প্রভাতী

বীরত্ব

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের কথা৷ তখন কোলকাতায় প্রতি বৎসর বিখ্যাত সরকারী প্রদর্শনীCalcutta In- ternational Exhibition বসতো গড়ের মাঠে৷ ঠিক গড়ের মাঠে বললে ভুল হবে৷ গড়ের মাঠের কিছুটা অংশ, মিউজিয়াম তার পশ্চিম দিকের পুকুর আর জমি নিয়ে বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন হতো৷ চৌরঙ্গী রাস্তার ওপর বাঁধা হতো বিশাল সেতু৷

সেদিন ছিল শনিবার

প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছেলে এলো প্রদর্শনী দে

খতে৷ এম.এ. ক্লাসের ছাত্র তারা৷ প্রদর্শনীর গেটের কাছে এসেই তারা দেখলো, ভদ্রঘরের কিছু বয়স্ক মেয়েছেলে বাড়ীর দাসীদের নিয়ে প্রদর্শনী দেখতে ঢুকছেন৷ আর তাদের পিছু পিছু কয়েকটি অসভ্য ফিরিঙ্গী যুবক ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে করতে চলেছে৷ মেয়েদের সাথে কোন পুরুষ ছিল না৷ তাই তারা ফিরিঙ্গীদের উৎপাতে ভয় পেয়ে গেলো৷ তাদের অশ্লীল ইঙ্গিতে লজ্জাও পেলো খুব৷

তাই দেখে কলেজের ছেলেরা গেলো ভীষণ ক্ষেপে৷ কিন্তু ফিরিঙ্গীদের মুখের ওপর প্রতিবাদ করবার মতো সৎসাহস সবার ছিল না৷ ছিল মাত্র এক জনের৷ তার নাম দ্বিজু৷ জামার হাতা গুটিয়ে সে এগিয়ে গেলো ফিরিঙ্গীদের দিকে৷

কিন্তু তার সহপাঠীরা তাকে টেনে ধরলো৷ তাকে হুঁশিয়ার করে দিল ‘‘ভুলে যাসনি---এটা সরকারী প্রদর্শনী৷ দাঙ্গাহাঙ্গামা হলে বিপদে পড়বি৷’’

ওদিকে ফিরিঙ্গী যুবকরাও ছাড়তে রাজী নয়৷ তাদের দলের সর্দার বললো, ‘‘বেশতো, প্রদর্শনীর বাইরে চলো দেখা যাবে কার বাহুতে কত শক্তি৷’’

ভয়-ডরের বালাই ছিল না দ্বিজুর৷ সেও গলা চড়িয়ে বললো, ‘‘হ্যাঁ-হ্যাঁ চলনা! মায়ের দুধ কি শুধু তোরাই খেয়েছিস-আমরা খাইনি?’’

বাস্তব বুদ্ধির অভাব ছিলনা দ্বিজুর৷ তাই সে আগে মেয়েদের গাড়ীতে তুলে দিল৷ বললো,‘‘বাড়ী চলে যান৷ সংগে পুরুষ মানুষ না নিয়ে বেরোন কেন?’’

তারপর ফিরে দেখলো সহপাঠীরা সবাই একে একে কেটে পড়েছে৷ ফিরিঙ্গীরা ছিল দলে অনেক ভারী৷ কিন্তু কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাবার ছেলে নয় দ্বিজু৷ যাক জান, থাকুক মান এই সংকল্প নিয়ে সে লাফিয়ে পড়লো ফিরিঙ্গী সর্দারের ওপর৷ এক বক্সিং-এ তার নাকটা দিল থেঁতো করে৷

স্বয়ং সর্দারের রক্তপাত৷ তাই দেখে অন্যান্য ফিরিঙ্গীদের মাথা গেলো গরম হয়ে৷ নেকড়ের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো দ্বিজুর ওপর৷ জামা- কাপড় তার ছিঁড়ে দিল৷ নখ দিয়ে সারা শরীর আঁচড়ে দিল৷ তবুও দ্বিজু দমলো না৷ লাথি মেরে চড় মেরে ঘুষি মেরে সে ও কাবু করতে লাগলো ফিরিঙ্গীদের৷

দেখতে দেখতে সেখানে ভীড় জমে গেলো৷ অতোগুলো ফিরিঙ্গীর সাথে একা দ্বিজুকে লড়াই করতে দেখে উপস্থিত অন্যান্য বাঙালীরও সাহস হলো৷ তারাও যোগ দিল দ্বিজুর সাথে৷ অবশেষে বাঙালীদের কাছে হার মানতে হলো ফিরিঙ্গীদের৷

সেদিন বীরের মর্যাদা পেয়েছিল দ্বিজু ৷ বাঙালীরা তাকে বাহবা দিয়েছিল৷ এমন কি ফিরিঙ্গী দলের পরাজিত সর্দারও দ্বিজুর সাহসিকতায় মুগ্দ হয়ে তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল৷ বলেছিল,বাঙালীর গায়ে এতো শক্তি তা এই প্রথম জানলাম৷

কে জানো এই দ্বিজু ? এই দ্বিজুই হচ্ছেন আমাদের চারণ কবি এবং স্বদেশ-হিতৈষী নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়!

প্রথম বাঙালী খ্রীষ্টান প্রথম ভারতীয় খ্রীষ্টান-বিবাহ স্থান শ্রীরামপুর

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে ২৮শে ডিসেম্বর হুগলী জেলার শ্রীরামপুর শহরে একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে৷ প্রথম বাঙালী হিন্দু কৃষ্ণপাল ওই দিন খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হন৷ কৃষ্ণপাল ছিলেন শ্রীরামপুরের অধিবাসী৷ শ্রীরামপুরের আলোড়ন সেদিন কোলকাতা তেও ছড়িয়ে পড়েছিল৷

ঠিক তিন বছর বাদে সমগ্র দেশব্যাপী আবার এক আলোড়ন ওঠে৷ সেই ঘটনারও কেন্দ্রস্থল শ্রীরামপুর৷ ঘটনাটি হচ্ছে প্রথম দেশীয় অর্থাৎ ভারতীয় খ্রীষ্টানদের মধ্যে বিবাহ৷ পাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ৷ পাত্রী কৃষ্ণপালের কন্যা৷ কৃষ্ণপ্রসাদ জাতিতে ব্রাহ্মণ আর কৃষ্ণপাল সূত্রধর অর্থাৎ ছুতার মিস্ত্রি৷

