সমাজের প্রেক্ষাপটেই মানুষের ও তার সমাজের সভ্যতার অগ্রগতি, বিবর্তন ও উদ্বর্তনা, কেননা মানুষ তো সমাজবদ্ধ জীব৷ সমাজর্োধই যুর্থদ্ধ মানুষকে এগিয়ে চলার পাথেয় যুগিয়েছে৷ সহযোগিতা,একসঙ্গে চলার প্রেরণা, মানুষের প্রতি মানুষের পারস্পরিক নিঃশর্ত শ্রদ্ধা ভালবাসা, সর্র্বেপরি অহৈতুকী সামাজিক দায়বদ্ধতা মানুষকে মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে পৃথক করেছে, মানুষকে উন্নত থেকে উন্নতর সোপানে আরোহণে সাহায্য করেছে৷ নব নব আবিষ্কারের উদ্ভাবনের অলক্ষ্য সঞ্চালক শক্তি যেমন ব্যষ্টিমনের আনন্দের রসায়ন, তেমনি সমাজবোধ বা সামাজিক দায়বদ্ধতা৷ ওই বোধ-অনুভূতিগুলোর সন্তুলিত সামবায়িক নামই তো মনুষ্যত্ব বোধ৷ আর এর উন্মেষ, পুষ্টি ও বিস্তারের মূলে আছে আধ্যাত্মিকতা৷
কী সেই আধ্যাত্মিকতা? অসীমের সাথে সসীম সম্পর্ক অনুসন্ধানের অন্তহীন প্রয়াসই হল আধ্যাত্মিকতা৷ মানুষের মন ছুটে চলে ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের দিকে৷ সন্ধান করে বহুর মাঝে এককে৷ আত্মবীক্ষণ ঘটে বহুর মাঝে কেউ পর নয়৷ সবাই আপন, হর পিতা, গৌরী মাতা, স্বদেশ হ’ল ত্রিভুবন৷ যুক্তিবিজ্ঞান কী বলে? ওই সঞ্চারিত বৃহতের অনুভূতি ছাড়া কি বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্ভব? কখনও নয়৷ জীবের মধ্যে শিবের অনুভূতি, মমত্ববোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালবাসা বা সামাজিক দার্য়দ্ধতাদি মানবমনীষায় দানা বাঁধে না--- আধ্যাত্মিকতায় মন সম্পৃক্ত না হলে৷ মানবতা, সাম্য প্রগতি, শোষণযুক্তি, ন্যায় বিচার, সার্বিক কল্যাণ, সেবা প্রভৃতি মনুষ্যত্বর্োধক শব্দগুলো নেহাতই আভিধানিক শব্দ হিসেবেই থেকে যায়৷ হয়ে যায় তোতাপাখির শেখানো বুলিমাত্র৷ তা কখনোই করুণাঘন হৃদয়ের অন্তঃস্থলের অন্তঃসলিলার স্বত:স্ফূর্ত নির্ঝর হয় না৷ দুর্র্ভগ্যের বিষয়---ভোগোন্মত্ত জড়বাদী জীবনদৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে আধ্যাত্মবাদী জীবনাদর্শ৷ মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে লোভ-লালসা, শঠতা, হীন স্বার্থের চোরাবালিতে৷
মানুষের ঝুলিতে অমূল্যসম্পদ বলে যদি কিছু থাকে--- তাহলে অবশ্যই তা আধ্যাত্মিকতা৷ একে হারিয়ে বা অস্বীকার করে মানুষ বিষবৃক্ষ রোপণ করেছে, বিষফল ফলছে সমাজজীবনের সর্বস্তরে৷ মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে নূ্যনতম প্রয়োজন খাদ্য-বাসস্থানাদি আবশ্যিক৷ মানুষকে বাঁচতে হলে, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান- শিক্ষা-চিকিৎসা--- এই পাঁচটি প্রাথমিক বা মৌল উপাদানগুলি অবশ্যই পেতে হবে৷ এগুলোর নিশ্চয়ই নিরাপত্তা চাই-ই-চাই৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় দেশের সিংহভাগ মানুষেরই তা নেই৷ অথচ পাঁচটি মৌল প্রয়োজন পূর্তির ওপরই মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা তথা সামাজিক নিরাপত্তা৷ অস্তিত্ব সুরক্ষিত হলে তবেই না মন ছুটবে অমৃতের সন্ধানে৷ সঞ্চারিত হবে আত্মাভিমুখী গতি৷
