অসমে  বাঙালীদের  ওপর নির্যাতনের ইতিহাস

লেখক
সাধন পুরকায়স্থ

স্বাধীনতার  প্রাক্ মুহূর্তেই অসম থেকে বাঙালীদের  উৎখাত করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল৷ যার ফলে ১৯৪৭-এর জুূন মাসে গণভোটের নাটক  করে বাঙালী অধ্যুষিত  অসমের  একটি জেলা শ্রীহট্টকে  পাকিস্তানে  ঠেলে দেওয়া  হয়েছিল৷ তার পরবর্তীকালে  লোকগণনার  প্রহসনে ১৯৫১ সালে বাঙালীদের  সংখ্যাতত্ত্বের কারচুপিতে সংখ্যালঘু বানানো হয়েছিল৷ ৫০ সাল থেকে বঙ্গাল খেদা আন্দোলন শুরু হয়েছিল৷ বাঙালীদের হত্যা করা, ঘর বাড়ী জ্বালানোটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা৷ ১৯৬০ সালে একমাত্র অসমীয়া ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷  রাজ্যজুড়ে  আন্দোলন শুরু হলো৷ শিলচরে ১৯৬১-র ১৯শে মে ১১টি তাজা প্রাণ পুলিশের গুলিতে আত্মাহুতি দিয়ে শুধুমাত্র অসমের  বরাক উপতক্যায় বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে৷ অতীতের বাঙ্গাল খেদা আন্দোলন, পরবর্তীকালে বিদেশী খেদাও, বাংলাদেশী খেদাও আন্দোলন সারা অসম ছাত্র সংস্থা (আসু)-র নেতৃত্বে শুরু হলো৷ আবার বাঙালীদের ঘরবাড়ী জ্বললো, নেলীতে গণহত্যা হলো৷ ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাঙালী উৎখাতের আন্দোলন চলাকালে রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে আন্দোলনকারীদের দিল্লিতে ডেকে নিয়ে ১৯৮৫ র ১৫ ই আগষ্ট ‘‘অসম চুক্তি’’ করে লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে  রাষ্ট্রহীন করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করলেন৷ সেই চুক্তি অনুযায়ী নাগরিকত্ত্ব  আইন ১৯৮৫ সালেই সংশোধন হলো৷ ১০০ টি বিদেশী বা দুটি ট্রাইবুন্যাল গঠন করে শুরু হয়েছে বাঙালীদের জেলে পুরে রাখা৷ বর্তমানে ৮০০ শতাধিক লোক ৬টি জেলে বন্দি আছেন৷ বাংলাদেশ সরকার বলছে, সেখান থেকে কোন লোক আসেনি৷ ৬৬ সাল থেকে ৫৭ বছর ধরে দেশভাগের বলি উদ্বস্তুরা অসমে স্থায়ীভাবে বসবাস করে নাগরিকের মর্য্যাদা নেই৷ ৬৬ ও ৭১ ভিত্তি সাল ধরে চলছে হেনস্তা৷

এদিকে আবার  ‘অসম চুক্তি’ অনুযায়ী একমাত্র দেশের মধ্যে অসমেই শুরু হয়েছে নাগরিকপঞ্জী তৈরীর কাজ, ভিত্তি সাল সেই ১৯৬৬৷ উদ্দেশ্য একটাই বাঙালীদের রাষ্ট্রহীন করা৷ যে কাজটা পুলিশ  দিয়ে ও ট্রাইবুন্যালের মাধ্যমে বা আদালতের মাধ্যমে সম্ভব হয় নাই, সেই কাজটি নাগরিকপঞ্জির মাধ্যমে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ তাতে কম করেও  ৫০ লক্ষ বাঙালী রাষ্ট্রহীন হবে৷ এই কাজটি আবার সুপ্রিমকোর্টের  নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে করা হচ্ছে৷ ২০১২ সালে অসমের পাবলিক ওয়ার্কস নামে একটি সংঘটন সুপ্রিমকোর্টে নাগরিক পঞ্জি তৈরীর ব্যাপারে জনস্বার্থ মামলা  করে মামলা নং ২৭৪৷ সুতরাং সুপ্রিমকোর্টেও আইনের দোহাই দিয়ে বলা হচ্ছে এই প্রক্রিয়ার যে বিরোধিতা করবে তারা দেশদ্রোহী৷ তাদের  বিরুদ্ধে আইনী  ব্যবস্থা  নেওয়া  হবে৷ নাগরিকপঞ্জীর খসড়া প্রকাশের কথা ছিল ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্ববরের মধ্যে৷ কেননা এই সময়ের  মধ্যে সম্ভব হবে না৷ রেজিষ্টার জেনারেল  ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সময় চেয়েছেন৷

