণকারা৷৷

৭.

নীরবতা মাঝে কে গো তুমি এলে

ঘন ঘোর ঘুম ভাঙ্গাতে, ঘুম ভাঙ্গালে৷৷

ঝটিকার ঘাতে নেবানো দীপেতে

জ্ঞানশলাকাটি জ্বালালে৷৷

সাজানো বাগানে ছোট খেলাঘরে৷

যারা আসে তারা চলে যায় দূরে৷

তাদের পথের নিশানা আজিকে

দীপ জ্বেলে দিয়ে জানালে৷৷

আমি যেতে চাই, তুমি নিয়ে যাও,

বাধার বাঁধা সব ছিঁড়ে দাও৷৷

মোর চিত্তের চঞ্চলতা,

মোর হৃদয়ের উদ্বেলতা,

মোর মনে উচ্ছ্বলতা---

সব কিছু মোর তুমি নিয়ে নাও৷৷

১৯

নবীন প্রাতে এই অরুণ আলোতে

রূপের ছন্দে এলে মোর মনেতে৷৷

তুমি হাসাতে জানো,তুমি কাঁদাতে জানো,

লুকোচুরি খেলা খেলিতে জানো৷

আজ আলোর ছটায় এলে প্রাণ ভরিতে৷৷

বীণা বাজাতে জানো, রাগ রচিতে জানো,

সুরে তালে জগৎকে নাচাতে জানো৷

জানো সুখেদুঃখে সবাইকে ভালবাসতে৷৷

 

 

আমি কেমন সেয়ানা মেয়ে

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

প্রাচীনকাল থেকেই ভাশুর শ্বশুরের তুল্য পূজ্য রূপেই গণ্য হয়ে এসেছে৷ তাই ভাশুরের সম্বোধনসূচক সাম্মানিক শব্দ হচ্ছে ৰড় ঠাকুর/বট্ঠাকুর৷ কিন্তু প্রাচীনকালে সামাজিক বিধি ছিল এই যে ভাশুরকে ছোঁয়া চলে না৷ এ সম্পর্কে একটা গল্প আছে৷  ঘটনাটি  ঘটেছিল মানাদে  (মহানাদ)*৷ তাড়াতাড়ি বলছি শোনো৷

বউ–(স্বগত) চোর এসেছে...........বাড়ির চারপাশে সিঁদকাঠি নিয়ে ঘোরাফেরা করছে.......সব ৰুঝছি, মুখটি খুলছি না............আমি কেমন সেয়ানা মেয়ে.........দেখি কী হয়

..........চোর সিঁধ কাটছে.......... শব্দ শুনছি, চোখটি বুজে  পড়ে আছি, মুখটি খুলছি না.......আমি কেমন সেয়ানা মেয়ে.........দেখি কী হয়

..........সিঁধ কেটে চোর ঘরে ঢুকল........পাশ ফিরে শুলুম......... চোখ খুললুম না........... আমি কেমন সেয়ানা মেয়ে.......দেখি কী হয়

...........চোর জিনিসপত্র সব জড়ো করলে............পুঁটলিতে ৰাঁধল.......পুঁটলিটা প্রকাণ্ড হল............সিঁধের গর্ত্ত দিয়ে তা গলানো যাবে না............আমি কেমন সেয়ানা মেয়ে...........সব দেখে চলেছি, ‘রা’–টি কাড়ছি না

.........কিন্তু এইবার পুঁটলিটা নিয়ে চোর যাবে কোথায় ........ডানে আস্তাকুড়, বাঁয়ে বট্ঠাকুর, দু’য়ের কাউকেই ছুঁতে নেই, ছুঁলেই চান করতে হয়......  .....চোর, যাবি কোথায়....... ডানে আস্তাকুড়, বাঁয়ে বট্ঠাকুর..........এই বার.......৷

