বর্ত্তমান ভারতে রাজনীতির অভিমুখ

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

কথায় আছে রাজনীতি মানে রাজার নীতি,  আবার অনেকে বলেন,  রাজনীতি হলো  নীতির রাজা৷  অর্থ যাই হোক,  রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত রাজ্য বা দেশের জনগণের সার্বিক  উন্নতি ও মঙ্গল সাধনে একটি সুসংবদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করে শাসকবৃন্দ বা নেতৃবৃন্দ সেই রাজ্য বা দেশ পরিচালনা করবে৷  জনগণের সার্বিক উন্নতি  শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন  বা অন্ন-বস্ত্র--শিক্ষা-বাসস্থান-স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানই নয় , তাদের পরিপূর্ণ মানসিক  ও আত্মিক বিকাশের  জন্যে  সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিরও বিশেষ প্রয়োজন৷  এই রাজনীতি শব্দটির আর্থিক বা ব্যবহারিক প্রয়োগ  যেভাবেই হোক---‘‘নীতি’’ শব্দটি  তার সঙ্গে  সর্বদাই যুক্ত৷ অর্থাৎ রাজনীতির সঙ্গে নীতিবাদ  বা নৈতিকতার মেলবন্ধন থাকতেই হবে, নচেৎ রাজনীতি একটি দুনীর্তি বা অনৈতিক কাজকর্মের আখড়াতে পরিণত হবে৷  ভারতের মতো বিশাল গ্রামীণ এলাকাযুক্ত দেশের বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, গোষ্ঠী-সম্প্রদায় বিশিষ্ট মানুষজনের পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলে, সেই আশঙ্কা আরও প্রবল হয়ে ওঠে৷ ভারতের নাগরিক সমুদায়ের  সামগ্রিক শিক্ষার মান,  নৈতিকতা ও  রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সেই পর্র্যয়ে এখনো পৌঁছায় নি যাতে তারা সঠিক নাগরিক  অধিকার প্রয়োগ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের মতামত ব্যক্ত করবেন ও ভোটবাক্সে তা সত্য সত্যই প্রতিফলিত হবে৷  ফলে গণতন্ত্রের সার্থক রূপায়ণও ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা সমধিক৷

অপরপক্ষে দেশীয় রাজনীতিকগণ  তাঁদের পেশাকে  বা রাজনৈতিক কাজ কর্মকে  সমাজসেবা নামে অভিহিত করেন৷ কোন নির্বাচনে অংশগ্রহন করলে জনগণের নিকট যখন তারা ভোট ভিক্ষা করেন তখন তাদেরকে জনসেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যে জনগণের সম্মুখে করজোড়ে প্রার্থনা জানান৷ অতএব দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির ‘‘নৈতিকতা’’ ও জনসেবা বা সমাজ সেবার ‘সেবা’ এই দুটি শব্দ রাজনৈতিক নেতাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে  জড়িত ৷

নৈতিকতা, সততা ও অপরের মঙ্গল ভাবনা না থাকলে  সেবার ভাব কিছুতেই আসবে না৷ কারণ সেবা হচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণে  নিজেকে নিয়োজিত করা-সেখানে কোনো কিছু পাওয়ার আশা থাকবে না৷ সেবা করতে গিয়ে যদি বিনিময়ে অন্য কোন প্রত্যাশা থাকে, তবে তা হবে ব্যবসায়৷ ব্যবসাতে দেনা-পাওনার ব্যাপার থাকে, সেবাতে নয়-কারণ সেবা হল একতরফা৷ কিন্তু, বাস্তবিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেবার কথা বললেও তাঁদের পাখীর চোখ তথা শ্যেন দৃষ্টি থাকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মোটা মাসোহারা,  আর্থিক সুযোগ সুবিধা, প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার প্রতি সদাজাগ্রত৷  তার ওপর  শাসক দলের বিধায়ক বা সাংসদ হতে পারলে তো সোণায় সোহাগা-এমনকি  মন্ত্রিত্বও কপালে জুটে যেতে পারে৷ আর এর জন্য বহুবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তেও তারা কুন্ঠিত হন না৷ তখন সেবা ও নীতি দুটিকে জলাঞ্জলি দিয়ে  জনসেবার মোড়কে  স্বার্থসিদ্ধিই প্রধান উপজীব্য হয়ে ওঠে৷  স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও  ভারতবর্ষের নেতা-নেত্রীরা  গণতন্ত্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেনি৷ বরং বিভিন্ন রকম  গোষ্ঠী-সম্প্রদায়, ধর্ম-বর্ণ-ভিত্তিক রাজনীতি করতে গিয়ে দেশকে এক চরম ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে চলেছে৷  অশিক্ষা, অপুষ্টি, কুসংস্কার , ভাবজড়তা ,জর্জরিত সাধারণ মানুষকে  ভুল বুঝিয়ে  বিভিন্ন গোষ্ঠী-সম্প্রদায়গত, ধর্ম-বর্ণগত  বিভাজনে  সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিদ্বেষ, অবিশ্বাস ও হিংসার বাতাবরণ সৃষ্টি করে চলেছে৷ ফলে কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধছে , কোথাও গোরক্ষার নামে মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে, কোথাও সম্প্রদায়গত তোষণ আবার  কোথাও একপক্ষ অপরপক্ষকে হুমকি-শাসানি দিয়ে চলেছে৷ আর দেশের মানুষের মধ্যেকার  ঐক্য-সম্প্রীতির ঐতিহ্য ধূলাবলুন্ঠিত হয়ে  আইন-শৃঙ্খলা জনিত পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে৷ সাংস্কৃতিক জগতেও চলছে এক অদ্ভুত অসহিষ্ণুতার  বহিঃপ্রকাশ ৷ কোথাও সাংবাদিক খুন হচ্ছে, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের নামে সাহিত্যসৃষ্টি  ও সিনেমামুক্তিকে নিয়েও চলছে তীব্র অশান্তি৷ সাধারণ মানুষ তাদের বিচার বুদ্ধি ও রুচি অনুযায়ী কোন সাহিত্য পুস্তক পঠন-পাঠন বা কোনো সিনেমা ছবি দেখতে পারেন আবার নাও পারেন৷ কিন্তু সাধারণ মানুষকে সেই সুযোগ না দিয়ে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী স্বার্র্থন্বেষী নেতা-নেত্রী দলীয় স্বার্থে বা গোষ্ঠীস্বার্থে দাঙ্গা হাঙ্গামায় প্ররোচনা দেয় আর তাদের নির্দ্দেশেই চ্যালা-চামুন্ডারা ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ শুধু তাই নয়, প্রতিপক্ষ দলের নেতৃবৃন্দ পরস্পরের প্রতি এমন কুরুচিকর ও কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করেন যা সাধারণ মানুষের কাছে অকল্পনীয় ও অসভ্যতার নামান্তর৷

