বর্ষণেও আসন ?

লেখক
আচার্য সর্র্বত্মানন্দ অবধূত

খবরে প্রকাশ যে সদ্যসমাপ্ত আন্তর্র্জতিক যোগদিবসে (২১জুন) লক্ষ্ণৌ শহরে বিশাল জায়গা জুড়ে খোলা হাওয়ার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী  সহ  এক বিশাল সংখ্যক  মানুষ যখন আসন  অভ্যাস  করছিলেন, তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়৷ বর্ষণের মধ্যেও আসন চলতে থাকে৷  এই খবরে সম্ভবত: ইঙ্গিতটা  এই ছিল যে বর্ষণ সত্ত্বেও সমবেত আসন প্রদর্শন বন্ধ হয়নি ও এটা একটা বিশেষ কৃতিত্বের ব্যাপার৷ কিন্তু  প্রকৃত সত্যটা হচ্ছে এই যে, এই ধরণের আসনাভ্যাস  আসন ইত্যাদির  ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত  করার জন্যে আদর্শ বিজ্ঞাপন নয়৷ কারণগুলি নিম্নরূপ ঃ

১) প্রথম কথা হচ্ছে আসন-অভ্যাসকারীকে অবশ্যই কতকগুলি নিয়ম মেনে  চলতে হয় আর সেগুলি না মানলে আসন করে  কোন উপকার তো পাওয়াই যায না, বরং তা স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক  হয়ে ওঠে৷ আসন অভ্যাস সম্পর্কে প্রাথমিক  নিয়ম হচ্ছে,আসন অভ্যাস করতে হয় ঘরের মধ্যে , বড় হলঘরে  বা ঘেরা জায়গায়চলবে, যেখানে  হাওয়া আসনাভ্যাসের সময় সরাসরি শরীরে লাগবে না ৷

আসন করার সময় শরীরের গ্রন্থি-উপগ্রন্থিগুলির মুখ খুলে যায় ও তা থেকে হরমোন রসক্ষরণ হয় ও তা রোমকূপের ছিদ্র দিয়ে চামড়ার ওপরে বেরিয়ে আসে বাইরে বেরিয়ে এসে তা কিছুটা তৈলাক্ত পদার্থের মত হয়ে থাকে৷  তাই আসনের আরো একটি নিয়ম হচ্ছে,  আসনের পর সমস্ত অঙ্গে ও অংশে  বিজ্ঞানসম্মত  বিধিতে ম্যাসাজ করতে হয়৷ ম্যাসাজ করার সময় চামড়ার ওপর লেগে থাকা ওই হরমোন-রস চামড়ার সঙ্গে সুন্দরভাবে মিলে মিশে যায়৷ এরফলে চামড়ার উজ্বল্য  বাড়ে, আর একটু বেশি বয়সেও চামড়া কঁুচকিয়ে যায় না৷ ম্যাসাজ করার পরে শবাসন  করতে হয় আর তারপর যদি বাইরে যেতেই হয় তাহলে পোষাক  পরে নিতে  হয়  বা পাতলা আলোয়ান বা এমন কিছু গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বাইরে আসতে হয়৷   বাইরে আসার ঠিক আগে  ঘরে থাকাকালীন সময়ে গভীর শ্বাস  নিয়ে  বাইরে  এসে শ্বাস ছাড়তে হয়৷  এর কারণ  আসন করার ফলে শরীরের তাপমাত্রার পরিবর্তন  হয়৷ তাই ঘরের ভেতররে ও বাইরের তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য  থাকে৷ এমতাবস্থায় হঠাৎ করে যাতে ঠান্ডা  না লেগে যায়  বা  শরীর যাতে  কোন  ধাক্কা সইতে  না হয়, সেই জন্যে বাইরের সঙ্গে শরীরকে এইভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে নিতে হয়৷ এর অন্যথা করা  যায়  না৷  অর্র্থৎ বাইরের খোলা হাওয়ায় আসন করা   নিষিদ্ধ৷

২) দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, উপরি-উক্ত কারণগুলি তো আছেই, তার সঙ্গে আরও একটি বড় ব্যাপার হচ্ছে, আসণ করার সময় শরীরের গ্রন্থি-উপগ্রন্থি  সহ সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ, পেশী, টিসু, শিরা-উপশিরা  ও স্নায়ুতন্ত্র---এসব কিছুর ব্যায়াম হয়ে যায় ও তারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়৷ আসন শেষ হলে সমগ্র শরীর, বিশেষ করে  সন্ধিস্থলগুলি joint) ভাল করে ম্যাসাজ করে, শবাসন করে নিয়ে অন্ততঃ দশ মিনিট পরে জলের সংস্পর্শে আসতে  হয়৷ না হলে শরীরের ক্ষতি হয়ে যায়৷  এইসব নিয়ম বিধির তোয়াক্কা না  করে, প্রথম থেকেই জল গায়ে পড়ছে, কাপড়-জামা ভিজে যাচ্ছে (হবেই তো, এই সময় তো বর্র্ষকাল) আর আমি কর্তব্য-কর্মের স্পিরিট দেখানোর জন্যে  ভিজতে ভিজতেই আসন চালিয়ে যাচ্ছি৷ এটা নিজের  ও অন্যের সর্বনাশ করা ছাড়া আর কী বলা যায়! আসন তো আর ফুটবল ক্রিকেটের মত আউটডোর গেমস্ নয় যে বৃষ্টির মধ্যেও দিবিব খেলা চলছে সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খেলা শেষ করতে হয়, আর এসব খেলার অঙ্গ৷ আরে, প্রদর্শনের বাহাদুরি দেখানো বা জনতার হাততালি কুড়নো আর জনপ্রিয়তা বাড়ানোই যদি মূল উদ্দেশ্য হয় তা তো বড় অডিটোরিয়ামেই সিদ্ধ হতে পারে৷ মন্ত্রী-সান্ত্রীর ব্যাপার, আজকাল মিডিয়া এত সজাগ যে সেখানে তারা অতি অবশ্যই পৌঁছে যাবে, আর বিশেষ মুহূর্তের  ছবি সেকেন্ডের মধ্যে সারা দেশে-বিদেশে  ভাইর্যাল হয়ে যাবে৷

গত বছর দিল্লীতে এই যোগদিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী সহ মান্যগণ্য লোকেরা আর হাজার হাজার মানুষ আসন প্রদর্শন করেছিলেন৷ তারমধ্যে একটি আসন অর্র্থৎ ভস্ত্রিকাসন বা পবনমুক্তাসন করা অবস্থার ছবি সব পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল৷ তাতে  দুই পা বুকের ওপর এনে দুই হাত দিয়ে পা কাপটি করে জড়িয়ে ধরা হয়েছিল ঠিকই (ভস্ত্রিকাসনের সম্পূর্ণ বিধি স্থানাভাবে উল্লেখ করছি না৷) কিন্তু মাথা ওপরের দিকে ওঠানো ৷ একী, এতো সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি! ভস্ত্রিকাসনে মাথা সবসময় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শোয়ানো অবস্থাতেই থাকবে৷ তা না মেনে একধরণের জোর করে মাথা ওঠাতে গেলে (যা কখনই করা  উচিত নয়) বা উঠিয়ে রাখলে ঘাড়ের পেশীতে বা শিরাতে চোট লাগার সমূহ সম্ভাবনা ৷ এতে উপকারের চেয়ে অপকার তো হবেই  অধিকন্তু  এতে কোন রোগও হয়ে যেতে পারে৷ অথচ এই ত্রুটিপূর্ণ আসন করা সারা দেশ দেখল ও সেটাই শিখল৷

আসলে শব্দটা কেবল ‘আসন’ নয়, যোগাসন অর্র্থৎ যোগাসন সবসময় মানস-শারীরিক (শুধু শারীরিক নয়) অধিকন্তু যোগাসন  যোগ সাধনার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি অভ্যাস৷ আর আসন সহ সমগ্র যোগাভ্যাস এক উচ্চস্তরীয় ব্যাপার, অথচ এটা সকলেই করতে পারেন ও  প্রাত্যহিক জীবনে সকলের অবশ্যই  করা উচিত৷  কিন্তু এইজন্যে অভিজ্ঞ আচার্য-আচার্যার কাছ থেকে  শিখে নিয়ে, নিয়ম-বিধি জেনে ও মেনে নিয়ে যোগাসন অভ্যাস করতে হয়৷ তা না করে বই পড়ে বা তথাকথিত কোন ‘যোগশিক্ষকের’ কাছ থেকে ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি জেনে আসন করা মূর্খতারই  নামান্তর নয় কি?

মনে রাখতে হবে, আসন কোন সার্কাসের শো নয় বা ‘ফান’ Fun) বা ফ্যাসনের(Fashion)’ মাধ্যম নয়, যা আজকাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত৷