শ্রীরামপুরে তখন খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে এসেছিলেন কেরী মার্সম্যান ও ওয়ার্ড৷ শ্রীরামপুর সেই সময় দিনেমারদের অধীনে ছিল৷ শাসক হয়ে ও ইংরেজ তখন খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করতেন খুব ভয়ে ভয়ে৷ পাছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভারতীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ তাই ইংরেজ সরকার উক্ত তিন প্রচারককে কোলকাতায় খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি দেননি৷ তখন তাঁরা ডেনমার্কের অধিপতির কাছে অনুমতি পত্র পেয়ে শ্রীরামপুরে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারে আসেন৷ প্রথম ভারতীয় খ্রীষ্টানদের বিবাহে তাঁরা উপস্থিত ছিলেন৷ মিশনারীদের এই সাফল্যে উৎফুল্ল হয়ে ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানী পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে কালীঘাটে পুজো ও দিয়ে ছিলেন৷

অজানা অতিথি

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

কে তুমি পথিক হারাইয়া দিক

 এসেছো আমার দ্বারে,

নীরব চরণে সুস্মিত আননে

 ভোরের অন্ধকারে!

কারে তুমি চাও বলো কেন চাও

 কেন নিরবতা বারে বারে!

এসেছো যখন থাকো কিছুক্ষণ

 স্বাগত নমস্কারে৷

কিবা তব নাম কোথা তব ধাম

 কিবা তব পরিচয়,

 ঘুমায়ে রয়েছে কুলায় পাখি

 রাত এখনও অনেক বাকি

 হয়নি সূর্যোদয়!

তব মৌনতা কয় কত কথা

 আলোর দেবতা আঁধারে!

নিস্প্রভ রাত জ্যোতিতে প্রভাত

 হাতছানি বারে বারে!

 নাই ফুলমালা বরণ ডালায়

নাই দীপাধার পূজার থালায়

 নাই আয়োজন নয় মনোরম

 রীতি মেনে হবে কেমনে বরণ,

নতুন অতিথি, প্রথম আগমন,

 একি বিবর্ণ আপ্যায়ন!

 আগমনে নাই নিষেধ বারণ

তবু নিঝুম প্রভাতে আসার কারণ,

পথ ভুলে নাকি জরুরী প্রয়োজন

 দাও বিস্তারিত বিবরণ!

নিদ্রা ভঙ্গে তব দরশন---

বুঝিনি তো আগে কে তুমি আপন

নীরবে তাকালে হাসিতে ভোলালে

 অনুভবি তুমি প্রিয়তম জন!

প্রিয় তুমি এলে ভূবন ভুলালে

 রয়েছি তোমার স্মৃতিতে,

ছিলেম অনাথ বাড়াইলে হাত

 অনাদিকালের প্রীতিতে!

পথ ভুলে তুমি আসনি এ’ঘরে

 এসেছো পথ দেখাতে,

তব কৃপা বিনা অজানা বিপথে

গোলকধাঁধায় অমানিশা রাতে

লক্ষ্য বিহীন একাকি ভ্রমিয়া

 ক্লান্ত পান্থ পথে,

তাই তুমি এলে প্রীতি ঢেলে দিলে

 ব্যথায় প্রলেপ দিতে!

 কত কথা বাকি তোমার সনে

একান্তে চেয়েছি তোমায় না জেনে,

হৃদয়াসনে উপবেশনে

 রেখোনাকো দ্বিধা মনে৷

কত জনমের পূণ্য ফলে

 এলে মম ভবনে,

পেলব হৃদয় উচ্ছ্বসিত

 প্রনাম নিবেদনে৷

আনন্দধারা

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তোমার তরঙ্গে ভেসে চলেছি

অনাদি কালের স্রোতধারায়,

নিজের বলিতে যা’’ কিছু ছিল

আত্মসমর্পণে সকলই হারায়!

 

যায় না থাকা তোমা থেকে দূরে

পরিহার করার উপায় নাই,

 মোহন বাঁশির স্বর্গীয় সুরে

ভাবের গভীরে হারিয়ে যাই!

 

কোন সে লগনে ভাসি তব স্রোতে

তোমার জানা, তুমি বলে দাও,

অনন্তের পথে তুলে নিলে রথে

তুমিই সারথী, কোথা নিয়ে যাও?

 

যে রস প্রবাহে তুমিও রয়েছ

 নেচে চলেছ যে ভাবতরঙ্গে,

অন্তহীন রাত্রিদিন ক্লান্তিহীন

অবিচ্ছিন্ন আমি তোমারই সঙ্গে!

 

 কত জীবদেহ গুল্ম-লতায়

বিচিত্র রূপে জীবন বয়ে যায়,

 সুকৃতি-ফলে সংস্কার বলে

পাই মানব জীবন তোমার কৃপায়৷

 

বুঝিলাম আমি পেয়েছি বারতা

 তুমিই স্রষ্টা তুমিই বিধাতা,

 সুখ-দুঃখের নিত্য সাথী তুমি

হাসি-কান্নায় ভরো মনোভূমি,

সৃষ্টি স্থিতি মহাপ্রলয়ে

তুমিই পরিত্রাতা!

 

 ঝর্ণাধারায় সৃষ্ট তটিনী

 বিস্তার লভে প্রবাহধারায়,

জীবনপ্রবাহ উছল সরিতা

ভূমা ভাবে মন হারাইতে চায়!

 

 সেবা কর্মে তব প্রেরণায়

 তব সৃষ্টির টানে উদ্বুদ্ধ সেবায়,

জীব-উদ্ভিদ আমার আশায়

মোর পথ পানে অপলকে চায়!

