বীরত্ব
১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের কথা৷ তখন কোলকাতায় প্রতি বৎসর বিখ্যাত সরকারী প্রদর্শনীCalcutta In- ternational Exhibition বসতো গড়ের মাঠে৷ ঠিক গড়ের মাঠে বললে ভুল হবে৷ গড়ের মাঠের কিছুটা অংশ, মিউজিয়াম তার পশ্চিম দিকের পুকুর আর জমি নিয়ে বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন হতো৷ চৌরঙ্গী রাস্তার ওপর বাঁধা হতো বিশাল সেতু৷
সেদিন ছিল শনিবার
প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছেলে এলো প্রদর্শনী দে
খতে৷ এম.এ. ক্লাসের ছাত্র তারা৷ প্রদর্শনীর গেটের কাছে এসেই তারা দেখলো, ভদ্রঘরের কিছু বয়স্ক মেয়েছেলে বাড়ীর দাসীদের নিয়ে প্রদর্শনী দেখতে ঢুকছেন৷ আর তাদের পিছু পিছু কয়েকটি অসভ্য ফিরিঙ্গী যুবক ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে করতে চলেছে৷ মেয়েদের সাথে কোন পুরুষ ছিল না৷ তাই তারা ফিরিঙ্গীদের উৎপাতে ভয় পেয়ে গেলো৷ তাদের অশ্লীল ইঙ্গিতে লজ্জাও পেলো খুব৷
তাই দেখে কলেজের ছেলেরা গেলো ভীষণ ক্ষেপে৷ কিন্তু ফিরিঙ্গীদের মুখের ওপর প্রতিবাদ করবার মতো সৎসাহস সবার ছিল না৷ ছিল মাত্র এক জনের৷ তার নাম দ্বিজু৷ জামার হাতা গুটিয়ে সে এগিয়ে গেলো ফিরিঙ্গীদের দিকে৷
কিন্তু তার সহপাঠীরা তাকে টেনে ধরলো৷ তাকে হুঁশিয়ার করে দিল ‘‘ভুলে যাসনি---এটা সরকারী প্রদর্শনী৷ দাঙ্গাহাঙ্গামা হলে বিপদে পড়বি৷’’
ওদিকে ফিরিঙ্গী যুবকরাও ছাড়তে রাজী নয়৷ তাদের দলের সর্দার বললো, ‘‘বেশতো, প্রদর্শনীর বাইরে চলো দেখা যাবে কার বাহুতে কত শক্তি৷’’
ভয়-ডরের বালাই ছিল না দ্বিজুর৷ সেও গলা চড়িয়ে বললো, ‘‘হ্যাঁ-হ্যাঁ চলনা! মায়ের দুধ কি শুধু তোরাই খেয়েছিস-আমরা খাইনি?’’
বাস্তব বুদ্ধির অভাব ছিলনা দ্বিজুর৷ তাই সে আগে মেয়েদের গাড়ীতে তুলে দিল৷ বললো,‘‘বাড়ী চলে যান৷ সংগে পুরুষ মানুষ না নিয়ে বেরোন কেন?’’
তারপর ফিরে দেখলো সহপাঠীরা সবাই একে একে কেটে পড়েছে৷ ফিরিঙ্গীরা ছিল দলে অনেক ভারী৷ কিন্তু কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাবার ছেলে নয় দ্বিজু৷ যাক জান, থাকুক মান এই সংকল্প নিয়ে সে লাফিয়ে পড়লো ফিরিঙ্গী সর্দারের ওপর৷ এক বক্সিং-এ তার নাকটা দিল থেঁতো করে৷
স্বয়ং সর্দারের রক্তপাত৷ তাই দেখে অন্যান্য ফিরিঙ্গীদের মাথা গেলো গরম হয়ে৷ নেকড়ের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো দ্বিজুর ওপর৷ জামা- কাপড় তার ছিঁড়ে দিল৷ নখ দিয়ে সারা শরীর আঁচড়ে দিল৷ তবুও দ্বিজু দমলো না৷ লাথি মেরে চড় মেরে ঘুষি মেরে সে ও কাবু করতে লাগলো ফিরিঙ্গীদের৷
দেখতে দেখতে সেখানে ভীড় জমে গেলো৷ অতোগুলো ফিরিঙ্গীর সাথে একা দ্বিজুকে লড়াই করতে দেখে উপস্থিত অন্যান্য বাঙালীরও সাহস হলো৷ তারাও যোগ দিল দ্বিজুর সাথে৷ অবশেষে বাঙালীদের কাছে হার মানতে হলো ফিরিঙ্গীদের৷
সেদিন বীরের মর্যাদা পেয়েছিল দ্বিজু ৷ বাঙালীরা তাকে বাহবা দিয়েছিল৷ এমন কি ফিরিঙ্গী দলের পরাজিত সর্দারও দ্বিজুর সাহসিকতায় মুগ্দ হয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল৷ বলেছিল,বাঙালীর গায়ে এতো শক্তি তা এই প্রথম জানলাম৷
কে জানো এই দ্বিজু ? এই দ্বিজুই হচ্ছেন আমাদের চারণ কবি এবং স্বদেশ-হিতৈষী নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়!
- Log in to post comments