ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বাঙালীরাই ছিল অগ্রগণ্য৷ বাস্তবিক পক্ষে উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই শ্রী অরবিন্দের নেতৃত্বে বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু৷ রবীন্দ্রনাথও তখন এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন৷ ‘‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’’---এই গানটি গেয়ে ব্রিটিশ শোষকদের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ বাংলার অগ্ণিযুগ নামে পরিচিত হয়েছিল সেই সময়টা৷ ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচাকী থেকে শুরু শত শত বাঙালী বিপ্লবী স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মোৎসর্গ করেছিলেন, কেউ ফাঁসীতে ঝুলেছিলেন কেউ প্রত্যক্ষ সংগ্রামে প্রাণ দেন, কেউ বা সারাজীবন দীপান্তরের দণ্ড নিয়ে সমগ্র জীবন দেশমাতৃকার বেদীমূলে আত্মোৎসর্গ করেন৷ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা লাভের দিন পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে ফাঁসীকন্ঠের ঝুলে আত্মোৎসর্গের তালিকায় আছেন ক্ষুদিরাম বসু, কানাইলাল দত্ত, সত্যেনবসু চারুচন্দ্র বসু, বীরেন দত্তগুপ্ত, বসন্ত বিশ্বাস, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন লাহিড়ী, গোপীনাথ সাহা,প্রমোদ চৌধুরী প্রভৃতি থেকে শুরু করে মাষ্টারদা সূর্যসেন, তারকেশ্বর ঘোষ দস্তিদার প্রমুখ শত শত বীরবিপ্লবী৷ ও দিকে পঞ্জাবেও বেশ কিছু ফাঁসীকাঠে আত্মবলি দিয়েছিলেন৷ কিন্তু মুখ্যতঃ এপার বাংলা ও ওপার বাংলার যুবকরাই তো ভারতের স্বাধীনতার জন্যে অকাতরে জীবন বিসর্জন করেছেন৷
অথচ এই বাঙালীরাই নাকি এই ভারতে ‘বিদেশী’ হ্যাঁ অসমের রাজ্যসরকার নূতন নাগরিকপঞ্জী তৈরী করছে, তাতে ১ কোটি ৩৯ লক্ষ বাঙালীর নাম বাদ গেছে৷ মানে ওরা নাকি ভারতের নাগরিক নয়৷ উদ্রপন্থী অসমীয়াদের চাপে বর্তমানে অসমের বিজেপি পরিচালিত সরকার এই নাগরিকপঞ্জী তৈরী করে বাঙালীদের ডিটেনসন ক্যাম্পে নির্র্বসন দিয়ে তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালাবার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে৷ ইতোপূর্বেই হাজার হাজার বাঙালীকে ডিভোটার (সন্দেহজনক ভোটার) সাজিয়ে, তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করে তাদের ওপর নির্র্যতন চলছে৷ স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় ‘বাঙালী খেদাও’ আন্দোলন হয়েছে৷ এইভাবে অসম থেকে বাঙালী বিতাড়ণ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই চলছে৷ এখন ও সেই ষড়যন্ত্র অব্যাহত৷ অসম থেকে যে সমস্ত বাঙালীদের বিতাড়নের চেষ্টা চলছে, ওই বাঙালীদের বেশীরভাগই কিন্তু ওখানকার আদি বাসিন্দা ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯১২ সালে যখন অসম প্রদেশ তৈরী হয়৷ তখন দেখা যায়, অসম প্রদেশের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়৷ কলকাতা পুরসভার বার্ষিক আয়ের চেয়ে নবসৃষ্ট অসমের বার্ষিক আয় কম৷ তাই নবসৃষ্ট রাজ্যের আর্থিক অবস্থা দৃঢ় করবার জন্যে বাঙলার সিলেট, কাছাড় ও উত্তর-পূর্ব-রংপুর জেলা তিনটিকে নহসৃষ্ট অসম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়৷
ইংরেজরা অসমের সঙ্গে যুক্ত করা উত্তর-পূর্ব রংপুর জেলার নাম পরিবর্তন করে তার নূতন নাম দেন গোয়ালপাড়া ৷ পরবর্তীকালে এই জেলাকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয় ১) ধুবড়ি, ২)কোকরাপাড়, ৩) গোয়ালপাড়া৷
তাই অসমের এই সমস্ত এলাকার বাঙালীরাই তো বর্তমান অসমের ভুমিপুত্রই৷ এদের বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অসম সরকার অন্যায়ভাবে বিদেশী তক্মা দিয়ে বিতাড়ণ করবার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে৷
তাছাড়া, স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষ দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের যে সমস্ত বাঙালী ধর্মমতের কারণে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়, তাদের ভারত সরকারই বলেছিল, তাদের জন্যে সবসময় ভারতের দ্বার খোলা থাকবে৷
স্বাধীনতা লাভের সময় বাঙলার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জাব দ্বিধাবিভক্ত হ’ল৷ কিন্তু পশ্চিম পঞ্জাব থেকে আগত সমস্ত পঞ্জাবী উদ্বাস্তুদের দু’বছরের মধ্যেই সমস্তরকম ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়৷ কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, বাঙলার ক্ষেত্রে তা করা হল না৷ নেহেরু লিয়াবৎ চুক্তির মাধ্যমে কেবল প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, বাঙালীরা যে কোনো সময় পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য বলে তাদের এদেশের নাগরিকত্ব সহ সমস্ত সরকারী সাহায্য পেতে কোনো অসুবিধা হবে না৷
কিন্তু বাস্তবে, স্বাধীনতার অব্যহিত পরে যারা ভারতে এলেন, কিংবা তখন যারা ভারত সরকারের আশ্বাসের ওপর ভরসা থেকে দেশত্যাগ করেনি, পরে বাধ্য হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব সহ সমস্ত সরকারী সুবিধা পাওয়ার ন্যায্য অধিকার রয়েছে, কিন্তু বাঙালীদের ক্ষেত্রে কোনো রহস্যজনক কারণে এই ন্যায্য অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে৷ উল্টে অসমে নূতন নাগরিকপঞ্জী তৈরীর নামে ওই উদ্বাস্তু বাঙালীদের ও তৎসহ এখানকার ভুমিপুত্র বাঙালীদেরও বিতাড়ণের তোড়জোড় চলছে৷
বাঙালীদের বিরুদ্ধে এই অন্যায় ও নির্র্যতনের বিরুদ্ধে আজ ভারতের সমস্ত বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে৷
গত ২৭ শে মার্চ দিল্লির প্রেসক্লাবে অসমের নূতন নাগরিকপঞ্জী তৈরীর নামে বাঙালী বিতাড়ণের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল৷ তাতে আমরা বাঙালী সহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল যেমন জাতীয় কংগ্রেস, সিপিএম বিজেপি, সহ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা যোগদান করেছিলেন ও সবাই অসমে বাঙালী নির্র্যতনের তীব্র প্রতিবাদ জানায়৷
এটা খুবই আশার কথা কিন্তু এটা কেবল একদিনের আলোচনাসভার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে রূপ নিক ও সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করুক, যাতে অবিলম্বে বাঙালীদের বিরুদ্ধে সমস্ত ষড়যন্ত্র বন্ধ হয় ও বাঙালীরা ওখানে অন্যান্য সকলের সঙ্গে সমান নাগরিক অধিকার পেতে থাকে৷
- Log in to post comments