 

আমার ’’আমি’’ কে আমিই চিনিনা

তুমি বলে দাও কে তবে ’’আমি’’,

তুমি তারে চেনো, সন্তান মানো

তোমা সাথে চলি দিবসযামি৷

 

জেনে বা না জেনে ছুটি তব পানে

কবে চলা শুরু সেতো জানা নাই,

 তুমি জানো এর অন্ত কোথায়

 বেলা শেষে চাই শ্রীচরণে ঠাঁই৷

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

২৪) ‘ঝষ্‌’ ধাতুর অর্থ দুটি৷ একটি মানে হত্যা করা, দ্বিতীয় মানে জল কাটা বা সন্তরণ করা৷ ‘ঝষ্‌’ ধাতু+ ‘ড’ প্রত্যয় করে যে ‘ঝ’ শব্দ পাচ্ছি তার একটি মানে ‘হত্যাকারী’৷ ভাবারূঢ়ার্থ ‘ঝ’ শব্দের অর্থ যে কোন সন্তরণ কারী হলেও ‘ঝ’ বা ‘ঝষ্‌’ (‘ঝষ্‌’ ‘অচ্‌’) বলতে মৎস্যকেই ৰোঝায়৷

ঝট, ঝটা, ঝটী, ঝটিকা ঃ ‘ঝট্‌’ ধাতু+ ‘অচ্‌’ প্রত্যয় করে ‘ঝট’ শব্দ পাচ্ছি বাংলায় যার তাদ্ভবিক রূপ হ’ল ‘ঝড়’৷ ‘ঝট’ মানে দ্রুত বেগে প্রবাহিত যে হাওয়ায় শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে৷

ঝটাখকস/ঝটাখক/ঝটাখকী ঃ ‘ঝট’ শব্দের একটি অর্থ, যার ওপর হাত চাপড়ালে ঢপ্‌ ঢপ্‌ শব্দ হয়৷ পাকা তরমুজে তা-ই হয়ে থাকে৷ যোগারূঢ়ার্থে ‘ঝটাখকস’ মানে বড় আকারের তরমুজ৷ অনুরূপভাবে ‘ঝটাখক’ মানে মাঝারি আকারের পাকা তরমুজ ও ‘ঝটাখকী’ মানে ছোট আকারের পাকা তরমুজ৷ বৈদিক ভাষায় ঝাটাখকস /ঝাটাখক/ঝাটাখকী ৰানানও চলে৷

ঝটিতি ঃ ভাবারূঢ়ার্থে ‘ঝটিতি’ হচ্ছে, যে ঝড়ের বেগে যায়৷ যোগারূঢ়ার্থে,‘শীঘ্র’৷

ঝরিকা ঃ ‘ঝরিকা’ শব্দের একটি অর্থ ‘ঝিঁঝিঁ পোকা’ cricket) অপর মানে হ’ল জল দেবার ঝাঁঝরি বা স্নানাগারের শাওয়ার৷

ঝষাশন ঃ ‘ঝষ্‌’ ধাতুর দু’টি অর্থ একটি অর্থ ‘হত্যা করা’ ‘ঝষ্‌’ ধাতু+‘অচ প্রত্যয় করে যে ‘ঝষ্‌’ শব্দ পাচ্ছি তার মানে ‘হত্যাকারী’৷ ‘ঝষ্‌’ ধাতুর অপর অর্থ ‘জল কেটে চলা’৷ যোগারূঢ়ার্থে ‘মাছ’৷ ‘অশন’ মানে খাওয়া৷ ‘ঝষাশন’ মানে ‘মৎস্যভুক্‌’৷ যোগারূঢ়ার্থে ‘ঝষাশন’ মানে গাঙ্গেয় শুশুক Gangetic porpoise)৷

ঝালর ঃ ‘ঝালর’ শব্দের দু’টি মানে৷ একটি মানে ঝিঁঝিঁ পোকা (ঝিল্লী ইংরেজীতেcricket)৷ হিন্দুস্তানীতে ব্যবহৃত ‘ঝিঙ্গুর’ শব্দটিও এই ঝালর’ থেকেই এসেছে৷ ‘ঝালর’-এর দ্বিতীয় মানে ‘রেখায়িত আলোক’৷ কোন ঘরের সবগুলি দরজা-জানালা যদি বন্ধ করে দিয়ে কেবল একটিমাত্র ছিদ্র রেখে দেওয়া হয় তবে সেই ছিদ্র দিয়ে যে রেখায়িত সূর্যালোক প্রবেশ করবে তাকে ৰলা হবে ‘ঝার্ল’৷ ঝালর শব্দটিকে বাংলায় অনায়াসেই ব্যবহার করা যেতে পারে৷ যেমন, ‘‘সূর্যঝালর চোখে মুখে এসে পড়ায় তার দীর্ঘ নিদ্রা ভেঙ্গে গেল৷’’

ঝাঁটা ঃ দেশজ ৰাংলা শব্দ৷ এর অর্থ ‘ঝাড়ু’৷ পর্যায়বাচক শব্দ হচ্ছে ঝাঁটা/ঝাড়ু/সম্মার্জনী/শতমুখী/ঝাড়ন/ ঝাড়োন৷

ঝুড়ি ঃ যা হাতে ঝোলে এই অর্থে ‘ঝোলা’ শব্দটা এসেছে৷ ‘ঝুলন’ শব্দটিও এইভাবে এসেছে৷ ‘র-লয়োরভেদ’ ঃ ‘ঝোলা’ হয়েছে ‘ঝোড়া’ ও ক্ষুদ্রীকরণে ‘ঝুড়ি’৷ মনে রাখতে হৰে যে ‘ঝুরি’ ও ‘ঝুড়ি’ এক নয়৷ ‘ঝুরি’ মানে যা ঝরে পড়ে৷ যেমন ফুলঝুরি, সোণাঝুরি৷ ঝুড়ির সমার্থক যে হিন্দুস্তানী শব্দের ব্যবহার বাংলায় চলে তা হচ্ছে ‘টুকরি’৷                         (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের লঘুনিরক্ত থেকে সংগৃহীত)

‘‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’’

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কিপ্ঢেকঞ্জুস ভাবলে–আরও এগিয়ে দেখি ...... দেখি সম্মুখে আরও কী রয়েছে৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস এগিয়ে চলেছে–তিরবেগে তুরঙ্গের মত .......বল্গাবিহীন অশ্বের মত উল্কার গতিতে৷ কিছুদূর যাবার পর সে দেখে সামনে রয়েছে মণি–মুক্তা–মাণিক্যের পাহাড়৷ মণি–মাণিক্য* দিয়ে অনায়াসেই একটা সোণার পাহাড় কেনা যায়৷

সে ভাবলে–এতদূর যখন এসেছি তখন আরও মূল্যবান কিছু পাওয়া যায় কিনা এগিয়ে দেখি৷.......এবার সে দৌড়ে দৌড়ে চলেছে ...........হাত–পা অবসন্ন, দম নিতে পারছে না৷ .......সর্বাঙ্গ দিয়ে কালঘাম ছুটছে.........তবুও সে ছুটে চলেছে.......ছুটে চলেছে .......এ চলার কি শেষ নেই!

