বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ শিক্ষার স্বাধিকারকে ক্ষুন্ন করছে

লেখক
প্রভাত খাঁ

 

 

শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে  এমন এক বিপর্যয় নেমে এসেছে যার ফলে সকলের  বিশেষ করে  অভিভাবক  ও অভিভাবিকা  ও ছাত্রছাত্রাদের  মনে এসে গেছে এক আশঙ্কা ৷ শিক্ষাব্যবস্থা সুপ্রাচীনকাল থেকে  প্রায় সব দেশেই আছে৷ আমাদের  দেশে  ইংরেজ আমল  থেকে যে নোতুন ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে সেই পদ্ধতিকে আমরা মেনে  চলেছি প্রায় অদ্যাবধি৷ বিদেশী শাসকদের  দেশ শাসনে  প্রয়োজন  ছিল  কেরাণী কুলের, যারা কিছুটা  ইংরাজীতে পোক্ত হবে৷  তাই পরবর্ত্তীকালে বলা হতো শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজ আমলে কেরাণী তৈরীর কারখানা৷  শৈশবে  ছেলেরা প্রাথমিক স্কুলে পড়াশুণা  করতো, তারপর হাইস্কুলে, পরে  কলেজে পড়তো বিশেষ করে ইংরেজী, বাংলা, ইতিহাস, অঙ্ক, ভূগোল, সংস্কৃত ইত্যাদি বিষয়  নিয়ে৷  বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার ক্ষেত্র  ছিল  খুবই সীমিত ৷  ধীরে ধীরে  কমার্স বিভাগে পঠন পাঠন  চালু হয়৷

মোট প্রাথমিকে ৪বছর, মাধ্যমিকে  ৬ বছর, কলেজে ৪ বছর মোট ১৪ বছর  পড়তে  হতো৷  তারপর ছাত্ররা গ্রাজুয়েট  হতে পারতো৷ মেয়েরা প্রথম প্রথম পড়াশুণা করতো না৷  ধীরে ধীরে মেয়েরা   পড়াশুণার জগতে আসতে থাকে৷ সমাজও কিছুটা উদার হয় ও মেয়েদের  পড়াশুণার অনুমতি  দেয়৷ এইভাবে  চলতে থাকে প্রায়  পৌনে দু’শো বছর৷

এই পড়াশুণা মূলতঃ জনবহুল  শহরতলী ও নগরের মধ্যে  সীমাবদ্ধ ছিল৷ সেই কারণে  গ্রামের  মেধাবী ছাত্ররাও বিদ্যালয়ের  অভাবে  উচ্চবিদ্যালয়  প্রাথমিক  শিক্ষার  পর  আর তারা এগুতে  পারতোনা৷

এই বিদ্যালয়গুলি  কিছু  সরাসরি  সরকারের পক্ষ থেকে  তৈরী করা হত৷ তবে  কিছু কিছু  জমিদার  শিক্ষা বিস্তাতের জন্যে সুকল গড়তেন৷ জেলার ডি আই গণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, পরিদর্শন  করে সন্তুষ্ট হলে  সরকারী শিক্ষা বিভাগের প্রধান  অনুমতি দিতেন৷  এইসব  শিক্ষালয়ের  শিক্ষকগণ যৎসামান্য সরকারী আর্থিক  অনুদান  লাভ করতেন৷  আর ছাত্রছাত্রাদের পক্ষ থেকে যৎসামান্য  অর্থ শিক্ষকদের দেওয়া  হতো৷

স্বাধীনতার পর শিক্ষিত যুবক-যুবতীগণ  ব্যাপকভাবে  শিক্ষা বিস্তারের জন্যে সারা দেশে-  গ্রামে  গ্রামে  প্রায়  যৎসামান্য পারিশ্রমিকে  বিদ্যালয় খোলেন  স্থানীয় ব্যষ্টিদের আর্থিক সহায়তা ও  উৎসাহে৷   ফলে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় সারা  ভারতে শিক্ষাবিস্তারের  এই সুবর্ণ সুযোগ  আসে৷ কিন্তু দেখা  গেছে যখনই সরকারে  পরিবর্ত্তন এসেছে  তখনই  শিক্ষাক্ষেত্রে শাসকদল  দারুণভাবে  হস্তক্ষেপ করেছে৷ এইভাবে শিক্ষাক্ষেত্রকে এক অস্বাভাবিক  অনিশ্চিততার মধ্যে  এনে ফেলেছেন৷ 