*হুগলী জেলার অন্তর্ভুক্ত মহানাদ স্থানটি ৰৌদ্ধ যুগে বাঙলার অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল৷ স্থানটি অল্প দিনের জন্যে রাঢ়ের রাজধানীও ছিল৷ পরে বন্যার বালিচাপা পড়ে যাওয়ায় রাজধানী পাণ্ডুয়ায় (হুগলী জেলা) স্থানান্তরিত হয়৷ পাঠান যুগের মাঝামাঝি সময়ে পাণ্ডুয়া বিধ্বস্ত হয়৷ পাণ্ডুয়ার মিনারটি (পেঁড়োর পীর) কমৰেশী সেই সময়কারই৷

 

ইতিহাসে    ঢাকাই মসলিন

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বাঙলার অতীত গৌরবের অন্যতম সাক্ষী ঢাকাই মসলিন৷ সূক্ষ্ম সূত্রশিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন এই মসলিন৷ মোগল বাদশাহদের পাটরানী বেগম থেকে শুরু করে ইয়ূরোপের সম্রাজ্ঞীরা পর্য্যন্ত এই মসলিন শাড়ী পরবার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকতেন৷

কৃষি প্রধান দেশ হলেও বাঙলার প্রাচীনকাল থেকেই বস্ত্রশিল্পের জন্য ছিল বিখ্যাত৷ বাঙলার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি খ্রীষ্টের জন্মের বহু আগে থেকেই দেশ-বিদেশে  ছড়িয়ে পড়েছিল৷ প্রাচীন বাঙলায় চার রকম বস্ত্রের খুব কদর ছিল৷ ক্ষৌম, দুকূল পত্রোর্ণ আর কার্পাসিক৷ ক্ষৌম হচ্ছে শণের সুতোয় তৈরি মোটা কাপড়৷ কাশী আর উত্তরবঙ্গে এই কাপড় প্রস্তুত হতো৷ এক ধরণের সূক্ষ্ম কাপড়কে বলা হতো দুকূল৷ এই দুকূল কাপড় হতো সাদা, নরম ও অত্যন্ত স্নিগ্দ৷ পত্রোর্ণ কাপড় তৈরি হতো রেশমের মতো এক জাতীয় লালা থেকে৷ উত্তরবঙ্গে এই কাপড় প্রস্তুত হতো৷ কার্পাসিক কাপড় তৈরি হতো কার্পাসের তূলো থেকে৷ খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকেই বাঙলায়  সূক্ষ্ম বস্ত্র বিদেশে রপ্তানি হতে শুরু করেছিল৷ অর্থাৎ বাঙলার সূক্ষ্ম বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য বহু প্রাচীন৷ বাঙলার যে মসলিন ঊনবিংশ শতাব্দী পর্য্যন্ত সমগ্র বিশ্বে বিখ্যাত ছিল, অতি প্রাচীন যুগেই তার উদ্ভব হয়েছিল৷ সমুদ্রপথে ব্রহ্মদেশ, মালয় উপদ্বীপ, যবদ্বীপ, সুমাত্রা  প্রভৃতি দেশে মুক্তা আর নানারকম গাছ-গাছড়ার সাথে মসলিনও পাড়ি দিত৷

এই মসলিন তৈরি হতো ঢাকায়৷ ঢাকার প্রায় পঁচিশ মাইল উত্তর-পূর্বে ডুমরাতে মসলিনের দক্ষ শিল্পীরা বাস করতেন৷ কথিত আছে এখানকার কর্তনীরা একরতি তুলো থেকে একশ পঁচাত্তর হাত সুতো কাটতে পারতো৷

আরব দেশীয় সওদাগর সুলেমান বলে গেছেন, বাঙলায় এমন একরকম কার্পাসের  সূক্ষ্ম  ও নরম বস্ত্র তৈরি হতো যা একটা  আংটির ভেতর দিয়ে গলিয়ে দেওয়া যেত৷ ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে, ১২৯০ সালে পরিব্রাজক মার্র্কেপোলো বলেছেন, বাংলাদেশের লোকেরা প্রচুর কার্পাস উৎপন্ন করে ও  কার্পাসের ব্যবসা ছিল খুব রমরমা৷ পঞ্চাশ শতকের আরেক চীনা পরিব্রাজক মা-হুয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী বাঙলায় ছয় রকমের  সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র প্রস্তুত হতো৷ এগুলি প্রস্থে দুই আর দৈর্ঘ্যে ঊনিশ হাত৷