কিছুদূর গিয়ে সে দেখলে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ৰেহ্মদত্যি (ৰ্রহ্মদৈত্যগ্গ৷ ৰেহ্মদত্যির মাথায় ঘুরে চলেছে সুতীক্ষ্ণ ফলাযুক্ত একটি প্রকাণ্ড চক্র৷ চক্রে তার মাথা কেটে মাথার ঘিলু বেরিয়ে আসছে ও ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে৷ ৰেহ্মদত্যি চীৎকার করে কাঁদছে৷ বলছে–‘‘গেলুম গো .....মলুম গো...... মা গো......কে কোথা আছো গো, ৰাঁচাও গো......আমি টাকা পয়সা চাই না....ধন দওলত চাই না.....আমি শান্তি চাই....আমি জীবনের পরম সম্পদ পরাশান্তি চাই৷’’ ৰেহ্মদত্যির মাথার রক্তৰিন্দুগুলি চারিদিকে ছিটকে ছিটকে পড়ছে৷ আর সেই রক্তৰিন্দু যেখানেই পড়ছে সেখানেই তৈরী হচ্ছে এক একটি অর্থপিশাচ৷ তারা একে অন্যের সঙ্গে হানাহানি মারামারি করছে..... তা করে নিজেরাই ধুলোয় লুটিয়ে পড়ছে.......তাদের অস্তিত্বের শেষ কণা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে৷

কিপ্ঢেকঞ্জুস ৰেহ্মদত্যিকে বললে–‘‘হ্যাঁ ভাই, তোমার মাথায় চক্র ঘুরছে কেন........ কেন এই অশেষভাবে ‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’’’

কিপ্ঢেকঞ্জুস কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ৰেহ্মদত্যির মাথা ছেড়ে চক্রটা তার মাথায় আশ্রয় নিল৷ আর ৰোঁ ৰোঁ ..........ৰন ৰন করে ঘুরতে লাগল৷ যন্ত্রণায় কিপ্ঢেকঞ্জুস ডুকরে কেঁদে উঠল........আমি ধন–দওলত চাই না ..........আমি ভুল পথে চলেছিলুম..........আমি শিবের সিফারিশ মত কুৰেরের সম্পদ চাই না.......আমি চাই শিবের শান্ত সমাহিত পরাপ্রশান্তি........কে, কোথা আছো গো, ৰাঁচাও গো..........মা গো, ৰাৰা গো......গেলুম গো......মলুম গো.........আমাকে ৰাঁচাবার কেউ কোথাও কি নেই আমি ছাই–মাখা শিবকেই চাই৷

ৰেহ্মদত্যি বললে–‘‘আমিও তোমার মত মোহগ্রস্ত অতিলোভী ছিলুম৷ তোমারই মত এইভাবে এইখানে এসে পৌঁছেছিলুম৷ এখানে এসে দেখেছিলুম আমারই মত আর এক ৰ্রহ্মপিশাচের মাথায় চক্র ঘুরছে৷ আমিও তাকে শুধিয়েছিলুম–হ্যাঁ ভাই, তোমার মাথায় চক্র ঘুরছে কেন শিবের ব্যবস্থায় বিধির বিধান হচ্ছে মোহের পরিণাম এই হয়....... ‘‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে৷’’ আবার যদি কখনও আমাদের মত কোনো মোহগ্রস্ত অতিলোভী লোক আসে আর জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ ভাই, তোমার মাথায় চক্র কেন ঘুরছে৷ সঙ্গে সঙ্গে চক্রটি তার মাথায় চলে যাবে আর তুমি চক্র–শাসন থেকে মুক্তি পাবে৷ আচ্ছা ভাই, তবে এখন আসি৷ কতদিন যে ‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’ অবস্থায় ছিলুম তার হিসেবনিকেশ নেই৷ তাই আমাকে এখন ফিরতে হবে৷’’

ৰেহ্মদত্যি আরও বললে–ৰেহ্মদত্যি হবার সময় যে ৰেল* (*মূল শব্দ হচ্ছে ৰিল্ব৷ বর্গীয় ‘ৰ’ দিয়ে লিখতেই হবে৷ পর্যায়বাচক শব্দ হচ্ছে ইক্ষবাকু, মহাফলম, শ্রীফলম৷ ‘ৰিল্’ শব্দের অর্থ ছিদ্র৷) গাছটিতে আশ্রয় নিয়েছিলুম এই দীর্ঘকাল পরে সেই গাছটি নিশ্চয় মরে গেছে৷ তাই আস্তানা হিসেবে আবার নোতুন আর একটি ৰেলগাছের সন্ধান করতে হবে৷ শিবের কৃপায় আবার যখন তুমি মুক্তি পাবে, তখন আমার সেই ৰেলগাছটির তলায় এসো, আমি তোমাকে মই দিয়ে গাছে তুলে নোৰ৷

কিপ্ঢেকঞ্জুস নিঃসঙ্গ অবস্থায় সেখানে দাঁড়িয়ে রইল৷ তার মাথা দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে৷ সেই রক্তৰিন্দু ৰিশ্বৰ্রহ্মাণ্ডে ছিটকে পড়ছে৷ প্রতি ৰিন্দু রক্তকণা থেকে গজিয়ে উঠছে মোহৰদ্ধ লোভী দানৰের দল৷ কিপ্ঢেকঞ্জুস চীৎকার করে কাঁদছে........মাগো.......ৰাৰা গো.......গেলুম গো.......মলুম গো......‘চক্রং ভ্রমতি মস্তকে’........৷

তাহলে মোহ রিপুর পরিণাম ৰুঝলে তো! মুখ্যতঃ এই মোহ রিপু থেকেই ঘৃণা–ভয় প্রভৃতি পাশগুলির উদ্ভূতি৷ এখান থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র পথ হচ্ছে পরম পুরুষের ভাবনা নেওয়া৷ অন্য কোনো পথ নেই ....‘‘নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়’’৷

