ভাবজড়তার মায়া জাল

লেখক
জিজ্ঞাসু

কুসংস্কার, অন্ধকারে শুধু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে অন্ধবিশ্বাস, বহুদিনের  পুরাতন  কুভ্যাসের মানসিকতার অন্য নাম ‘‘ভাবজড়তা’’ বা ডগমা৷ একটা অজগর সাপ  অনেকগুলি  প্যাঁচে  একজন  মানুষকে  জড়িয়ে  ধরেছে, মাথাটা সবে মাত্র সাপের  মুখে ঢুকেছে৷ মানুষটি নামে মাত্র বেঁচে আছে৷ এবার কল্পনা করুন যাবতীয় যুক্তি বুদ্ধিহীন অন্ধবিশ্বাসই  ওই অজগর সাপ৷ ভাবজড়তাই যেন অজগরের মত বুদ্ধিকে গিলে নেয়, মানুষের তখন বেঁচে থাকা না থাকা সমান৷ সে অসহায়, আশাহীন, হতাশ৷ এমন সাপের  (ভাবজড়তার) বিষয়ে সজাগ করতেই এই লেখার অবতারণা৷

১) প্রচলিত নেশার জীবন ৷ বার বার  চা, কফি , সিগারেট গুটকা মদ বা ড্রাগস যেন ওই কালো অজগর, অতিধীরে গিলছে৷ যারা খায়, কী বলছে?

আমার অভ্যেস হয়ে গেছে৷ জানি  অসুস্থ হয়ে মরব৷  নোতুন  করে নোতুন জীবন আর সম্ভব নয়৷

২) বার বার টিভি সিরিয়ালে  ঝগড়া, সন্দেহ, অবিশ্বাস্যভাবে একে অন্যকে  ছোবল মারার শহুরে শয়তানি, ভয় দেখানো,ধর্ষণ থেকে হত্যা, তার ফাঁকে ফাঁকে  নানা ভোগের বিজ্ঞাপন বার বার দেখিয়ে মানুষের  মনে নকল  খিদে তৈরী করে দেওয়া, যা দেখানো হচ্ছে বার বার তাকে স্বাভাবিক মনে করা ও সে বিষয়ে অন্ধ ও কালা হওয়া যেন সাপের  গেলা৷

৩) সামাজিকতার নামে শোষণ৷ দুটি নর-নারীর বিবাহে পুরোহিতের  অজানা ভাষায় মন্ত্র পড়া অর্থ হীন জেনেও তা বিনাপ্রতিবাদে  মেনে নেওয়া হল ওই সাপে ধরার অবস্থা৷ দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের পণ প্রথার শিকার হওয়া, বা মৃত্যুর  পরে ঋণ করেও  পিণ্ডি গেলাবার ব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া৷

৪) আহার বা পুষ্টি বিষয়েও ভাবজড়তার  শিকার হয় বেশির ভাগ অশিক্ষিত বা তথাকথিত শিক্ষিত মানুষও৷ ওরা স্বাদের জন্যে ভাগাড়কেও চেটে পুটে নেয়৷ আর অসুস্থ হলে ডাক্তার ওষুধের দোকান হাসপাতাল আছে৷ ওদের কথায়, কে না মরবে তো খেয়ে মর৷ এই যে খাবার নেশায়  বুদ্ধি গুলিয়ে  যাওয়া, মানুষের যে বেঁচে  থাকার জন্য  আহার গ্রহণ, স্বাদের জন্যে ভাগাড়ের মাংস গেলা নয়এই বোধের  অভাব মানেই অজগর রূপী ভাবজড়তার  প্যাঁচে পড়া৷

৫) আছে জাত পাতের ডগমা৷ নীচু দলিত মানুষ ব্রাহ্মণ  পাড়ার কুয়ার দড়ি ছঁুতে পারবে না৷ দলিতের নাক থেকে বেরোনো বাতাসের অংশ ব্রাহ্মণ না জেনে  টেনে নিচ্ছে তার বেলা চুপ৷  জলের বেলা  ভাগাভাগি৷ তেমনি  মানবিক ধর্ম ভুলে মন্দির-মসজিদ-এর ভাগাভাগি, রক্তক্ষয়ী লড়াই, এসব অজগরেরই কামড়৷

৬) শনি, সন্তোষী, অলক্ষ্মী, গণেশ, লক্ষ্মী, মনসা, শীতলা, রক্ষাকালী, চামুণ্ডা, সরস্বতীর সাথে কালী, দুর্গার  সাথেই শিব যেম সর্বঘটের  কাঁঠালি কলা৷ কলকাতার পথঘাট ফুটপাত সব ঠাকুর, পূজারী, চা-ওয়ালা, গ্যাঁজাড়ীদের  ঠেক, এ সবই যেন অজগরের মুখে আত্মহত্যা, জেনে-বুঝে বা না বুঝে৷

৭) কুরবানির  নামে অসহায় গোরু বা উট হত্যা মুসলমানদের৷ হিন্দুদের মা কালীর সামনে অসহায় ছাগল বলি৷ আদিবাসীদের মুরগি হত্যা৷  মানুষ দীর্ঘদিন ধরে  ওই সবে অভ্যস্থ  হয়৷ নিজের অজান্তে ভেতরে ভেতরে  নিষ্ঠুরতার নেশায় মজে থাকে৷  অজগরের বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছুঁয়ে  থাকার মত৷

 

৮) সংস্কৃতির  ভাবজড়তা৷ বাইরে  বাইরে চরম জাঁকজমকের  প্রতিযোগিতা, এক পাড়াতেই কেবল ক্ষমতা দেখাতে পাঁচ প্যান্ডেলে পাবলিকের টাকায় পূজোর সময় পাঁচ ক্লাবের জন্ম  হয়ে যাবে৷ প্রতি রাতে  ঠাকুরের সামনেই  গাঁজা মদের আসর তার সাথে কান ফাটানো বাজনা গান৷  মধ্যরাতে ধর্মের বাহানায় এই সভ্যতাকে যখন  সাধারণ মানুষ ভয়ে মেনে নেয়, অপমান বা মৃত্যুর ভয়ে মেনে নেয়, এটাও তো  ওই সাপের মুখে মাথা ঢোকানোই হ’ল৷

ক্ষণিক আত্মসুখের  লোভে মানুষ ভাবজড়তা মেনে নেয়৷ লেখাপড়া জানা মানুষেরা  ভালো করেই  জানে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না, সব বোঝে  সব জানে , সব জ্ঞান-পাপী, সব জেনে বুঝেও ওরা ডগমাকে মানে ৷ তাদের  মনের কথা তখন, এতে  অন্যের ভালই হোক বা মন্দই হোক, আমি তো কিছুটা সুখ পেলুম, এই হল ভাবজড়তা রূপী সাপকে জড়িয়ে থাকা৷ এইভাবে যুবসমাজের  বুদ্ধি  অচল  অথর্ব  হয়ে পড়ে৷ বেশী সরব হবার চেষ্টা কেউ  করলে  তাকে চুপ করাবার  কৌশল  বেনিয়াদের  জানা আছে৷

এমন সামাজিক  অন্ধকার যুগে আরেকটা নবজাগরণ চাই৷  সমবেত শক্তি বুদ্ধি বলে এহসব ভাবজড়তার  মায়াজাল ছিঁড়ে ফেলার সময় এসেছে৷