পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে বামফ্রন্টের শাসন চলছিল৷ বলা চলে সেটা এক দুঃস্বপ্ণের মত৷ তখন বামফ্রন্টের হার্র্মদরা বিরোধীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যেত৷ খুন, জখম, অগ্ণিসংযোগ --- সব অস্ত্রই তারা প্রয়োগ করত যাঁরা তাঁদের সঙ্গে একমত নন--- তাঁদের ওপর৷ সেই চরম সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ রাজ্যে বিরাট পরিবর্তন এনেছেন৷ অবশ্য এ রাজ্যে বামফ্রন্টের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে তৈরী হওয়া ব্যাপক ক্ষোভকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন৷ যাই হোক, মমতার এ কাজ প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই৷ মমতার মধ্যে অদম্য কর্মনিষ্ঠা, সেবার মনোভাব তাঁকে রাজ্যজুড়ে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তাও এনে দিয়েছে৷ কিন্তু এটা সত্য কথা, তাঁর সঙ্গে যে ক্যাডার তিনি পেয়েছেন, তাঁরা সবাই অন্য পার্টি থেকে আগত৷ কেউ কংগ্রেস কেউ বা বামফ্রন্ট থেকে৷ বিভিন্ন ধরণের তাদের মানসিকতা৷ তাই তাঁর ক্যাডারদের মধ্যে পদ ও আর্থিক স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্বও প্রায়শই চোখে পড়ছে৷
মমতার নিজস্ব কোনো মৌলিক সামাজিক- অর্থনৈতিক আদর্শ নেই, কংগ্রেসের চিরাচরিত গান্ধীবাদই তাঁর একমাত্র অবলম্বন৷ আর এই গান্ধীবাদ ধণতান্ত্রিক অর্থনীতিরই সমর্থক৷ কংগ্রেসের আদর্শের সঙ্গে অনেক সময় গণতান্ত্রিক সমাজবাদ কথাটা জোড়া হলেও কার্যতঃ সমাজবাদের ছিটে ফোঁটাও তাতে নেই৷ তাই মমতা আদ্যন্ত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থারই সমর্থক৷ স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশদের অর্থব্যবস্থা ও স্বাধীনতার পর এ দেশের কংগ্রেসের গৃহীত অর্থব্যবস্থা--- দুই ই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা৷ পুঁজিপতিরা এক্ষেত্রে তাঁদের মুনাফা লুন্ঠনের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে অর্থ বিনিয়োগ করে ও বিরাট বিরাট শিল্প-বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলে৷ ব্রিটিশ আমলে ও তারপর পুঁজিপতিরা এ রাজ্যে তথা এদেশে অনেক বিশাল বিশাল কলকারখানা বানিয়েছে, বড় বড় বাণিজ্যকেন্দ্রও খুলেছে৷ সবগুলির লক্ষ্য ছিল বৃহৎ অঙ্কের মুনাফা অর্জন৷ পরে যখনই তারা দেখেছে তাঁরা তাদের মনোমত মুনাফা পাচ্ছেনা, তখনই তারা তাদের শিল্প-বাণিজ্য কেন্দ্র বন্ধ করে’ অন্যত্র লগ্ণী সরিয়েছে৷ এর ফলে বহু কলকারখানায় তালা ঝুলছে, বহু চা-বাগান বন্ধ হয়েছে৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়েছে, কর্মচ্যুত লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে৷
কৃষিক্ষেত্রেও নীলচাষের প্রবর্তনের পেছনে একই নীতি কাজ করেছে৷ চাষীদের অর্থের লোভ দেখিয়ে তাদের নীল চাষ করতে বাধ্য করা হয়েছিল৷ পরবর্তীকালে চাষীদের দুরবস্থার কথা ও অত্যাচারের ঘটনাও কারুর অজানা নয়৷
শুধু এ রাজ্যে বা এদেশে নয়, আমেরিকার মত শীর্ষ স্থানীয় ধনতান্ত্রিক দেশেও বেকার সমস্যা এখনও বৃহৎ সমস্যা৷ তাই বড় বড় পুঁজিপতিরা টাকা ঢাললেই যে বেকার সমস্যার সমাধান হবে, এসবই মিথ্যা৷