গণের দায়িত্ব গণেশ নিলেন

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

তোমরা শুণেছ অথবা ছোটবেলায় তোমাদের জোর করে শোণানো হয়েছে বা ভয় দেখানোর জন্যে বলা হয়েছে যে ভূত বলে একটা অদ্ভুত জিনিস আছে৷ ছোটবেলায় যখন পিসিমার কোলে শুয়ে বা বসে হাত–পা ছুঁড়ে বলতে–দুধ খাব না, তখন পিসিমা একটা ভয়ের গল্প শোণাতেন৷ তখন ভয়ে হাত–পা নাড়া বন্ধ করে দিতে, পিসিমা হঠাৎ এক ঝিনুক দুধ মুখে ঢ়েলে দিতেন৷ সেই থেকে তোমার মনে শুরু হয়েছিল একটা ভূতের ভয়......একটা অজানা আতঙ্ক৷ এই ভূতেরা নাকি আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়......গা ভাসিয়ে দেয় হাওয়ার গতিধারায়৷ রাতবিট্টরেতে.... অন্ধকারে.....আলো–আঁধারিতে কাউকে একলা পেলে তাকে হাতছানি দেয়...দিন–দুপুরে বড় বাড়ীতে একলা ঘরে ভূতের কাল্পনিক পদধ্বনিতে গা ছমছম করে....আর সব ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়....কাণ হয়ে থাকে খাড়া....সে আসছে! হয়তো বা সে আসে....মনে হয় দিনের বেলা ভুল করতুম তর্ক করে এই বলে যে ভূত নেই কিন্তু বর্তমানে যে পরিবেশে রয়েছি সেই পরিবেশে কেবল আমি রয়েছি আর রয়েছে ভূত....একজন ভয় পাচ্ছি....আরেকজন ভয় পাওয়াচ্ছে৷ এই যে ভূতেরা এরা আলো দেখলে পালিয়ে যায়৷ এক সঙ্গে অনেক মানুষের জটলা দেখলে গা ঢ়াকা দেয়৷ সমাজে এরা কখনো কখনো ভয়ের বস্তু হিসেবে চিহ্ণিত বলে আদর–কদর পায় না৷ মানুষ যখন ভীতিগ্রস্ত অবস্থায় থাকে না তখন সুযোগ মত ভূতের ওপর এক হাত নেয় কিন্তু সে একলা থাকলে রাতের অন্ধকারে তাদের অপদেবতা বলে সম্মান জানায়৷ যেমন চোরেরা পুলিশ অফিসারের কাছে পৌঁছে গেলে ভয়ে ভক্তিতে সালাম জানায় কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেলে ডাইনে বাঁয়ে যে গলিটাই দেখতে পায় সেই গলিটায় ঢুকে পড়ে৷ ভূতেদের কিন্তু ব্যথা এখানেই৷ তারা সামাজিক স্বীকৃতি পায় না৷

হ্যাঁ, ওদের কথা তো জানই৷ এমনিতে অনেকেই বলে থাকে দেবতাদের সংখ্যা নাকি তেত্রিশ কোটি৷ যখন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা তেত্রিশ কোটির চেয়ে কম ছিল, দেবতা ছিলেন ৩৩ কোটি অর্থাৎ মাথাপিছু গড়ে একের ৰেশী দেবতা৷ সুতরাং মানুষকে ট্রাম–বাসে চলবার সময় একবার বাঁ দিকে, একবার ডানদিকে কপাল ঠুকতে হত৷ আবার সেই মানুষই যখন শাস্ত্রচর্চা করত ওদের বলত সব লৌকিক দেবতা৷ কারও সম্বন্ধে বলত ওরা পৌরাণিক দেবতা, কারো সম্বন্ধে বলত ওরা আসলে জৈন দেবতা৷ শরীরের অনেক অঙ্গকে কাটাকুটি করে করে দেওয়া হয়েছে খাঁদুরাণী বা খাঁদুবিবি৷ কারো সম্বন্ধে বলা হয় বিবর্ত্তিত বেনামা ৰৌদ্ধদেবতা৷ কোনো পেত্নী বা পেঁচো ভূতে ধরলেই তখন এদের শরণাপন্ন হয়৷ এদের বামুন–পুরুত নেই৷ জাত–বাঙ্গালী পুরুত এদের পুজো করে থাকেন৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুজোর বাড়ীর মেয়েছেলেরাই একটু আধটু উপবাস অধিবাস করে বাংলা পাঁচালী পড়ে পাঁচালীর পুঁথিটি কপালে তিনবার ঠেকিয়ে পুজো শেষ করে দেয়৷ তারপর প্রসাদ বিতরণ করা হয় বাতাসা, কলা, কখনো কখনো জলখাবারের সময় গরম ভাজা জিলিপি৷ এই যে দেবতারা এদের সংখ্যা যে কত তা আজ বলা যায় না৷ কারণ প্রতি দশম বর্ষে মানুষের আদমসুমারী হয় কিন্তু এই ভূতেদের বা দেবতাদের আদমসুমারী হয় কিনা বলতে পারছি না৷ কোন্ গণক বা এনিউমারেটর এই কাজ করেন তাও ঠিক জানা নেই৷ এই ধরনের দেবী–দেবতাকে অনেক সময় মানুষ সুস্থ মনে মানে না, কিন্তু বিপদে আপদে মানে৷ কোন দেবী সম্বন্ধে বলা হয়–অমুক রোগ বলতে নেই....বলতে হয় মায়ের দয়া হয়েছে....বিহারে বলা হয় ‘‘মাতা হোল ছে’’ (মাতা হয়েছে)৷ কলেরা হলে ফাসী–উর্দু–হিন্দোস্তানী বলে ‘হ্যায়জা’, সংস্কৃতে ‘বিসূচিকা’, বাংলায় ‘ওলাওঠা’৷ ওলাওঠা হলে ওলাইচণ্ডীর প্রতি ভক্তি বাড়ে৷ অন্য সময় বলা হয় ‘ওলাইচণ্ডী’ লৌকিক দেবী৷ গ্রামাঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সাপের উপদ্রব একটু বাড়ে ভরা বর্ষায় ও ভাদ্রের শেষ পর্যন্ত৷ তাই বিষহরি বা মনসার এই সময়টিতে প্রভাব হয় বেশী! এতে জাতপাতের বিচার নেই...হিন্দু–মুসলমানের ভেদ নেই৷ ওলাবিবির মত মনসাও সবাইকার দেবী৷ মনসার ভাসান বা পাঁচালীতে ছোঁয়াছুঁয়ি নেই৷ একই গ্রামে অর্জুন মণ্ডল নামে তিন ৰন্ধু–একজন হিন্দু, একজন মুসলমান, একজন খ্রীষ্টান–মনসার ভাসানে তিন জনই গান গায়৷ এই সকল দেবীদেবতারা ভক্তি–শ্রদ্ধা পায় না৷ সেই জন্যে প্রাচীনকালে পুরাণকারেরা নানানভাবে ভয়ের সূচিকাভরণ করে (injection) এই সকল দেবতাদের প্রতি ভক্তি জাগাবার চেষ্টা করেছেন–তৈরী করেছেন রকমারি গল্প যা শোণানোর সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ভয়ে–ভক্তিতে স্বেদ–ঘর্ম দেখা দেয়৷ এই দেবতাদের চরিত্র এমনভাবে আঁকা হয়েছে যেন তারা সব সময় রেগে টং হয়ে রয়েছে....শাপ দেবার জন্যে জিব উঁচিয়ে রয়েছে৷ তবু এই সকল দেবদেবীরা সাময়িকভাবে মর্যাদা পান–অন্য সময়ে নয়৷ কায়স্থদের ঘোষ–বোস–মিত্র–গুহ বিয়ে বাড়ীর ছাদনা তলায় একরাত্রির শাহানশাহ হয়ে যান, তারপরে লোকে তাদের কথা ভুলে যায়৷ এই যে সব দেবী–দেবতা যারা শাস্ত্রমতে স্বীকৃত দেব–দেবী তো নয়ই....কোথাও কোথাও শাস্ত্রে অস্বীকৃত–এদেরও অনেক সময় লোকে ভয়ে উপদেবতা বলে থাকে৷ ভূতকে সে ভয়ে বলে থাকে অপদেবতা৷ এই সকল অপদেবতা ও উপদেবতারা (উপ মানে কাছাকাছি) পৌরাণিক গল্পমতে একবার তাদের উপেক্ষার মর্মজ্বালা সহ্য করতে না পেরে শিবের শরণাগত হয়েছিল৷ শিব তাদের শরণ দিয়েছিলেন এই শর্তে যে তারা সৎপথে চলবে... ভক্তিরসে জারিত হয়ে থাকবে....পারস্পরিক মারামারি, কাড়াকাড়ি, হানাহানি করবে না...নিরীহের মুণ্ডুপাত করে রক্ত মোক্ষণ করবে না৷ এই উপদেবতা ও অপদেবতারা শিবকে নাকি বচন দিয়েছিল তারা অহেতুকভাবে কাউকে অকালে যমালয়ে পাঠাবে না৷ তাই এরা পেল শিবের আশ্রয়৷ শিবের আশ্রয় পাওয়া এইসব উপদেবতা–পদেবতা নাম দেওয়া হল ‘গণ’৷ ঠিক হল, শিব যেখানে যাবেন শিবের আগে বা পরে, বিশেষ করে সেটা যদি হয় সোমবার অথবা বিশেষ করে হয় চৈত্র মাস তাহলে সেই অপদেবতা বা উপদেবতারা শিবের আগে বা পরে চলতে থাকবে৷ এই গণেরা যাতে কোন অবাঞ্ছিত কাজ না করে বসে তাই এদের আচরণের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার তা শিব অনুভব করেছিলেন৷ সেই আশায় শিব কার্ত্তিককে বলেছিলেন–‘‘কার্ত্তিক, তুমি এদের দায়িত্ব নাও৷’’