শিক্ষাজগৎ ও সামাজিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ আরও মারাত্মক৷ ছাত্র-যুবদের মধ্যে  রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও রাজনীতিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক, কারণ  আজকের যুব সম্প্রদায়  দেশের ভবিষ্যৎ ---দেশ ও জাতির অগ্রগতির দায়িত্ব একদিন তাদের হাতেই ন্যস্ত হবে৷ তাদের রাজনীতির শিক্ষাদানের জন্য  সুস্থ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ আবশ্যিক৷  কিন্তু বর্ত্তমানে শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক হানাহানি, পেশীশক্তির ব্যবহার ও গোষ্ঠীকোন্দল এমন একটা পর্র্যয়ে পৌঁছেছে যে ছাত্রযুব সম্প্রদায় একশ্রেণীর অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের ক্রীড়নক হয়ে প্রায়শঃই ঝগড়া লড়াই হাঙ্গামাতে জড়িয়ে পড়ছে৷  এমনকি একই দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে  গণ্ডগোল ও হানা হানি বেড়েই চলেছে৷  ফলে শিক্ষায়তনে সুশিক্ষার পরিবেশ দুষিত হচ্ছে,  ছাত্রসমাজ বিভিন্নরকম কুপ্রবৃত্তি ও নোংরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে উঠছে৷ যা দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে কোনো ভাবেই কাম্য নয়৷ এছাড়া সমাজজীবনে দেখা যাচ্ছে---  যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ও চাপান-উতোর চলে৷ সার্বিকভাবে কোন সমস্যার সমাধান না করে ঘটনাকে রাজনৈতিক রঙে রাঙিয়ে আরও জটিল করে ফেলা হচ্ছে, নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে৷

উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে  মোটামুটিভাবে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, রাজনীতিকে স্বার্থজনিত (দলগত ও গোষ্ঠীগত) দূষণমুক্ত রাখতে হবে ও নৈতিকতা, সততা, সেবা পরায়নতার দ্বারাই দেশের সর্র্বত্মক উন্নতি ও  মানুষের মঙ্গল সাধনে নেতৃবৃন্দকে  অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে৷ নৈতিকতা ও সততায় প্রতিষ্টিত হতে গেলে নীতিবাদের কঠোর অনুশীলনে  অবশ্যই মনোনিবেশ করতে হবে৷  আধ্যাত্মিকতার  ভাবনা না থাকলে,  বৃহতের আদর্শে জীবন পরিচালিত না হলে ব্যষ্টিগত ভাবে মানুষ বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী  হতে পারে না--- প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে যেকোনো  সময়ে পদস্খলিত হবার সম্ভবনা থাকে৷  সেই কারণে রাজনীতিবিদদের প্রত্যেককে  আধ্যাত্মিকতার আদর্শে জীবন ও চিন্তা ধারাকে স্বচ্ছ, শুদ্ধ ও শুভ ভাবনায়  জারিত করতে হবে৷  আর তখনই মন সমস্ত রকম সংকীর্ণতা থেকে  মুক্ত হয়ে উদার ও প্রকৃত সেবার মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হতে পারবে৷ ভারতবর্ষের  মহান ঐক্য ও সম্প্রীতির  ঐতিহ্যকে  আগামী প্রজন্মের কাছে আরও সমুজ্জ্বল করে তুলে ধরতে হলে আজকের ছাত্রযুব ও রাজনীতির লোকেদের অবশ্যই নৈতিকতা, সত্যনিষ্ঠা ও সেবা ধর্মের অনুশীলনের মাধ্যমে সকল ভেদ-বিভেদ ও অশুভ ভাবনার ঊধের্ব উঠে রাজনীতির অভিমুখকে  সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতি প্রধাবিত করতেই হবে৷  আমাদের গর্বের ভারতবর্ষকে ধর্মে, কর্মে, ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে সুমহান ভারতবর্ষরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করা আমাদের সকলের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য আর এরজন্য নিরলস পরিশ্রম ও নিঃস্বার্থ সেবাপরায়নতাই একমাত্র পথ৷