এরাজ্যে বামেদের আমলে  দীর্ঘ ৩৪ বছর  শিক্ষাব্যবস্থাকে  নিজেদের মতো করে পুস্তকাদি  ও পঠনপাঠনের বিষয়ের পরিবর্তন ঘটানো হয়৷   এরফলে শিক্ষাক্ষেত্রের নামে অবনয়ণ চলতে থাকে৷

 শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাবিদদের হাতে থাকাটাই  ন্যায় সঙ্গত৷ কিন্তু বর্তমান সরকার  যে দল চালায়  তাদের  দাবী হলো,  শিক্ষার  খরচ  তারা বহন  করে  তাই তারাই  সবকিছু  নিয়ন্ত্রণ করবে৷

মনে রাখতে হবে  সরকার  আসবে  যাবে৷  শিক্ষা নিরপেক্ষ শিক্ষিত মানুষ তৈরী করবে৷ রাজনীতির ক্যাডার তৈরী শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য নয়৷  শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির হস্তক্ষেপের জন্যে শিক্ষকগণের মান সম্মান  পর্যন্ত অনেকক্ষেত্রে  ক্ষুণ্ণ হয়ে চলেছে যা সমাজের ক্ষেত্রে চরম লজ্জার কারণ হয়ে উঠেছে৷  শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির অনুগত ছাত্রসংগঠনগুলি শিক্ষাক্ষেত্রকে চরমভাবে কলুষিত করছে৷ সম্প্রতি কলেজগুলিতে ছাত্র ভর্তিরক্ষেত্রে নোতুন ছাত্র-ছাত্রাদের কাছ থেকে  ছাত্র নেতা-নেত্রীরা অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণ  অর্থ আদায় করার ঘটনাকেন্দ্র করে  অনেক গণ্ডগোল হয়েছে৷

বর্তমানে  শিক্ষাকে  সরাসরি  সরকারের নিয়ন্ত্রণে   এনে  শিক্ষাব্যবস্থার  সর্বস্তরে  সরকারী হস্তক্ষেপ  ফলে নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হারিয়ে ফেলেছে তাঁদের স্বাধীকার৷ শিক্ষক-শিক্ষিকারা  হয়ে  গেছেন  যেন বেতনভূক  কর্মচারী৷ সরকার  যা বলবেন  তাঁদের তাই করতে হবে৷  শিক্ষাব্যবস্থাটা  বর্তমানে  দলীয়  শাসকদের হাতে যেন ক্রীড়ানকমাত্র৷ বহুস্থানে শিক্ষাক্ষেত্রে  শিক্ষক  নিয়োগ হচ্ছে না৷   পড়াশুণা প্রায় বন্ধ উপযুক্ত শিক্ষকের  অভাবে৷  অবসর প্রাপ্তদের স্থানে  নোতুন  শিক্ষক  নিয়োগ  না  হওয়াতে  বহুক্লাস  প্রায় বন্ধ থাকে৷

নামে বিনা বেতনে  সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা দান করা হয়৷ কিন্তু  যে হারে  ছাত্র-ছাত্রা ভর্ত্তি হওয়ার  সময় নানা খাতে  এককালীন টাকা  নেওয়া হয় গবির পরিবারের পক্ষে সেই টাকা  দেওয়া অসম্ভব হয় পড়েছে৷ প্রাইভেট টিউটরদের  পড়াশুণা করতে যে  পরিমাণ টাকা দিতে  হয় প্রতিটি বিষয়ের  জন্য তাতে গরিব  অভিভাবকগণ  চরম আর্থিক  সমস্যায় পড়ছেন৷

  অনেক হয়েছে !  এবার শিক্ষাজগৎকে  মর্যাদার আসনে  বসাতে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি আন্তরিকতার সঙ্গে  দায়িত্ব নিন৷  শিক্ষা নিয়ে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির খেলা বন্ধ করুন৷ এরফলে যেসব কাণ্ড ঘটছে  তাতে বিশ্বের দরবারে ভারতের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ্ হচ্ছে৷ ভারত সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিহাসের পাত্র হচ্ছে৷ এসব দেখেই মহান দার্শণিক শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার Education শব্দটির নোতুন ব্যাখা দিয়েছেন--- যা এই পত্রিকায় বহুবার আলোচিত হয়েছে তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রকৃত শিক্ষাবিদদের হাতে তুলে দিতে ও  এক্ষেত্রে সমস্ত প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে বন্ধ করার  সুপরামর্শ দিয়েছেন৷ এভাবে চললে  শিক্ষার মানে যথার্থ উন্নতি হবে, তাতে দেশে প্রকৃত কল্যাণ হবে৷