কলকাতা ঃ গত ১৯শে নবেম্বর মৌলালী যুবকেন্দ্রে বাঙালী বিদ্বৎ সমাজ কর্তৃক আয়োজিত এক আলোচনাসভায় বর্তমানে সারাদেশে বিশেষ করে উত্তর পূর্র্বঞ্চলের অসম ও মণিপুরে বাঙালীদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তা দারুণ উদ্বেগ প্রকাশ করেন ও এর প্রতিকারকল্পে সমস্ত বাঙালীদের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেন৷ এজন্যে বিভিন্ন সংঘটনের ও বিভিন্নস্থানের বাঙালী নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের এক যৌথ কমিটিও গড়ে তোলা হয়৷
এই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালীর জাতিসত্তা রক্ষার্থে ও অসমসহ বিভিন্নরাজ্যে বাঙালীদের নাগরিকত্ব নিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ’’৷
এই আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন শিলচর থেকে আগত অসমের ‘আমরা বাঙালী’ কেন্দ্রীয় কমিটি’র-সদস্য সাধন পুরকায়স্থ৷ অন্যান্য বিশিষ্ট বক্তাদের মধ্যে ছিলেন অসম থেকে আগত সামাজিক ও মানবধিকার সংঘটনের নেতা বিধায়ক দাস পুরকায়স্থ, ঝাড়খন্ডের বাঙালী নেতা ভেঙ্গু ঠাকুর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিষ্টার নীতীশ বিশ্বাস, মণিপুরের বাঙালী স্টুডেন্ট ইয়ূনিয়নের সভাপতি মাহমুদুল হাসান, শিবপুর দীনবন্ধু কলেজের (হাওড়া) অধ্যক্ষ ডঃ ভাস্কর পুরকায়স্থ, প্রাক্তন অধ্যাপক (নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক মহাবিদ্যালয়) ডঃ গোবিন্দ সরকার, উদ্বাস্তু আন্দোলনের যুবনেতা গোবিন্দ দাস, বাঙালী উদ্বাস্তু সমিতির রাজ্য সম্পাদক সন্দীপ বিশ্বাস, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ভক্ত মতুয়া মহাসংঘের সহ-সম্পাদক মহীতোষ বৈদ্য প্রমুখ৷ এই আলোচনাসভার সঞ্চালক ছিলেন আলোচনার প্রথমপর্বে শুভেন্দু ঘোষ ও দ্বিতীয়পর্বে রক্তিম দাস (সাংবাদিক)৷
আলোচনাসভার শুরুতে স্বাগত ভাষণে আমরা বাঙালীর কেন্দ্রীয় কমিটির সহসচিব তারাপদ বিশ্বাস বলেন, বাঙালীর জাতিসত্তা, নাগরিকত্ব, মাতৃভাষা আজ আক্রান্ত৷ খোদ কলকাতার ৭১ শতাংশ জমি অবাঙালীদের হাতে৷ বাঙালী এখন নিজভূমে পরবাসী৷ বিশেষ করে বর্তমানে অসমে বাঙালীদের ওপর চলছে চরম নির্র্যতন৷ লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে ডি-ভোটার (ডাউটফুল ভোটার) ঘোষণা করা হয়েছে৷ ধরে ধরে বাঙালীদের জেলে ভরা হচ্ছে৷ বাঙালীদের ‘বিদেশী’ বলে তাড়ানো হচ্ছে, ঝাড়খন্ডে বাঙালীদের মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ সর্বত্রই বাঙালীরা নানান্ভাবে নির্যাতীত হচ্ছেন৷
অসমের বাঙালী নেতা সাধন পুরকায়স্থ বলেন, অসমে ১৯৬৬ সালকে ভিত্তিবর্ষ করে নাগরিকপঞ্জী তৈরীর নামে কম করেও ৫০ লক্ষ বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ বাঙালীদের ধরে ধরে ‘বিদেশী তক্মা লাগিয়ে ডিটেনসন ক্যাম্পে ভরা হচ্ছে ও সেখানে চলছে চরম নির্যাতন৷
শ্রী পুরকায়স্থ বলেন সারা ভারত বাঙালী উদ্বাস্তু সমিতির সর্বভারতীয় সভাপতি সুবোধ বিশ্বাস সহ ৫৪ জন সদস্য অসমের শিলাপাথরের ধেমাজিতে অন্যায়ভাবে জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে৷ বাঙালী উদ্বাস্তুদের বিপন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের অনুমতি নিয়ে বাঙালী উদ্বাস্তু সমিতির পক্ষ থেকে ৫টি সভা করার ব্যবস্থা হয়েছিল৷ বাঙালী উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বাঞ্চাল করতে উগ্র অসমীয়াদের অভিযোগে সুবোধ বিশ্বাস সহ ৫৪ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে বনগাঁ থেকে৷ অসমের সর্বত্র বাঙালীরা সুবোধ বিশ্বাসসহ অন্যান্য বন্দী বাঙালীদের মুক্তির দাবী করছেন৷ কিন্তু অসমে এখন অঘোষিত জরুরী অবস্থা চলছে৷ বাঙালীদের যাকে তাকে যখন-তখন গ্রেফতার করা হচ্ছে৷ সাধনবাবু বলেন, আমি এই সভা থেকে এই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি৷ তিনি দলীয় রাজনীতির ঊধের্ব উঠে সর্বভারতীয় বাঙালী মঞ্চ গড়ার ডাক দেন৷
অসম থেকে আগত সামাজিক ও মানবাধিকার সংঘটনের নেতা বিধায়ক দাস পুরকায়স্থ তাঁর বক্তব্যে বলেন, অসমে বাঙালীরা বহুদিন থেকে লাঞ্চিত, বঞ্চিত, শোষিত৷ আমরা এখানে লড়াই করে বেঁচে আছি৷ এখানে বাঙালী হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই অসহায়৷ বহু বাঙালী বাঁচার জন্যে সরকারী নথিতে অসমীয়াকে মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন৷ কিন্তু তাতেও বাঁচতে পারেন নি৷
