গত ১লা বৈশাখ বাঙলা নববর্ষের দিনে শ্রদ্ধেয় প্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘বাঙলা ও বাঙালী’ পুস্তকের ‘বাঙলার নববর্ষ’ প্রবন্ধটি (৪ঠা এপ্রিল ১৯৮০ প্রদত্ত) পড়তে পড়তে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল৷ অনেক মূল্যবান কথা বলার পর শেষের দিকে তিনি বলেছেন---‘‘আজ নতুন করে শপথ নিতে হবে---এই নতুন বছরটা তারা কীভাবে সফল করে তুলবে, নিজেদের অস্তিত্বকে কীভাবে আরও প্রাণবান, প্রাণোচ্ছল করে তুলবে, তার কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে৷’’ সত্যি তো বাঙালী জনগোষ্ঠী কত প্রাচীন৷ এর এক উজ্জ্বল ঐতিহাসিকতা রয়েছে, অনেকগুলি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যবান বাঙালী---নিজস্ব ভাষা, উচ্চারণ রীতি, লিপি, নিজস্ব পোষাক ও পোষাক পড়ার পদ্ধতি, নিজস্ব দায়াধিকার ব্যবস্থা, নিজস্ব পঞ্জিকা ইত্যাদি কত কিছু৷ এতগুলি বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর আর কোনও জনগোষ্ঠীর নেই৷ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙলার বীর ও দামাল ছেলে-মেয়েরা যেভাবে গর্জে উঠেছিল, ব্রিটিশকে যেভাবে নেস্তনাবুদ করেছিল বাঙলার মহানায়ক সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ও প্রেরণায় ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধের যে রণ দামামা বেজে উঠেছিল, আর তা সমগ্র ভারতবর্ষকে যেভাবে উত্তাল করে তুলেছিল, সেই উজ্জ্বলতর ইতিহাস হাজার চেষ্টা করেও মুছে ফেলা যাবে না৷ এতগুলি কারণের জন্যেই বাঙলা বারে বারে বঞ্চণা ও অবদমনের শিকার হয়েছে৷ শোষকগোষ্ঠীর চক্রান্তেই আজ বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমি নেই, তাকে খণ্ডিত-বিখণ্ডিত করে রাখা হয়েছে৷ কিন্তু এত সব সত্ত্বেও বাঙালী ফুরিয়ে যায়নি, তাঁর অন্তর্নিহিত, অদম্য প্রাণশক্তিতে এখনও ভরপুর৷
ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে ভেসে উঠল যে আজ বাঙলা ও বাঙালীর সামনে এক বড় বিপদ সমুপস্থিত৷ কিন্তু অমি মনে করি, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এই বিপদ আসলে অভিশাপের আড়ালে আশীর্বাদস্বরূপ---বাঙালী মিলিতভাবে এই বিপদে মোকাবিলা করতে সক্ষম, সেই সঙ্গে সমগ্র ভারতকে এই ব্যাপারে পথ দেখাতে সক্ষম, কেননা এই বিপদ ভারতেরও৷ এখন দেখা যাক এই বিপদটা কী? এর স্বরূপ কী ও এর সমাধানের দিশা নির্দেশই বা কী?