অপ্রিয় সত্যটা হল সমাজের সবকিছুই মুষ্টিমেয় ব্যষ্টি বা গোষ্ঠীর কুক্ষীগত ও নিয়ন্ত্রিত ৷ আবার এরাই পরিচালকমন্ডলী৷ বাকীরা ছাগলের তৃতীয় বাচ্চা৷ আসলে সমাজের চালক শক্তি বৃহতের ভাবনায় প্রেষিত নয়৷ ফলে চালকের কাজে সামাজিক দায়বদ্ধতা কোন গুরুত্বই পায় নি৷ কিন্তু নৈতিকতা আধ্যাত্মিকতা বোধে উদ্বুদ্ধ মানুষই জীবের মধ্যে শিবকে খঁুজে পায়, আমার ‘আমি’র প্রতিবিম্বন অনুভব করে ৷ আত্মাভিমুখী মনই সামূহিক কল্যাণে, সাধনায়, সেবায়, ত্যাগে মহতো-মহীহান হয়ে ওঠে৷ এদের কন্ঠেই ধবনি-প্রতিধবনি হয়ে ফেরে--- মানবপ্রেমিকের ভাষার--- ‘‘পর সুখ বিনা আত্ম সুখের মূল্য নাই৷’’ তোমার সুখই আমার সুখ,তোমার দুঃখই আমার দুঃখ, তোমার আনন্দই আমার আনন্দ৷ এই সমৃদ্ধ মন কখনও শোষণ বা বঞ্চনা -অত্যাচার-অবিচারের শরিক হতে পারে না৷ তাই কল্যাণকামী, কল্যাণব্রতী, সমাজহিতৈষী, সমাজসেবী, নীতি নির্দ্ধারক বা নিয়ামক ব্যষ্টি বা সংস্থা যে বা যারাই হোন না কেন আধ্যাত্মিকতায় দৃঢ়প্রতিষ্ঠ না হলে মানুষের প্রকৃত কল্যাণ সূদুর পরাহত৷
আজ থেকে প্রায় তিন শত বছর পূর্বে মানুষের জীবন থেকে ওই আধ্যাত্মিকতাই হারিয়ে গেছে৷ অথচ ভারতীয় সভ্যতার উষালগ্ণ থেকেই ভারতীয়দের নিজস্ব প্রাণধর্ম গড়ে উঠেছে আধ্যাত্মিকতাকে ভিত্তি করে৷ ‘‘ব্যষ্টিমানুষের যেমন তার নিজস্ব চরিত্র-বৈশিষ্ট্য থাকে, তেমনই একই ভৌগোলিক পরিবেশ, একই ঐতিহাসিক ও সাংসৃকতিক আবেষ্টনীর মধ্যে যাদের জন্ম ও লালন-পালন, সেই গোষ্ঠী অপর জনগোষ্ঠী থেকে ভিন্নতর গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য অর্জন করে৷ পরবর্তীকালে এই গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্যগুলোই সমগ্র জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ভাবধারার সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যে এতে করে একটা জাতীয় স্বভাব তৈরী হয়৷ তা দিয়েই একটা গোটা জাতির মানস-প্রবণতা, বাহ্যিক আচরণ, জীবন ও সমাজের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি---এক-কথায়, একটা বিশেষ জাতীয় দৃষ্টিকোণ গড়ে ওঠে--- যা সেই জাতিকে অন্য জাতি থেকে এক পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করে৷ এটাই হল প্রাণধর্ম৷’’ (প্রাণধর্ম -শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার)৷
এই কারণে আধ্যাত্মিকতাকে ভিত্তি করে ভারতীয়দের নিজস্ব প্রাণধর্ম গড়ে উঠেছে বলে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ভারতীয়রা অন্তর্মুখী পরাভিমুখী (অধ্যাত্মমুখী)৷ এই অন্তর্মুখী জীবনধারাই ভারতীয় জীবনদর্শন, শিক্ষাদর্শন, সমাজদর্শন তথা সামগ্রিক জীবন ধারাকে এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছে৷ বর্ত্তমান ভারতের এই পরাভিমুখী জীবনধারা থেকে বিচ্যুতিতেই যত বিপত্তি৷ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুও সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিলেন---‘‘প্রত্যেক ব্যক্তি বা জাতির একটা ধর্ম বা আদর্শ আছে সেই আদর্শকে অবলম্বন করে ও আশ্রয়ে সে গড়িয়া ওঠে৷ সেই আদর্শকে বাদ দিলে তার জীবন অর্থহীন ও নিষ্প্রয়োজন হইয়া যায়৷” (তরুণের স্বপ্ণ-২-৯৩)৷
কাজেই আলোচনার উপান্তে এসে একই কথার পুনরাবৃত্তি করি --- সোনার বাংলা গঠন, সকলপ্রকার শোষণমুক্ত আদর্শসমাজ তৈরী বা স্বপ্ণের ভারত সংরচনায় ব্যষ্টি তথা সমাজ জীবনে সেই অলক্ষ্য সঞ্চালক শক্তি--- আধ্যাত্মিকতার পুন:প্রতিষ্ঠা ভিন্ন গতি নেই৷
- Log in to post comments