বিধায়ক দাস পুরকায়স্থ মহাশয় বলেন, অসমের বাঙালীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে, কখনও বাংলাদেশী, কখনও ডি-ভোটার (ডাউটফুল ভোটার), কখনও বিদেশী ইত্যাদি৷
মণিপুরের ছাত্রনেতা মাহাদুল হাসান বলেন, মণিপুরের বিশেষ করে জিরিবামে বাঙালীরাই সংখ্যাগুরু৷ বাঙালীরা এই এলাকার আদি ও স্থায়ী বাসিন্দা৷ কিন্তুমণিপুর সরকার বাঙালীদের বিদেশী নাম দিয়ে তাড়ানোর জন্যে নানান্ভাবে অত্যাচার চালাচ্ছে৷ মণিপুরে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টি করে বাঙালীদের ভাগ করা চেষ্টাও চলছে৷ আমরা এখানে হিন্দু-মুসলমান বিভেদভুলে একজন বাঙালী বিধায়ককে বিধানসভায় পাঠাতে পেরেছি৷ আমরা এখানে বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে ও স্বাধিকারের জন্যে লড়াই করে চলেছি৷
ছাত্রনেতা মাহাুদুল হাসান বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, কোথাও বিহারীদের ওপর অবিচার হলে বিহারের সরকার তার প্রতিবাদ করেন, অথচ মণিপুরে বাঙালীদের ওপর নানান্ভাবে নির্র্যতন হলেও পশ্চিমবঙ্গের সরকার কোনো প্রতিবাদ করছেন না৷
ঝাড়খন্ডের বাঙালী নেতা ভেঙ্গু ঠাকুর বলেন, ঝাড়খন্ডে আদিকাল থেকে বাংলা পড়ানো হত৷ কিন্তু যেদিন ঝাড়খন্ড তৈরী হ’ল সেদিন থেকে বাংলা পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ বাঙালীদের মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে তিনি জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলবার আহ্বান জানান৷
উদ্বাস্তু আন্দোলনের যুবনেতা গোবিন্দ দাস, বাঙালী উদ্বাস্তু-সমন্বয় সমিতির রাজ্য সম্পাদক সন্দীপ বিশ্বাস হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ভক্ত মতুয়া মহাসংঘের সহ সম্পাদক মহীতোষ বৈদ্য প্রমুখও অসমে বাঙালী উদ্বাস্তু নেতা সুবোধ বিশ্বাস ও জেলে বন্দী অন্যান্য সমস্ত বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধভাবে সামিল হওয়ার আহ্বান জানান৷
ডঃ গোবিন্দ সরকার ও তাঁর জ্ঞানগর্ভ ভাষণে কিভাবে প:বঙ্গ সহ সর্বত্র বাংলা ও বাঙালীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে , তার উল্লেখ করেন৷ তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গেও বাংলা ভাষা তার মর্যাদা পাচ্ছে না৷ তিনি বলেন, ১৯৭৮ সালে এ রাজ্যেই কলেজগুলিতে বাংলাকে আবশ্যিক ঐচ্ছিক হিসেবে সিলেবাসে স্থান দেওয়া হয়৷ একদিকে বলা হচ্ছে আবশ্যিক আবার বলা হচ্ছে ঐচ্ছিক মানে পড়ানো হবে কিন্তু পাশ জরুরী নয়৷ তাই বাংলা পড়ার কারুরই আগ্রহ নেই৷ তিনি বলেন, বামফ্রন্ট আমলে পবিত্র সরকারকে দিয়ে বাংলা বানান্ সংস্কারের নামে প্রহসন করা হয়েছে ও সবাইকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে৷ তিনি মরিচঝাঁপিতেও কীভাবে বাঙালী উদ্বাস্তুদের ওপর বামফ্রন্ট সরকার অত্যাচার চালিয়েছে তাও বর্ণনা করেন৷ দার্জিলিংকে পশ্চিমে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্রেরও তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন৷
সভাশেষে অসম, মণিপুর, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গসহ সারা দেশে বাংলা ও বাঙালীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের প্রতিবাদে তথা বাংলাভাষণ, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালীর জাতিসত্তা রক্ষার্থে ও অসমসহ বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালীদের নাগরিকত্ত্ব নিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে বিভিন্ন বাঙালী বিশিষ্ট প্রতিনিধি, বিভিন্ন বাঙালী সংঘটন ও বিভিন্ন রাজ্যের বাঙালী প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি যৌথ কমিটিও তৈরী করা হয়৷ এই কমিটির আয়োজক হলেন ‘‘আমরা বাঙালী’’র কেন্দ্রীয় কমিটির সহসচিব তারাপদ বিশ্বাস ও বিশিষ্ট সাংবাদিক রক্তিম দাস৷
অনুষ্ঠানের প্রভাত সঙ্গীত ও অন্যান্য সঙ্গীত পরিবেশন করে’ এদিনের আলোচনার সঙ্গে সুন্দর সাযুজ্য স্থাপন করেন সঙ্গীতা ঘোষ ও সুরশ্রী মাইতি৷ সমগ্র অনুষ্ঠানটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও দেখাশোণা করেন আমরা বাঙালীর কেন্দ্রীয় সচিব বকুলচন্দ্র রায় ও বাঙালী বিদ্বৎ সমাজের সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সেন৷