আজ ধর্মমত অর্থাৎ রেলিজন ভিত্তিক হিন্দু রাষ্ট্রীয়তাবাদ উগ্রভাবে বাঙলা তথা ভারতের বুকে চেপে বসতে চাইছে৷ পৃথিবীতে যতগুলি রেলিজন আছে তাদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে তা সবসময় জোর করে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ইতিহাস৷ সেই জন্যে সেই ইতিহাস অনিবার্যবাবে রক্তাক্ত, হিংসা-দীর্ণ, বিদ্বেষপূর্ণ, কণ্ঠরোধ ও নির্মমতায় কলুষিত৷ প্রতিটি রেলিজন এই ব্যাপারে সমান, কোথাও কোথাও হয়তো একটু ঊনিশ-বিশ আছে এইমাত্র৷ আর, এই সামূহিকভাবে প্রবল প্রতাপান্বিত শক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে এই রাজ্যের বর্তমান শাসক দল ও ভারতের অন্যান্য বিরোধী দলগুলি যেভাবে পদে পদে নিজেদের দুর্বলতা, দ্বিধাপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে ফেলেছে, তাতে যাদের বিরোধীতা করা হচ্ছে---তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তাদের বেশী করে সুবিধা হচ্ছে৷ আজ ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে বিশেষ একটি সম্প্রদায়কে শোষণ করার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে তাতে তাদের নিজেদের পায়ের তলাতেই তো মাটি সরে গিয়েছে৷ আমি নিজেই যদি জাত-পাত আর সাম্প্রদায়িক তোষণ নীতিকে আঁকড়ে থাকি, আর এই অবস্থায় অন্য একটি সংকীর্ণতাবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে সম্প্রদায়বাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণ মেরুকরণের রাজনীতি হচ্ছে বলে যতই গালিগালাজ আর চিৎকার করছি---ততই মানুষের সামনে নিজেদের নীতিহীনতা, দুর্বলতা বৌদ্ধিক দেউলিয়াপনা, অন্তঃসার- শূন্যতা প্রকাশ করে ফেলছি৷ তাই কেন্দ্রের শাসক দল ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের সামনে এক ধরণের ফাঁকা মাঠ৷ কোনও চ্যালেঞ্জ নেই---কেননা বিরোধীরা ছত্রছাড়া, তাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার লেশমাত্র চিহ্ণ নেই৷ আর এই সুযোগে তারা খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা রচনা করে, সুচতুর কৌশলে নানা ঘুঁটি সাজাচ্ছে, এক একটি বাজিমাত করছে, দ্বিগুণ উৎসাহে তাদের (কু)নীতিগুলিকে বিভিন্ন মোড়কে রূপায়িত করছে৷ বিপদটা ঠিক এইখানেই৷
কিন্তু কথায় বলে, যেমন বুনো ওল---তেমনই বাঘা তেঁতুল৷ বর্তমানে বাঙলা তথা ভারতে ধর্মমতগত যে হিন্দু রাষ্ট্রীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে তাকে প্রতিহত করার একমাত্র পন্থা হচ্ছে, বাঙালী জাতিসত্তাগত চেতনাকে জাগিয়ে তোলা, তাকে সংহত করা ও তার ভিত্তিতে সংঘবদ্ধভাবে--- ফলপ্রসূভাবে এই চ্যালেঞ্জের মুকাবিলা করা৷ ‘আমরা বাঙালী, বাঙালীস্তান আমাদের বাসভূমি, আমাদের এক গৌরবময় অতীত ও আলোকোজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে, আর আছে ভাবপ্রবণতাগত উত্তরাধিকার--- সেণ্টিমেণ্টাল লিগ্যাসি তথা আবেগ বাঙালীর মজ্জাগত, আর এটাই বাঙালীদের মধ্যে বিপ্লবী মানসিকতার জন্ম দিয়েছে৷ এই বৈপ্লবিক অদম্য মানসিকতা অতীতে অনেক বড় বড় পরীক্ষায় বাঙালীকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে, আর বর্তমানে ও ভবিষ্যতেও তা দেবে’---এই যে জাতিসত্তাগত এক উদ্দীপ্ত ও বলদৃপ্ত চেতনা, এটাই বাঙালী চেতনা৷ এই চেতনা হয়ত এখন সুপ্ত আছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু ঘুমন্ত আগ্ণেয়গিরি যেমন একসময় অগ্ণিস্ফূলিঙ্গ উদ্গীরণ করতে করতে স্বমহিমায় জেগে ওঠে, তেমনি এই বাঙালী চেতনা যে কোনও সময় চাগিয়ে উঠবেই৷
