অজগরের গ্রাসে বাঙালী

লেখক
রবীন্দ্রনাথ সেন

একটা ভয়ঙ্কর অজগর গ্রাস করছে আস্ত বাঙলাকে৷ কখন খপ করে ধরেছে সে, বুঝে ওঠার আগেই পাকে পাকে জড়িয়ে ফেলেছে৷ অসহায়---বড্ড অসহায় লাগছে৷ বাঁচবার কি উপায় নেই কোন? প্রতিবাদী বাঙলাকে কবজা করতে বাঙলা ভাগের সিদ্ধান্ত নিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ ৷ প্রতিবাদ হলো বিপ্লবী অরবিন্দের নেতৃত্বে৷ সাময়িক বিরতি৷ কিন্তু কৌশল বদল হল না৷ ভাগ হলো বাঙলা৷ একসময়ে ইংরেজকে চলে যেতে হলো৷ রফা হলো হিন্দিসাম্রাজ্যবাদীদের্ সঙ্গে৷ সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢাললো ইংরেজ৷ মাথা চাড়া দিলো মৌলবাদ, দাবীয়ে বেড়াল সাম্প্রদায়িকতা, হল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা৷ নিহত হল অসংখ্য বাঙালী৷ সেই সুযোগে বাঙলা ভাগ হলো৷ বৃহদংশ গেল পাকিস্তানে৷ শুধু তাই নয় মানুষের মনে দগদগে ঘা হয়ে রইল এই দাঙ্গা৷ হারিয়ে গেল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, হারিয়ে গেল বিশ্বাস, প্রশ্ণ জাগলো বিবেক-মনুষ্যত্ব নিয়ে৷ লোভী রাজনৈতিক নেতারা হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের দালালরা খঁুচিয়ে তুলতে লাগল সেই দগদগে ঘা৷

ভারত স্বাধীন হলো৷ স্বাধীন ভারতে বাঙলাকে খণ্ড খণ্ড করে রাখা হলো পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে৷ বাংলার অংশ রইল বিহারে, বর্তমান ঝাড়খণ্ডে, ওড়িষ্যায়, অসমে৷ অসম বিভক্ত হয়ে হলো মেঘালয়,মণিপুর, নাগাল্যাণ্ড৷ বাঙলার অংশ হলো টুকরো টুকরো৷ ত্রিপুরা হলো আলাদা রাজ্য৷ বাঙালীর জাতিসত্তা বিলুপ্ত প্রায়৷ বাংলা ভাষা হলো লাঞ্ছিত, বাংলা সংস্কৃতি বিপন্ন ৷ বাঙলার ইতিহাস চাপা পড়ল শক্ত গ্রানাইট পাথরে৷ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের দালাল কংগ্রেস, সিপিএম মাথা চাড়া দিয়ে উঠল৷ বাঙালীর উন্নত মেধা, বুদ্ধি, শ্রম, শিক্ষা-সংস্কৃতি চাপা পড়ল কালের গর্ভে ৷ ভিনরাজ্যে ভিন দেশে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করল কেউ কেউ৷

 দেশভাগ তথা বাঙলা ভাগের দুঃসহ যন্ত্রণার হল না অবসান৷ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা হলো না৷ যে যেথায় পারল আশ্রয় নিল৷ সরকার পাঠালো দণ্ড কারণ্যে, পাঠাল আন্দামানে৷ অসহায় নির্যাতিত সাধারণ উদ্বাস্তু বাঙালী তীব্র লড়াই করে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার চেষ্টা করল৷

বিভেদ ছড়িয়ে দেওয়া হল এপার ওপার মানুষের মধ্যে ৷ হিন্দু মুসলমানের বিভেদ তো আছেই৷ বাঙালী বুঝে উঠতে পারল না কে তাদের বুকে ছুরি বসালো ৷ তারা বিশ্বাসঘাতকদেরই বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো৷ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীদের লোলুপ দৃষ্টি---বাঙালীকে নিঃশেষ করতে হবে৷ বাঙালীর সমস্ত অধিকার, বাঙলার বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ কব্জা করে রাখবে৷ আর বুদ্ধিমান বাঙালীকে দাসে পরিণত করবে৷ শুরু হলো আবার কৌশল৷ জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর নামে৷ বার বার সংশোধন করে বাঙালীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার পাকাপাকি ব্যবস্থা৷

লোভী, কপট, ঈর্ষা পরায়ণ, অসৎ নেতৃত্ব, হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের দালালরা বাঙালীর ধনসম্পত্তি চাকরী ব্যবসা কেড়ে নেবার জন্য বাঙালীদের বাঙলাদেশী বলে হেনস্থা করতে শুরু করলো ৷ বাঙালীর অধিকার খর্ব হলো৷ দেশের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্যে রাজ্যে বাঙালীর জন্য বাংলা বিদ্যালয়গুলি ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হলো৷ তাদের ভিন রাজ্যের ভাষা শিখতে বাধ্য করা হলো৷ বাঙলা ভাষা সংস্কৃতির ওপর তীব্র আক্রমণ নেমে এল৷ সরকার নীরব, গোপনে উৎসাহ দিয়ে চলল৷ তারপর জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকে মাধ্যম করে বাঙালী চরম সর্বনাশ করতে প্রস্তুত৷ জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকে শিখণ্ডী করে বাঙালীর নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাঙালীকে অধিকার হীন ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হবে৷ তারপর একদিন হয়তো এই ভাসমান পানা তুলে ফেলা হবে মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের মতো ৷ জাতীয় নাগরিক পঞ্জী যদি জাতীয় স্বার্থে হয় তাহলে কশ্মীর , পঞ্জাব,তামিল সহ সমগ্র ভারতে নয় কেন ? জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর নামে অসহায় দরিদ্র বাঙালীর ওপর নিপীড়ন কেন? সত্যই তো বাঙালী যে আজ অজগরের গ্রাসে৷