শিল্প প্রধানত দুই ধরনের৷ একটা শ্রম-নিবিড় (লেবার ইনটেনসিব) ও অন্যটি হ’ল মূলধন-নিবিড় (ক্যাপিট্যাল ইনটেন্সিব)৷
শ্রমনিবিড় শিল্পের বৈশিষ্ট্য কম বিনিয়োগ বেশী কর্মসংস্থান৷ আর ক্যাপিটাল ইনটেনসিব শিল্পের বৈশিষ্ট্য বিপুল পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ ও অত্যল্প কর্মসংস্থান৷ এক্ষেত্রে সবসময় সর্র্বধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হওয়ায় যন্ত্রই অধিকাংশ কাজ করে, মানুষ লাগে কম৷ বড় বড় শিল্পপতিরা দ্বিতীয় প্রকার শিল্প গড়তেই বেশি আগ্রহী৷ তাতে বিনিয়োগ বেশি,কিন্তু কর্মসংস্থান সামান্য৷
এ রাজ্যে বা এদেশে যেহেতু ভয়াবহ বেকার সমস্যা--- তাই এই এলাকায় প্রথম পর্র্যয়ের শিল্পই গড়ে তোলা কাম্য, যাতে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান হয় ও বেকার-সমস্যার সমাধান হয়৷
পুঁজিপতিদের দ্বারা এই প্রয়োজন মিটবে না৷ তাই পুঁজিপতিদের পুঁজি বিনিয়োগ বেকার সমস্যার সমাধান নয়৷ তা যদি হোত, তাহলে স্বাধীনতার আগেই বা ঠিক পরেই বেকার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত কিন্তু তা হয় নি৷ বেকার সমস্যা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে৷
তাহলে পথ কী? মুনাফা ভিত্তিক নয়, একমাত্র প্রয়োজন ভিত্তিক ব্যাপক সমবায়ই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান৷
৪থ বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনে দেশী, বিদেশী বাঘা বাঘা শিল্পপতিরা যোগ দিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাষায় তাঁদের আহ্বান জানিয়েছেন ‘এসো এসো, আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে’৷ মুখ্যমন্ত্রীর আর্জি ‘আপনারা না এলে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবো না৷ এটা আপনাদেরই বাড়ী’৷
প্রতুত্তরে মুকেশ আম্বানি, লক্ষ্মী মিত্তাল, সজ্জন জিন্দাল, উদয় কেটাক, কিশোর বিয়ানি, সঞ্জীব গোয়েঙ্কা, আলোক লোহিয়া, অজয় সিং, হীরা নাদানি প্রমুখ শিল্পপতি মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন৷ তাঁরা এ রাজ্যে বিনিয়োগের উৎসাহ দেখিয়েছেন, মুকেশ আম্বানি তো বলেই ফেললেন, ‘ওয়েষ্ট বেঙ্গল ইজ বেষ্ট বেঙ্গল’৷
কিন্তু এই পুঁজিপতিরা তো আত্মস্বার্থবাদী, তা কে না জানেন৷ বহু প্রচারিত সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল, রিলায়েন্সের মালিক মুকেশ আম্বানির মুম্বাই-এ (৪জনের জন্যে) ২৭ তলা বিশিষ্ট একটি বাড়ী রয়েছে৷ এর ছাদে ৩টি হেলিকপ্ঢার নামার জন্যে ‘হেলিপ্যাড’ রয়েছে৷ এর নীচের তলাতে ১৬০টি গাড়ী রাখার ব্যবস্থা আছে৷ কী নেই সেই বাড়ীতে? আছে সিনেমা হল, নাচের ঘর, একাধিক ঝুলন্ত বাগান কত কিছু৷ আর তার চারপাশে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ ঝুপড়িতে বা খোলা আকাশের তলায় বাস করে৷ এই এদের মানবদরদ! এই এদের সেবাভাব! আর এঁদের ওপর নির্ভর করে মমতা রাজ্যের গরীব ও বেকার মানুষদের দুঃখ দূর করার স্বপ্ণ দেখছেন !
দিদি, এটা স্বপ্ণ নয়, দুঃস্বপ্ণ৷ এঁদের দয়ায় কোনদিন কোনোকালে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না৷
- Log in to post comments