কার্ত্তিক বললেন–‘‘পিতৃদেব আপনি যা আদেশ দেবেন আমি তা পালন করব৷ কিন্তু মুসকিল হচ্ছে দু’জায়গায়৷ প্রথমতঃ আপনি যখন তাণ্ডব নাচেন তখন আপনার জটা থেকে দলে দলে সাপেরা মাটিতে পড়তে থাকে৷ আপনি তো জানেন সাপ ময়ূরের প্রিয় খাদ্য৷ ওই সময় যদি ময়ূরকে অন্য কাজে ব্যস্ত না রাখা হয় তাহলে সর্পকুল ধ্বংস হওয়া সুনিশ্চিত৷ কবি বিদ্যাপতিও পার্বতীর মুখ দিয়ে বলিয়েছেন ঃ

‘‘কার্ত্তিক পোষল ময়ূর সেহ নাগে খাবত হে৷’’

পিতৃদেব, আরও একটি কথা হচ্ছে এই যে ময়ূরটি আমার অনেকদিন ধরেই বাত রোগে জরাজীর্ণ রয়েছে .......চৌরঙ্গী বাত৷ মাথার ঝুমকো থেকে পায়ের কড়ে আঙ্গুলের নখ পর্যন্ত বাতগ্রস্ত৷ ডাক্তার বলছে, এর সর্বাঙ্গে ব্যায়াম দরকার৷ তাই ময়ূরের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমি ময়ূরকে আমার সঙ্গে বিশ্বপরিক্রমায় ব্যস্ত রাখতে চাই৷ এই অবস্থায় আমাকে যদি গণেদের তদারকিতে ব্যস্ত থাকতে হয় তাহলে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে৷ তবু আপনি যখন বলছেন, করব৷ তবে আপনি একবার দাদা গণেশকে শুধিয়ে দেখতে পারেন৷

শিব ওই কথা গণেশকেও বললেন৷

গণেশ বললেন–‘‘বাবা, তুমি যখন বলছ তখন আমি নিশ্চয় করব৷ এক্ষুণি এই মুহূর্ত থেকেই করব৷’’

শিব আশ্বস্ত হলেন৷

গণেশের ওপর তদারকি বা খবরদারির দায়িত্ব দেবার ফলে গণেশকে নাম দেওয়া হল গণেশ (গণ ঈশ)–গণেদের নিয়ন্ত্রক.... controller of Ganas.

তাহলে তোমরা ‘গণ’ শব্দের এই মানেটাও বুঝে গেলে তো! (শব্দ চয়নিকা, ১৬/১২১)

কাঁচা বেঁশো হ্যাংলামি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘ক্রুড্’ ধাতুর একটি অর্থ ‘হ্যাংলামি করা’ বা ‘ন্যালা খ্যাপামি করা’ –কাঁচা বাঁশের মত হ্যাংলামি বা ন্যালা খ্যাপামি যা শুণলেই বোঝা যায়, দেখলেই ধরা যায় অথবা এমনও কেউ কেউ থাকে যারা ধরা পড়বার জন্যেই এই রকম হ্যাংলামি বা ন্যালাখ্যাপামি করে থাকে৷ যেমন নেম্তন্ন বাড়ীতে তোমার আরও কয়েকটা রসগোল্লা খাবার ইচ্ছে হল৷ তুমি পাশের ভদ্রলোকটির পাত দেখিয়ে বললে......ও দাদা, এদিকে, এদিকে, এঁর পাতে কয়েকটা রসগোল্লা দিন৷