এদিকে ১০০ টি বিদেশী  বা দুটি ট্রাইবুন্যাল প্রায় দুই লক্ষ বাঙালীদের বিদেশী হিসাবে  ঘোষণা করেছে৷ যখন তখন ধরে ধরে ডিটেনসান ক্যাাম্পের নামে জেলে ঢুকিয়ে  দেওয়া হচ্ছে৷

এই ব্যাপারে রাজনৈতিকদলগুলি নির্বিকার৷ ৭ই সেপ্ঢেম্বর ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যে সব ধর্মীয়  সংখ্যালঘু বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ভারতে  এসে আশ্রয় নিয়েছে৷ তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে  একটি নোটিফিকেশন জারী  করেছেন৷ ২০১৬ সালে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত একটি বিল সংসদে পেশ  করা হয়েছিল কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলের আপত্তিতে বিলটি সংসদীয় কমিটি (সিলেক্ট কমিটি) তে প্রেরণ করা হয়েছিল৷ বর্তমানে বিলটি হিমঘরে পড়ে আছে৷ শাসক দলের  সদিচ্ছা না থাকার ধরুণ  দেশভাগের বলি নাগরিকদের নাগরিকত্ব ঝুলে রইল৷

নাগরিকত্বের ব্যাপারটা মিমাংসা না হওয়ার অসমে বসবাসকারী বাঙালীরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে৷ রেশন কার্ড, জমির দলিল, ব্যাঙ্ক একাউন্ট, চাকুরী ব্যবসা বাণিজ্য, লাইসেন্স পারমিট বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে৷

উল্লেকিত সমস্যা  সমাধান করতে হলে সংসদে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে, নোতুন আইন তৈরী করতে হবে৷ অসম চুক্তির আধারে  নাগরিকত্ব আইনে ৬-এ নামে যে ধারা সংযোজন করা হয়েছে৷  তাহা সংশোধন  করা প্রয়োজন৷ এই আইনের  মাধ্যমেই  ট্রাইবুনাল  ও নাগরিক পঞ্চির  কাজ চলছে৷ অসম চুক্তিতে  অসমীয়াদের চাকুরী,বিধানসভা লোকসভা, স্থানীয় পৌরসভা পঞ্চায়েত, ভাষা সংস্কৃতির  সংরক্ষণের  কথা বলা হয়েছে৷ তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাঙালীদের কোন অধিকার থাকবে না৷ পরিণত হবে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে৷

অসম আন্দোলন চলাকালীন ১৯৭৯ সাল থেকে ‘আমরা বাঙালী’ দল অসমে বসবাসকারী বাঙালীদের সতর্ক করে আসছিল৷ ১৯৮৫ সালে ‘‘অসম চুক্তি’২ স্বাক্ষরের পর থেকে এই অসাংবিধানিক চুক্তি বাতিলের   দাবীতে  আন্দোলন  করে আসছে, কিন্তু  সব রাজনৈতিকদল এই বাংলা চুক্তির সমর্থক ৷ তাই  ঐক্যবদ্ধ বাঙালী আন্দোলন ছাড়া মুক্তির কোন পথ নেই৷  এদিকে আবার সরকার কেন্দ্রকে বলে কয়েক কোম্পানী সামরিক বাহিনী অসমে নিয়ে এসেছেন ৷ যাতে এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালীরা কোন আন্দোলন করতে না পারে৷ অসমে বর্তমানে জরুরী অবস্থার মত পরিস্থিতি চলছে৷ স্বৈরাচারী মনভাব সরকারের বিভিন্ন কর্মে পরিলক্ষিত হচ্ছে৷  উগ্র অসমীয়া জাতিয়তাবাদীদের আন্দোলন জনজীবনকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে৷ হুংকার দেওয়া হচ্ছে অসমীয়াদের প্রভুত্ব মেনে চলতে হবে৷ গত ৬ই মার্চের  ? পাথারে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে অসমীয়া  জাতিয়াতাবাদীদের চাপে উদ্বাস্তু নেতা সুবোধ বিশ্বাসসহ ৫৪জন ? জেলে বিগত ৭ মাস  যাবৎ মিথ্যা অভিযোগ বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন৷ কথায় কথায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর সরকারী দমননীতি চলছে৷

সামগ্রিকভাবে বাঙালী জনজীবন বিপর্যস্ত৷ তাই শুধু অসম নয় দেশব্যাপি তথা আন্তর্জাতিকস্তরে বাঙালীর এই দুঃখ দুর্দশার কথা তুলে ধরা প্রয়োজন৷ রাষ্ট্রসংঘের মানবধিকার কমিশনের কাছে ব্যাপারটি তুলে ধরতে আমরা সচেতন বুদ্ধিজীবিদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি৷