শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে এমন এক বিপর্যয় নেমে এসেছে যার ফলে সকলের বিশেষ করে অভিভাবক ও অভিভাবিকা ও ছাত্রছাত্রাদের মনে এসে গেছে এক আশঙ্কা ৷ শিক্ষাব্যবস্থা সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রায় সব দেশেই আছে৷ আমাদের দেশে ইংরেজ আমল থেকে যে নোতুন ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে সেই পদ্ধতিকে আমরা মেনে চলেছি প্রায় অদ্যাবধি৷ বিদেশী শাসকদের দেশ শাসনে প্রয়োজন ছিল কেরাণী কুলের, যারা কিছুটা ইংরাজীতে পোক্ত হবে৷ তাই পরবর্ত্তীকালে বলা হতো শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজ আমলে কেরাণী তৈরীর কারখানা৷ শৈশবে ছেলেরা প্রাথমিক স্কুলে পড়াশুণা করতো, তারপর হাইস্কুলে, পরে কলেজে পড়তো বিশেষ করে ইংরেজী, বাংলা, ইতিহাস, অঙ্ক, ভূগোল, সংস্কৃত ইত্যাদি বিষয় নিয়ে৷ বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার ক্ষেত্র ছিল খুবই সীমিত ৷ ধীরে ধীরে কমার্স বিভাগে পঠন পাঠন চালু হয়৷
মোট প্রাথমিকে ৪বছর, মাধ্যমিকে ৬ বছর, কলেজে ৪ বছর মোট ১৪ বছর পড়তে হতো৷ তারপর ছাত্ররা গ্রাজুয়েট হতে পারতো৷ মেয়েরা প্রথম প্রথম পড়াশুণা করতো না৷ ধীরে ধীরে মেয়েরা পড়াশুণার জগতে আসতে থাকে৷ সমাজও কিছুটা উদার হয় ও মেয়েদের পড়াশুণার অনুমতি দেয়৷ এইভাবে চলতে থাকে প্রায় পৌনে দু’শো বছর৷
এই পড়াশুণা মূলতঃ জনবহুল শহরতলী ও নগরের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল৷ সেই কারণে গ্রামের মেধাবী ছাত্ররাও বিদ্যালয়ের অভাবে উচ্চবিদ্যালয় প্রাথমিক শিক্ষার পর আর তারা এগুতে পারতোনা৷
এই বিদ্যালয়গুলি কিছু সরাসরি সরকারের পক্ষ থেকে তৈরী করা হত৷ তবে কিছু কিছু জমিদার শিক্ষা বিস্তাতের জন্যে সুকল গড়তেন৷ জেলার ডি আই গণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, পরিদর্শন করে সন্তুষ্ট হলে সরকারী শিক্ষা বিভাগের প্রধান অনুমতি দিতেন৷ এইসব শিক্ষালয়ের শিক্ষকগণ যৎসামান্য সরকারী আর্থিক অনুদান লাভ করতেন৷ আর ছাত্রছাত্রাদের পক্ষ থেকে যৎসামান্য অর্থ শিক্ষকদের দেওয়া হতো৷
স্বাধীনতার পর শিক্ষিত যুবক-যুবতীগণ ব্যাপকভাবে শিক্ষা বিস্তারের জন্যে সারা দেশে- গ্রামে গ্রামে প্রায় যৎসামান্য পারিশ্রমিকে বিদ্যালয় খোলেন স্থানীয় ব্যষ্টিদের আর্থিক সহায়তা ও উৎসাহে৷ ফলে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় সারা ভারতে শিক্ষাবিস্তারের এই সুবর্ণ সুযোগ আসে৷ কিন্তু দেখা গেছে যখনই সরকারে পরিবর্ত্তন এসেছে তখনই শিক্ষাক্ষেত্রে শাসকদল দারুণভাবে হস্তক্ষেপ করেছে৷ এইভাবে শিক্ষাক্ষেত্রকে এক অস্বাভাবিক অনিশ্চিততার মধ্যে এনে ফেলেছেন৷
এরাজ্যে বামেদের আমলে দীর্ঘ ৩৪ বছর শিক্ষাব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে পুস্তকাদি ও পঠনপাঠনের বিষয়ের পরিবর্তন ঘটানো হয়৷ এরফলে শিক্ষাক্ষেত্রের নামে অবনয়ণ চলতে থাকে৷
শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষাবিদদের হাতে থাকাটাই ন্যায় সঙ্গত৷ কিন্তু বর্তমান সরকার যে দল চালায় তাদের দাবী হলো, শিক্ষার খরচ তারা বহন করে তাই তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে৷