রসগোল্লা পরিবেশনকারী কাছে এলে তাকে বললে–আমায় আর দেওয়া কেন! আমার পাতে পরে দেবেন (আসলে পরিবেশনকারী তাকে দিতে আসেন নি, এসেছিলেন পাশের লোকটিকে দিতে)৷ পরিবেশনকারী দিতে গেলে বললে–না, আমার আর চাই না, পেট ভরে গেছে৷ আবার হ্যাংলামি করে বললে–তা দেবেন যখন অন্ততঃ চারটে দিন৷ একগণ্ডার কমে কি ভাল দেখায়! এতে পরিবেশনকারী বুঝে নিলেন, যিনি পরিবেশনকারীকে ডেকেছিলেন তাঁরই রসগোল্লা দরকার......আর চারটে দরকার৷ এই ধরণের হ্যাংলামির জন্যে ক্রুড/ক্রুড়, শব্দটি চলবে৷ চলবে ক্রুূযৎ ঞ্চ ক্রড্য শব্দটিও (ক্রুড়া হয় না)৷ একবার দেখেছিলুম জনৈকা মহিলা–তিনি ছিলেন একজন মস্তবড় অফিসারের মাতাঠাকুরাণী–একজন মধ্যবিত্তের বাড়ীতে গিয়ে তার লক্লকে লাউগাছটি দেখে বলেছিলেন–লাউ–এর ডগাগুলো ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো৷ পোস্ত–বাটার সঙ্গে লাউডগা সেদ্ধ খেতে খুব ভাল লাগে৷ চাকরটাকে রোজই বাজারে পাঠাই৷ এসে বলে বাজারে আজকাল লাউডগা পাওয়া যাচ্ছে না৷ লাউডগা–পোস্ত সেই যে কোন মান্ধাতার আমলে খেয়েছিলুম, আজও যেন জিবে লেগে আছে৷ লাউ–ডগার মালিক কি আর করেন! মহিলার সঙ্গে কিছু লাউডগা পাঠিয়ে দিলেন৷ যাই হোক, এই কাঁচাবেঁশো হ্যাংলামি ভালভাবেই বুঝলে৷ সুতরাং ওই হ্যাংলা মহিলা হচ্ছেন ‘ক্রুড্যা’৷

আমার পরিচিত ভোলা মোড়লের ভাল রকমের বেগুনের চাষ ছিল৷ বর্ষার শেষে একদিন সে তার বেগুনবাড়ী থেকে বছরের প্রথম ফসলটি তুলে নিয়ে বাড়ীর দিকে যাচ্ছিল৷ আশা করেছিল, বর্ধমানের বাজারে নতুন মুক্তকেশী বেগুনের ভালই দর পাবে........তার একটু টেনেটুনে সংসার চলত৷ রাস্তায় সে পড়ে গেল হরু ভটচাজের খপ্পরে৷ হরু ভট্চাজ্ বললে–কি রে ভোলা, আজকাল তোর দেমাগে যে মাটিতে পা–ই পড়ে না৷ বামুন–বোষ্টমের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি হারালে ফল কি ভাল হয় জানিস তো মাথার ওপর নারায়ণ রয়েছেন৷ তিনি আমাকেও দেখছেন, তোকেও দেখছেন, বেগুনগুলোকেও দেখছেন৷ যাই হোক, বেগুনগুলো বেশ তেল কুচকুচে৷ কম আঁাঁচে পোড়াতে গেলে গায়ে তেলও মাখাতে হবে না৷ তা তু’ এক কাজ কর গা৷ আমাকে বেগুনগুলো দিতে হবে না৷ তু’ ওগুলো পুড়িয়ে যেন আমার প্রসাদ খাচ্ছিস ভেবে নিজেই খা গা যা৷ ভোলা মোড়ল আর কি করে! তার বুকের পাঁজর–ভাঙ্গা আট–দশটা বেগুন হরু ভটচাজকে দিয়ে দিলে৷ এই হরু ভটচাজ ছিল একটি নির্ভেজাল ‘ক্রুডা’৷

কোন একটা বিয়ে বাড়ীতে ভিয়েন বসেছে৷ অনিমন্ত্রিত পুণ্ডরীকাক্ষ ভট্টাচার্য্য হঠাৎ সেখানে পৌঁছে গেলেন৷ পুণ্ডু ভট্চাজ্ ছিলেন আমাদেরই বর্ধমান জেলার পুতুণ্ডু গ্রামের বাসিন্দে৷ মস্ত বড় ভিয়েন, কলকাতা থেকে বাছাইকরা হালুইকারেরা এসেছে৷

পুণ্ডু ভটচাজ্ বললেন–খাওয়াদাওয়ায় আমার তেমন আগ্রহ নেই৷ কিন্তু রান্নাবান্না দেখতে বড্ড ভালবাসি.....সেই ছোটবেলাকার স্বভাব৷

সবাই বললে–এসো,এসো, বসো, বসো৷ দেখো, কেমন খাবার তৈরী হচ্ছে৷

দেখে বোঝা গেল হালুইকারেরা খুব উন্নত মানের চমচম*(*সংস্কৃতে ‘চম্’ ধাতু হল গোগ্রাসে গিলে খাওয়া৷ একপক্ষের সৈন্য অন্য পক্ষের দেশে গিয়ে সব কিছুকে গোগ্রাসে গিলে খায়৷ এই অর্থে চম্ ধাতুূউস্ প্রত্যয় করে ‘চম্’ শব্দটি পাচ্ছি৷ ‘চমু’ মানে সৈন্যবাহিনী৷ ‘চমূড্ণ্’ করে ‘চম্’ শব্দটি পাচ্ছি, অর্থাৎ যা দেখে গোগ্রাসে গিলে খেতে লোকের ইচ্ছে হয়৷) তৈরী করছে৷ পুণ্ডু ভট্চাজ্ আর নোলা সামলাতে পারছে না৷ প্রাণে আকুতি জেগেছে, চমচম একেবারে খোলা থেকে নোলায় চলে আসুক৷ সে তখন স্বগতভাবে বললে, (বললে এমন ভাবে যাতে আর পাঁচটা লোকের বধির কর্ণেও তা প্রবেশ করে)–এককালে চমচম খেতে খুবই ভালবাসতুম৷ কবে সেই খেয়েছিলুম.......বাহাৰপুরের ঘোষেদের বাড়ীতে৷ এখনও যেন ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারছি না৷ মন বারে বারে সেই চমচমে ফিরে যেতে চায়৷ এখন দু’চারটে চাখতে পারতুম কিন্তু সন্ধ্যে হয় হয়৷ সন্ধ্যে আহ্ণিক না করে খাই বা কি করে– তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে–সে কথাও ভুলি কি করে৷