শুধু বাঙালী জাতিসত্তাগত চেতনাই বা বলি কেন, একই চেতনা জাগরুক আছে ভোজপুরী জনগোষ্ঠীর মধ্যে, অঙ্গিকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে, মৈথিলি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে, বীরত্বব্যঞ্জক মারাঠি চেতনা, তামিল চেতনা, তেলেঙ্গানা-ছত্তিশগড় ইত্যাদি সমগ্র ভারতবর্ষের ৪৪টি প্রাউটিষ্ট সমাজের মধ্যে৷ ‘সমাজ হচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করার এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন৷ আজ নানাভাবে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে বিভ্রান্তিমূলক প্রয়াসের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু একে কোনভাবেই দাবিয়ে রাখা যাবে না৷
বাঙালী জাতিসত্তাগত চেতনা বা অন্যান্য জনগোষ্ঠীগত চেতনার হাতে এক শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে প্রাউটের সুদৃঢ় অর্থব্যবস্থা---যা অন্য কারো মধ্যেই নেই৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের এই রাজ্যে বর্তমান সরকার হয়তো পরিকল্পনা ঘোষণা করল যে এক বিশেষ শ্রেণীর প্রত্যেককে একটি করে সাইকেল দেবে৷ তেমনই কেন্দ্রের শাসকদল হয়ত সমাজের এক বিশেষ শ্রেণীর প্রত্যেককে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার সগর্ব ঘোষণা করল৷ কিন্তু প্রাউটিষ্ট অর্থ-ব্যবস্থা বলবে, কেন আমি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকব? আমরা গোড়া থেকেই শুরু করব এমনভাবে যাতে জল-স্থল-অন্তরীক্ষ তোলপাড় করে জাগতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে ব্যষ্টিগত ও সামূহিকভাবে বিশ্বে যত সম্পদ নিহিত আছে সকলের স্বার্থে তাদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করা যায়, তৎসহ তাদের বিচারসম্মত বণ্টনের ব্যবস্থা করা যায়৷ এই জন্যে সচল উন্নয়নমূলক ও ক্রয়ক্ষমতাভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রবর্ত্তন করার রসদ প্রাউটিষ্টদের কাছে আছে৷
তাই অযথা কালক্ষেপ করা বা হা-হুতাশ করার সময় এটা নয়৷ আজ নতুন বঙ্গাব্দে এটাই শপথ নিতে হবে---‘আমরা করব, আমরাই পারব, কেননা প্রাউটিষ্ট হিসেবে আমাদের আছে অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে এক অবর্থভাবের ফলপ্রসূ অর্থ ব্যবস্থা৷ আজকের বাঙলা,ভারত বা বিশ্বের কোনও রাজনৈতিক দল বা সরকার বা সংঘটন---কারোর কাছে কোনও ফলপ্রসূ সুনির্দিষ্ট অর্থনীতি নেই৷ তাই তারা যা করতে পারে বা করে থাকে তা হচ্ছে ডোল দেওয়া বা পাইয়ে দেওয়া ও তা নিয়ে ভোট ব্যাঙ্ক তৈরী করার কদর্য রাজনীতি৷ এখানেই তাদের দুর্বলতা, এখানেই তাদের নিশ্চিত পরাজয়৷ বাঙলা তথা ভারত তথা বিশ্বের প্রতিটি রাজনৈতিক---সাস্কৃতিক দল বা সংঘটন---এরা প্রত্যেকেই পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন বা মানস-অর্থনৈতিক শোষণ-তত্ত্বের হর্তা-কর্ত্তা-বিধাতাদের ধবজাধারী বা কোন না কোনভাবে তাদের কাছে বিক্রীত৷ অন্যদিকে ‘সমাজ’-কেন্দ্রিক প্রাউটিষ্ট অর্থব্যবস্থার এক অন্যতম দিক হচ্ছে---বিরামহীন বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা৷ তাই অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না যে, প্রাউটের সমাজভিত্তিক সামাজিক-অর্থনৈতিক আন্দোলন বা জাতিসত্তাগত আন্দোলনের সঙ্গে সামান্যতম সংকীর্ণতা সংযুক্ত আছে৷
তাই প্রয়োজন হচ্ছে এক নেতৃত্বের৷ বাঙালী জাতিসত্তাগত চেতনার নেতৃত্বে বাঙলা তথা ভারত ও বিশ্ব জুড়ে এক সংরচনাগত সংস্থিতি সুসংহত করা৷ এটা হয়ে গেলেই বা হতে থাকলেই বর্তমানের বিপদ বা ভবিষ্যতের কোন বিপদ শুধু প্রতিহতই হবে না, এসব স্তব্ধ হয়ে যাবে৷
- Log in to post comments