সূক্ষ্ম বস্ত্র হিসাবে ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি ছিল সব  চেয়ে বেশি৷ মসলিন কাপড়ের দাম ছিল এত বেশি যে অনেক সময়  ইংরেজরা ও দিনেমার সওদাগররা আধা আধি করে এই কাপড় কিনতেন৷ কাপড়গুলো লম্বায় ২৮ হাত হতো৷ মহম্মদ আলিবেগ ভারত থেকে পারস্যে ফিরে যাওয়ার সময় ডিম্বাকার একক্ষুদ্র রত্নখচিত নারকেল খোলের মধ্যে একখণ্ড মসলিন নিয়ে গেছলেন৷ সেটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন পারস্য সম্রাট দ্বিতীয়শাহ সুফীকে৷ রত্নখচিত ক্ষুদ্র নারকেল খোলের মুখটি খুলতেই সম্রাটের তো চক্ষুস্থির৷ খোল থেকে বেরিয়ে এলো ৬০ হাত লম্বা একটি মসলিনের পাগড়ী৷

পাগড়ীটি এতো সূক্ষ্ম সুতোয় তৈরি হয়েছিল যে তার অস্তিত্বই বোঝা যাচ্ছিল না৷ সূক্ষ্মতার জন্য মসলিনের কাপড় এতো হাল্কা হতো যে তার পরিমাপ হতো ভরি বা রতিতে৷ কথিত আছে, এক খণ্ড ঢাকাই মসলিন যদি সবুজ ঘাসের ওপর  রেখে সারারাত শিশিরে ভেজানো যায় তবে পরদিন সকালে সূর্য উঠলেও তার অস্তিত্ব বোঝা যেত না৷ মনে হতো যেন ঘাসের ওপর একখানা লম্বা  মাকড়সার জাল পাতা আছে৷

 

আজব কারখানা

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

জগত জুড়ে চলছে সবাই

শিখছে কত কিছু,

চলছে সবে সুমুখ পানে

তাকাও কেন পিছে?

খাটছে মানুষ দিবা রাতি

গড়ছে বাড়ি ঘর,

দুদিন পর  সব ছাড়িয়া

হচ্ছে দেশান্তর৷

গ্রহান্তরের মানুষ বুঝি

বিশাল অন্তর,

হচ্ছে সবার মেলা মেশা

জেনো নিরন্তর৷

আত্মীয়তা বাড়ছে

কাটছে ঘনঘোর,

নেট দুনিয়ার সবাই কাছের

এলো নোতুন ভোর৷

মনের মতন খুঁজি কাজে

খাটছে সারাক্ষণ,

কাজের মাঝে  গড়ছে  নিজে

করি জীবন পণ৷

সবার হৃদের একই ভাষা

সবে আপন জন,

হৃদিধারায় বহিয়া চিতে

করো বিশালমন!

 

স্বাধীনতার কালে বাঙালী আগুন জ্বালে

লেখক
শিবরাম চক্রবর্তী

বীর বাঙালী বাঘাযতীন,

প্রফুল্ল, বাদল, দীনেশ, বিনয়

মাতঙ্গিনীর মতো বহু

বীরঙ্গনা নারী বাঙলায় জন্মায়৷

এরা সবাই বাঙালীয়ানায়

বড়ো হয়ে শেষ কালে

ভারতস্বাধীন করার লাগি

লড়াই করেন সমানতালে৷

মারের মুখে কেউ বা পড়েন

কেউ বা নারীর সতীত্ব খুইয়ে,

বন্দেমাতরম্‌ ধবনি তুলে

ভারতমাতায় যায় জয় গেয়ে৷

এরা বাঙালীর ঘরে ঘরে

পেয়ে নারীর খুব মর্যাদা

চিরদিনের জপমালায়

বাঙালীর ভাবে থাকবে বাধা৷