একটি ফুলের কুঁড়ি থেকে সুন্দর একটি ফুল ফুটে ওঠে৷ ফুলের সৌন্দর্য নির্ভর করে তার সমস্ত পাপড়ি–গুলির সম্যক বিকাশের ওপর৷ মনে করা যাক, একটি ফুলের তিনটি পাপড়ি৷ এই তিনটি পাপড়ি যদি ঠিকমত ফুটে ওঠে, তবে ফুলটিকে সুন্দর দেখায়৷ তেমনি আমাদের জীবনপুষ্পের তিনটি পাপড়ি–দেহ, মন ও আত্মা৷ এই তিনেব যদি সুষ্ঠু বিকাশ না হয়, তাকে জীবনের সুষ্ঠু বিকাশ বলা চলে না বা তাকে জীবনের প্রকৃত উন্নতি বলা যায় না৷ আর তাই জীবনের যথার্থ উন্নতির জন্যে তথা জীবনকে যথার্থ আনন্দময় করে গড়ে তুলতে হলে দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক–তিনেরই উন্নতি একান্ত প্রয়োজন৷ জীবনের এই ত্রিস্তরীয় উন্নতি সম্পর্কে–আমাদের যথার্থভাবে সচেতন হতে হবে৷ সেজন্যেই আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘We should be physically fit, mentally strong and spritually elevated’’–আমাদের দৈহিক সুস্থতা অর্জন করতে হবে, মানসিক শক্তি অর্জন করতে হবে ও আধ্যাত্মক উন্নতি ঘটাতে হবে৷ যোগসাধনা মানুষের এই ত্রিস্তরীয় উন্নতি ঘটায়৷ প্রকৃতপক্ষে এটাই যোগের বৈশিষ্ট্য৷
দৈহিক সুস্থতা
দৈহিক সুস্থতা মানে বিভিন্ন রোগ থেকে দেহকে মুক্ত রাখা৷ বলা হয়–‘Prevention is the better than cure’’ অর্থাৎ রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা করার চেয়ে রোগের প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণই শ্রেয়৷ বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বাঁধলে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই–দামী দামী ওষুধ খাই৷ বিজ্ঞানীরা বলেন, এই সব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতেও আবার নোতুন নোতুন রোগের সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু নিয়মিত যোগ সাধনা করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন রোগ থেকে দূরে থাকতে পারি৷
আমাদের শরীরে বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি আছে৷ এই অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলি হ’ল পিনিয়্যাল, পিটুইটারী, থাইরয়েড, থাইমাস, এ্যাড্রিন্যাল, গোনাড্স প্রভৃতি৷ এগুলি থেকে রসক্ষরণের(hormone secretion) ওপর শরীরের সুস্থতা ও অসুস্থতা নির্ভর করে৷ যোগাসনের দ্বারা এই রসক্ষরণকে স্বাভাবিক করা যায়–যা শরীরকে সুস্থ রাখে বা সুস্থ করে তোলে৷ বিভিন্ন আসন ও মুদ্রার অভ্যাসের দ্বারা এই সব অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি সহ অন্যান্য গ্রন্থি, স্নায়ুকোষ, স্নায়ু, পেশী ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সুস্থ ও সবল করা হয়৷
তাই যোগাসন ও মুদ্রার সহায়তায় অজীর্ণ, অম্লরোগ, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তচাপ প্রভৃতি বিভিন্ন রোগ–যা সচরাচর আমাদের হয়ে থাকে–তাদের থেকে আমরা সহজে নিরাময় লাভ করতে পারি৷
মানসিক উন্নতি
শুধু শারীরিক সুস্থতা নয়, যোগের দ্বারা মানসিক দুর্বলতা দূর করা, মনকে নিয়ন্ত্রণ করা, মনঃশক্তি অর্জন করা প্রভৃতিও সম্ভব৷
আমরা ভাল–মন্দ যা কিছু কাজ করি, প্রকৃতপক্ষে মনই এই সমস্ত কাজ করে৷ মন যদি ভাল হয়–শুভবুদ্ধিম্পন্ন হয়, তাহলে সমস্ত কাজও ভাল হবে আর মন যদি মন্দ হয়, অর্থাৎ অশুভবুদ্ধিম্পন্ন হয় তাহলে কাজও মন্দ হবে৷ মন মস্তিষ্ক্, সুষুম্নাকাণ্ড, বিভিন্ন গ্রন্থি, স্নায়ুকোষ, সংজ্ঞানাড়ী, আজ্ঞা নাড়ী তথা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে সমস্ত কাজ করে৷
মনের আবার বিভিন্ন বৃত্তি রয়েছে৷ এগুলির সংখ্যা প্রধানতঃ ৫০৷ এগুলি মস্তিষ্কে ও সুষুম্নাকাণ্ডে মধ্যে বিভিন্ন চক্রে(plxus) অবস্থিত বিভিন্ন গ্রন্থিগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়৷ যেমন, লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, লোভ, ক্রোধ, আশা, চিন্তা, চেষ্টা, বুদ্ধি, বোধি প্রভৃতি৷ সাধারণতঃ মানুষের মধ্যে হীন বৃত্তিগুলি প্রবল ও উন্নত বৃত্তিগুলি অস্ফূট থাকে৷ যোগের যম–নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, ধ্যান প্রভৃতি প্রক্রিয়ার অনুশীলনের সাহায্যে বৃত্তিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ বৃত্তিগুলিকে যতই আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো ততই মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পাবে৷ মনের একাগ্রতা যতই বৃদ্ধি পাবে, ততই মনের শক্তিও বৃদ্ধি পাবে৷
বিক্ষিপ্ত সূর্য রশ্মিকে আতশী কাঁচের সাহায্যে কেন্দ্রীভূত করলে যেমন আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি যোগের সাহায্যে মনকে একাগ্র করলে মনের মধ্যে অপরিসীম শক্তির জাগরণ ঘটে৷ এই শক্তিকে শুভপথে লাগালে আমরা জীবনে অনেক বড় কাজ করতে পারি ও সহজেই অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারি৷
যারা পড়াশুণা করে তারা নিয়মিত যোগ অভ্যাস করলে বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হবে ও স্মৃতিশক্তিও বৃদ্ধি পাবে৷
বিশেষ করে আমাদের জীবনধারার প্রতি মূহুর্ত্তে আমরা মানসিক চাপের(mental stress) শিকার হই৷ মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেলে সব সময় মানসিক অশান্তি, খিটখিটে মেজাজ, মাথাধরা প্রভৃতি দেখা দেয়৷ ক্রমাগত এই মানসিক চাপ থেকে গ্যাসট্রিক ডিসর্ডার, টি.বি., হূদ্রোগ প্রভৃতি রোগেরও সৃষ্টি হয়৷ শুধু এই রোগগুলিই নয়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে অধিকাংশ রোগেরই উৎস এই মানসিক চাপ৷ এই মানসিক চাপ থেকে সাময়িক ভাবে রেহাই পেতে মানুষ সাধারণতঃ ধূমপান, মদ্যপান, মাদক দ্রব্য সেবন প্রভৃতি মারাত্মক নেশার দিকে ঝোঁকে৷ আর এর ফলে মানুষ ক্যানসার প্রভৃতি জটিল ও দুরারোগ্য ব্যধির কবলে পড়ে৷
এই মানসিক চাপ থেকে মুক্তিরও একমাত্র উপায় হ’ল নিয়মিত যোগ অভ্যাস৷ বিশ্বের খ্যাতনামা চিকিৎসাবিদরাও এই মত পোষণ করেন৷
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
- Log in to post comments