হালুইকারেরা বললে–সন্ধ্যে হতে এখনও একটু দেরী আছে৷

পুণ্ডু ভটচায্ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললে–হ্যাঁ মনে হয় আধঘন্টাটাক সময় আছে৷

হালুইকারেরা বললে–তৰে দুটো সন্দেশ চেখেই দেখুন৷ আমার মনে হয় গণ্ডাখানেক চেখে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফেলাও সম্ভব৷ হালুইকারেরা কি আর করে! পুণ্ডু ভট্চাজ্কে একটা শাল পাতায় মুড়ে চারটে চমচম দিলে৷ এও সেই কাঁচা বেঁশো হ্যাংলামি৷ পুণ্ডুরীকাক্ষ ভট্টাচার্য হলেন একটি ডাকসাইটে ‘ক্রুড্ড’৷ যাই হোক, তোমরা ‘ক্রুড্’ ধাতুর রকমারি ব্যবহার দেখলে তো৷                                  (শব্দ চয়নিকা)

আয় বৃষ্টি ঝেঁপে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

আকাশে মেঘ জমতে দেখলে আমরা মনে করি বুঝি বৃষ্টি হবে৷ কিন্তু মেঘ ছাড়াও বৃষ্টির আরো পূর্ব লক্ষণ আছে৷

আমাদের দেশের প্রাচীন জ্যোতিষীরা বলে গেছেন, পিপঁড়েদের যদি দেখা যায়, হঠাৎ খাবার মুখে নিয়ে ওপরের দিকে উঠতে তবে বুঝতে হবে শিগ্রীই বৃষ্টি হবে৷ বৃষ্টি হবার আগে ব্যাঙ ডাকে তা আমরা প্রায় সবাই জানি৷ বৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়ালরা অনেক আগেই টের পেয়ে নিরাপদ জায়গায় ছুটতে থাকে৷ অনুরূপভাবে বেজি আর সাপও যার যার আস্তানার দিকে দৌড়তে থাকে৷ শরভ নামে এক ধরণের হরিণ বৃষ্টির আগে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়৷

 বেতো রোগীদের বাতগ্রস্ত অঙ্গে আঘাত লেগে যদি খুব যন্ত্রণা হয় তবে জানবে বৃষ্টি অবধারিত৷ সাপেদের গাছে চড়া, জলস্তম্ভ, জলচর পাখিদের ডানা শুকনোর ব্যস্ততা আর ঝিঁঝিঁর ডাক---এ সবই বৃষ্টির পূর্ব লক্ষণ৷

জ্যোতিষীরা আরো বলে গেছেন পৌষ মাসে বৃষ্টির সময় যদি দেখা যায়, উত্তর বা পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া বইছে তাহলে বুঝতে হবে প্রচুর বৃষ্টি হবে৷ আর পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে হাওয়া বইলে বৃষ্টি সাধারণত অল্পই হয়৷ হাওয়া না বইলে ধরে নিতে পার বৃষ্টি হবে না৷ এলোমেলো হাওয়া বইলে বৃষ্টি তাড়াতাড়ি থেমে যায়৷ পৌষ মাসের যে-তিথিতে বৃষ্টি বা কুয়াশা হয় শ্রাবণ মাসের সেই তিথিতে বৃষ্টি হবেই হবে৷

বাঙলায় ডাকের বচনের মত উত্তর প্রদেশে ঘাঘের বচনের প্রচলন আছে৷ সেই ঘাঘের বচন অনুসরণ করে বলা যায়, যে বছর অগ্রাহায়ণ মাসে খুব গরম পড়ে সে-বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়৷ যদি ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের ষষ্ঠীতে অনুরাধা নক্ষত্র পড়ে তবে সারা দেশ জুড়ে বৃষ্টি হয়৷ যদি শুক্রবার আকাশে মেঘ দেখা যায় এবং সেই মেঘ শনিবার অবধি থাকে তবে সেই মেঘে বৃষ্টি হবেই হবে৷ যদি আষাঢ় মাসে সোম শুক্র অথবা বৃহস্পতিবার শুক্ল-প্রতিপাদ তিথি পড়ে তবে প্রবল বর্ষণ হয়ে থাকে৷

জ্ঞানের গভীরে

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

জ্ঞানের গভীরে ধরা নাহি যায়

ধ্যানে অনুরাগে পেয়েছি তোমায়,

সমর্পিত মন খোঁজে শ্রীচরণ

জ্ঞানের গরিমা তোমাতে হারায়!

শয়নে স্বপনে গানে জাগরণে

উজ্জীবিত মন তব প্রেরণায়,

যশ-সুখ্যাতি নাহি মানে ইতি

অবোধের মতি তোমায় ভুলায়৷

নিদাঘ হুতাশে দগ্দ বাতাসে

তৃপ্ত বরষার শীতল সলিলে,

বিপদে রয়েছ সম্পদে আছো

প্রীতি-ডোরে বাঁধো অতীত ভুলে৷

ভোরের আলোয় নিকষ কালোয়

মন্দ-ভালোয় তব আশীর্বাদ,

এই ভরসায় সমুখে চলায়

বিরতি বিহীন যাত্রা অবাধ৷

গহন বনে হলে দিশাহারা

শঙ্কিত মনে তুমি ধ্রুবতারা,

পিশাচ হুঙ্কারে মাতিয়াছে যারা

তোমার আলোয় মুছে গেছে তারা!

ব্যথা হতাশায় একেলা অসহায়

এলে প্রলেপ বোলাতে স্তব্ধ প্রহরে,

করিনি তো আশা দিলে ভালবাসা

তুমি পিতা মোর রয়েছি নজরে৷

আর্থিক সুখ টেনে আনে দুঃখ

পারমার্থিক নির্দেশ প্রগতির মুখ,

কে দিল সান্ত্বনা কহিল কুকথা

উদাসীন থেকে বাঁধিয়াছি বুক!

তোমার আশীষ আছে শিরোপরে

বিপথগমনে ভুলিয়া যাই,

তব আকর্ষণে ফিরি তব পানে

তোমায় হারাবার উপায় নাই!