মনে রাখতে হবে সরকার আসবে যাবে৷ শিক্ষা নিরপেক্ষ শিক্ষিত মানুষ তৈরী করবে৷ রাজনীতির ক্যাডার তৈরী শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য নয়৷ শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির হস্তক্ষেপের জন্যে শিক্ষকগণের মান সম্মান পর্যন্ত অনেকক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হয়ে চলেছে যা সমাজের ক্ষেত্রে চরম লজ্জার কারণ হয়ে উঠেছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির অনুগত ছাত্রসংগঠনগুলি শিক্ষাক্ষেত্রকে চরমভাবে কলুষিত করছে৷ সম্প্রতি কলেজগুলিতে ছাত্র ভর্তিরক্ষেত্রে নোতুন ছাত্র-ছাত্রাদের কাছ থেকে ছাত্র নেতা-নেত্রীরা অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ আদায় করার ঘটনাকেন্দ্র করে অনেক গণ্ডগোল হয়েছে৷
বর্তমানে শিক্ষাকে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে সরকারী হস্তক্ষেপ ফলে নানান সমস্যা দেখা দিয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হারিয়ে ফেলেছে তাঁদের স্বাধীকার৷ শিক্ষক-শিক্ষিকারা হয়ে গেছেন যেন বেতনভূক কর্মচারী৷ সরকার যা বলবেন তাঁদের তাই করতে হবে৷ শিক্ষাব্যবস্থাটা বর্তমানে দলীয় শাসকদের হাতে যেন ক্রীড়ানকমাত্র৷ বহুস্থানে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না৷ পড়াশুণা প্রায় বন্ধ উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে৷ অবসর প্রাপ্তদের স্থানে নোতুন শিক্ষক নিয়োগ না হওয়াতে বহুক্লাস প্রায় বন্ধ থাকে৷
নামে বিনা বেতনে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা দান করা হয়৷ কিন্তু যে হারে ছাত্র-ছাত্রা ভর্ত্তি হওয়ার সময় নানা খাতে এককালীন টাকা নেওয়া হয় গবির পরিবারের পক্ষে সেই টাকা দেওয়া অসম্ভব হয় পড়েছে৷ প্রাইভেট টিউটরদের পড়াশুণা করতে যে পরিমাণ টাকা দিতে হয় প্রতিটি বিষয়ের জন্য তাতে গরিব অভিভাবকগণ চরম আর্থিক সমস্যায় পড়ছেন৷
অনেক হয়েছে ! এবার শিক্ষাজগৎকে মর্যাদার আসনে বসাতে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব নিন৷ শিক্ষা নিয়ে দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির খেলা বন্ধ করুন৷ এরফলে যেসব কাণ্ড ঘটছে তাতে বিশ্বের দরবারে ভারতের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ্ হচ্ছে৷ ভারত সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিহাসের পাত্র হচ্ছে৷ এসব দেখেই মহান দার্শণিক শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার Education শব্দটির নোতুন ব্যাখা দিয়েছেন--- যা এই পত্রিকায় বহুবার আলোচিত হয়েছে তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রকৃত শিক্ষাবিদদের হাতে তুলে দিতে ও এক্ষেত্রে সমস্ত প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে বন্ধ করার সুপরামর্শ দিয়েছেন৷ এভাবে চললে শিক্ষার মানে যথার্থ উন্নতি হবে, তাতে দেশে প্রকৃত কল্যাণ হবে৷
- Log in to post comments